০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ০১:৫৬:৫৫ অপরাহ্ন


বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন বাতায়ন
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৫-২০২২
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন বাতায়ন


ইদানীং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরসহ (মাতারবাড়ি) অন্যান্য বন্দর সুবিধা ভারতকে উন্মুক্ত করার কথা সূচনা হওয়ায়, ভারত বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নতুন রূপায়ন হতে চলেছে। দীর্ঘদিন অমীমাংসিত নদীসমূহের  জলবণ্টন চুক্তি ঝুলে রয়েছে। বাণিজ্যিক ভারসাম্য সৃষ্টির কিছু মূল উপাদান ভারতের উন্নাসিকতায় প্রলম্বিত। তবে ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সমদ্রসীমার বিরোধ মিটেছে। 

উভয় দেশের মধ্যে সড়ক, রেল, জলযান যোগাযোগ ক্রমশই বিস্তৃত হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে ইতিপূর্বে থাকা, ভারতবিরোধী সকল শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করেছে বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশবিরোধী কিছু কিছু কর্মকাণ্ড ভারতে হচ্ছে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ডশূন্য হয়নি। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের বন্দরসমূহ ভারতের জন্য উন্মুক্ত করার প্রাক্কালে উভয় দেশের যাবতীয় অমীমাংসিত বিষয়গুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। 

দু’দেশের সম্পর্ক এই নয় যে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরেকটি দেশ ক্রমাগত নাক গলাবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক প্রভাবিত করবে। জ্বালানি নীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি প্রভাবিত করবে। ইদানীং দেখছি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়ে ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। একসময় তিনি বলেছিলেন, দু’দেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর। এগুলো কিন্তু নতজানু পররাষ্ট্র নীতির লক্ষণ। 

জানি, এগুলো তার ব্যক্তিগত দর্শন বা হঠকারিতা। সরকার কিন্তু চীন, জাপান, কোরিয়া,ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা যেমন গুলশানে হোলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড, পিলখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ডবিষয়ের নেপথ্যে কোনোবিদেশি শক্তি আছে কি-না সেটি কিন্তু উন্মোচিত হয়নি।

প্রায় তিনদিকের (উত্তর,পশ্চিম,পূর্ব) ভারত সীমান্তÍবেষ্টিত ক্ষুদ্র বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ নানা কারণেই এখন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে আলোচিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনেকটা প্রত্যাশিতভাবে চিহ্নিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ’ এখন অপার সম্ভাবনাপূর্ণ দেশ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শতভাগ মানুষের বিদ্যুৎ সুবিধা এবং আরো কিছু মানদণ্ডে দক্ষিণ এশিয়ায় আগুয়ান। সমস্যা সংকট আছে অনেক। সেগুলো চিহ্নিত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক প্রধান দেশ ভারতের সঙ্গে সমতার চিত্তিতে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়ক দেশ। সে সূত্রে বাংলাদেশিরা অবশ্যই ভারতের কাছে বিশেষত প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু নানা কারণে প্রধানত ভারত সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বেশকিছু বিষয় গত ৫০ বছরে অমীমাংসিত থাকায় সম্পর্কে তিক্ততাও রয়েছে। 

আমি ভারত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষপাতি। কিন্তু সে সম্পর্ক অবশ্যই হতে হবে, স্বাধীন সর্বভৌম দুটি দেশের পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে। একটি দেশ শুধু নিয়েই যাবে, বিনিময়ে সামান্য পাবে সেটি সৎ প্রতিবেশী সুলভ আচরণ হতে পারেনা।  

বাংলাদেশ সড়ক, রেলপথ উন্মুক্ত করায় ভারতের কিন্তু বিশাল সুযোগ হয়েছে কলকাতা থেকে ত্রিপুরা, মেঘালয় ,আসাম যোগাযোগের। কিন্তু বাংলাদেশ কিন্তু এখনো নেপাল ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির করিডোর ব্যবহারের সুযোগ পায়েনি। ঝুলে আছে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি। লোয়ার রাইপেরিয়ান দেশ হিসাবে বাংলাদেশ  অধিকার বঞ্চিত হয়ে আছে। শীতের সময়ে অধিকাংশ নদীর পানি উজানে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বর্ষায় বাংলাদেশ প্লাবিত হচ্ছে। 

বাংলাদেশের মরুকরণ এবং প্লাবন বিষয়টি কেন ভারতের অগ্রাধিকারে নেই। আমি ভারতকে নির্ধারিত শুল্কের ভিত্তিতে বন্দর সুবিধা দেয়ার বিরোধী নই। কিন্তু এই সুবিধা ব্যবহার করে ভারত সামরিক সরঞ্জাম একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেন না নেয়, সেটি নিশ্চিত হতে হবে। খাদ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, নিত্যবাবহার্য দ্রব্যাদি নির্ধারিত শুল্কের বিনিময়ে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাতায়াত করলে উভয় দেশ উপকৃত হবে। শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মানতে হবে। স্বচ্ছ পদ্ধতিতে বিষয়টি নির্ধারিত হতে হবে। 

অনেকে বলেন, বাংলাদেশ ভারতের প্রভাবে কয়লা উত্তোলন করতে পারছে না। একসময় টাটা বাংলাদেশের খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করতে চেয়েছিলো। কিছুদিন পর কিন্তু ফুলবাড়ী ঘটনা ঘটেছিলো। অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের ভারতের প্রভাবে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করছে না। হয়তো কিছুটা সত্যি হতেও পারে। তবে নিশ্চিত নই? 

বাংলাদেশের চারপাশে অন্তত চারটি বড় ধরনের ক্রুড অয়েল রেনিনেরই আছে ভারতের। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এগুলো ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করছেনা।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ক্রুড আমদানি,সড়ক বা রেলপথে ক্রুড রেফিনেরই অঞ্চলে পৌঁছানো এবং একইভাবে রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম দ্রব্যাদি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন অংশে সরবরাহের সুযোগ হলে রিফাইনারিগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালু থাকতে পারবে। বিনিময়ে বাংলাদেশকে সুলভ মূল্যে পেট্রোলিয়াম দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে হবে ভারতকে। এটি করা সম্ভব হলে উভয় দেশ অনেক উপকৃত হবে। প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত করলাম। 

ভারত বাংলাদেশ যৌথভাবে স্থানীয় মুদ্রায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল, এলএনজি সুলভ মূল্যে আমদানি করতে পারে কিনা ভেবে দেখা যায়। বাংলাদেশ এককভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পড়াবে বলে মনে হয়না। 

জানি, বর্তমানে প্রসঙ্গটি তোলা একটি রাজনৈতিক কৌশল। এটি উঠিয়ে একটি মহল জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরাতে চেষ্টা করছে। তবে বাংলাদেশিরা দেশে এবং প্রবাসে অনেক সতর্ক। বিতর্কিত প্রসঙ্গ হলে পানি পাবে বলে মনে হয়না।


শেয়ার করুন