০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ০৩:৪৯:৪৮ অপরাহ্ন


ক্রমাগত কমছে এলসি
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষণায় চিন্তিত ব্যবসায়ীরা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১১-২০২৩
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষণায় চিন্তিত ব্যবসায়ীরা


দীর্ঘদিন ধরে চলমান ডলার-সংকট সাম্প্রতিক সময়ে আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করলে রিজার্ভের মজুদে টান পড়ে। তা সামাল দিতে গত অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে আমদানিতে তাৎক্ষণিক এর প্রভাব দেখা না গেলেও গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। এরপর থেকে ক্রমাগতভাবে কমছে এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি। ফলে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ নিত্যপণ্য আমদানি হ্রাস পাওয়ায় দেশে পণ্যের দামও হু হু করে বেড়েই চলেছে। এছাড়া এলসি খুলতে না পারায় দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়েও আমদানি-বাণিজ্য কমে গেছে। আমদানি কম হওয়ায় বেনাপোল কাস্টমস হাউজে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে। ওদিকে বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি ঘোষণায় চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। 

জানা গেছে, গত অর্থবছরের শেষ দিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই সময় ডলারের সংকটও ছিল তীব্র। বেশ কিছু এলসি খোলার আবেদন প্রত্যাখ্যানও করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও ডলার-সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যর্থ হয়েছে। এতে সংকট আরো গভীর হয়েছে, যার প্রভাবে চলতি অর্থবছরের আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে আমদানি দায় পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন নেমে এসেছে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। চাহিদামতো এলসি খুলতে না পেরে এখন শিল্প কাঁচামাল, নিত্যপণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতির মতো অত্যাবশ্যকীয় আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে ১১.২২ শতাংশ। এ চার মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে মোট ২ হাজার ১৮২ কোটি ডলারের। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় এলসি খোলা হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ৪৬৬ কোটি ডলারের। এ সময় ব্যাংকগুলোর এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে ২৪ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে ব্যাংকগুলো এলসি নিষ্পত্তি করেছিল ২ হাজার ৮৯৪ কোটি ডলারের। সেখান থেকে কমে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে তা নেমে এসেছে ২ হাজার ১৯৭ কোটি ডলারে। এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটানা ১২ মাস ধরে আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি চলে আসছে। 

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মূলধনী যন্ত্র ও কাঁচামাল দুটিরই আমদানি কমে গেছে। উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে, গ্যাস-সংকটের কারণে তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের দিকে যাচ্ছে। চলমান ডলার-সংকট ও এলসি বিড়ম্বনাকে এখন শিল্পখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা জানান, ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে নানা ধরনের শর্ত দিচ্ছে। তাদের মতে, একদিকে উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগ্যপণ্যের বিক্রিও কমছে।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ব্যাংকগুলো এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। চাহিদামতো ডলারের সংস্থান না হওয়া বা এলসি খুলতে না পারায় শিল্প কাঁচামালের আমদানি কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ব্যবস্থার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। 

এদিকে দেশের পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বিধিনিষেধ ও ভিসানীতির পর শ্রম অধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেওয়া বক্তব্যটি এখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা প্রবাহের পর ঘোষিত এ স্মারক এখন উদ্যোক্তাদের নতুন করে ভীত করে তুলছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেছেন। 

গত ১৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীলসমাজ ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতি নিয়ে অনেকের মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বাংলাদেশের জন্য এ পদক্ষেপ নেয়নি। তবু পুরো বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি নিয়ে এখনই ‘প্রতিক্রিয়া নয়’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ১৬ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করতে নির্দেশনা জারি করেনমার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশনা সংবলিত দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির একাংশের স্ক্রিনশট বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানিকারকেরা উদ্বিগ্ন। তবে সরকার এ বিষয়ে এখনই প্রতিক্রিয়া জানানো কিংবা হুটহাট কোনো কিছু করার কথা বিবেচনা করছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ীদের সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে। 

দেশের শীর্ষ কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতি নিয়ে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানা। 

বৈঠকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সালমান এফ রহমান বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এটি সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য নয়। তিনি বলেন, ‘শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করে যাচ্ছি। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের ঘোষিত নতুন শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতির বিষয়ে আমাদের আগবাড়িয়ে জানার কিছু নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শ্রম অধিকারবিষয়ক স্মারক শুধু বাংলাদেশের জন্য, এটা ধরে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক, ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন এবং শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতি ঘোষণার সময়টা মিলে যাওয়া অনেকটা কাকতালীয়।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশের শ্রমিকনেতা কল্পনা আক্তারের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। ফলে অনেকে শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতিটিকে বাংলাদেশের জন্য বলে উল্লেখ করছেন, যা আসলে সরলীকরণ। 

কূটনৈতিক একটি সূত্র বলেছে, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) এবং সমৃদ্ধির স্বার্থে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক রূপরেখা (আইপিইএফ) এই দুটি ক্ষেত্রেই উন্নত শ্রমমান নিশ্চিতের বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে বাইডেন ঘোষিত নতুন শ্রম অধিকারবিষয়ক নীতির সঙ্গে আইপিএস এবং আইপিইএফের সম্পর্ক রয়েছে।

শেয়ার করুন