০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৫:০৪:২১ অপরাহ্ন


এমএসএফ’র সংবাদ সম্মেলন
মানবাধিকার-গণতন্ত্র বিকাশে ২০২৩ এ তেমন অর্জন নেই
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০১-২০২৪
মানবাধিকার-গণতন্ত্র বিকাশে ২০২৩ এ তেমন অর্জন নেই হেমলেট বাহিনীর অত্যাচার


মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র বিকাশ, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অংশীদারিত্ব বাড়াতে ২০২৩ সালে তেমন কোন অর্জন পরিলক্ষিত হয়নি। প্রকৃত অর্থে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমাঅবনতি ঘটছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে রোববার মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে আসে। ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩ : এমএসএফ’র পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এর ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন এমএসএফ নির্বাহী প্রধান অ্যাডভোকেট মো: সাইদুর রহমান। আরো উপস্থিত ছিলেন এমএসএফ সমন্বয়কারী মোহাম্মদ টিপু সুলতান ও এমএসএফ কর্মীরা। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩ : এমএসএফ’র পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে আসে। 

এমএসএফ’এর রিপোর্টে আরো বলা হয়, দারিদ্র্য নিরসন, জেন্ডার সমতা অর্জন, গ্রামীণ উন্নয়ন শক্তিশালীকরণ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্প্রসারণ এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভিষ্ঠ্য লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। তা সত্ত্বেও এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন, বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতিমুক্ত সেবা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, উচ্চমূল্য রপ্তানি পণ্য সৃষ্টি, রপ্তানি বৈচিত্র্যয়ান এবং সর্বোপরি মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র বিকাশ, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অংশীদারিত্ব বাড়াতে তেমন কোন অর্জন পরিলক্ষিত হয়নি। 

সংবাদ সম্মেলনে জানান হয় যে, এমএসএফ’র তথ্যানুসন্ধান এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের বিরোধীদলসমূহের কর্মসূচির কারণে সবচাইতে উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ বিরোধী দল বিভিন্ন সময়ে সমাবেশের ডাক দেয়। এই প্রেক্ষিতে সরকার সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধের কারণ দেখিয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে যা চলমান রাখা হয়েছে। তল্লাশি, কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি ও বেআইনি বল প্রয়োগ করার ফলে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সকল দলের কর্মসূচি পালনের জন্য অনুকূল না হয়ে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের রাস্তায় শক্তি প্রদর্শন বা বিরোধী দল দমনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। পুলিশের অভিযান সত্ত্বেও সরকারি দলের নেতাদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা গেছে। ফলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট যা অনাকাঙ্ক্ষিত। সাধারণ মানুষ গভীর শংকা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছে। ঘটেছে সাংবাদিক লাঞ্ছনা, অগ্নিসংযোগ এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। পরবর্তীতে বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দলের ডাকা হরতাল ও অবরোধ চলাকালে হতাহত, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন কেটে ফেলা, রেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে যার দায় বিরোধীদল ও এড়াতে পারে না। 

এমএসএফ’এর রিপোর্টে আরো বলা হয় মানবাধিকার লংঘনের আরেকটি ঘটনা নতুনভাবে যোগ হয়েছে যা হচ্ছে মুখোশ পরে গুপ্ত হামলার মতো ঘটনা। অত্যন্ত উদ্বেগজনক এ বিষয়টির বেশির ভাগ ঘটনা রাতে ও নির্জন রাস্তায় ঘটছে। মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে করে এসে মুখোশধারী ব্যক্তিরা আহত ও নিহতদের পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি চালিয়ে হত্যা ও গুরুতর জখম করছে। খবরের তথ্য অনুযায়ী গুপ্ত হামলার শিকার বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী। 

অপরদিকে অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অনেক গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিককে বেতন-ভাতা দিতে না পারায় দীর্ঘদিন তাঁদের বেতন বকেয়া পড়ে। পাশাপাশি শ্রমিক ছাঁটাইও চলতে থাকে। এর মধ্যে শ্রমিকেরা ন্যায্য বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলন দমনে সরকার শ্রমিক বিক্ষোভের কারণ বিবেচনায় না নিয়ে অতিরিক্ত ও অযাচিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করে শ্রমিক হতাহতের মত ঘটনা ঘটিয়েছে যা দুর্ভাগ্যজনক।

এছাড়া নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এ অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, হানাহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে। মনোনয়ন পাওয়া ও না পাওয়ায় অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফলে উভয় পক্ষ নির্বাচনী মাঠ দখলে সংঘাত ও সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃশ্যত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতায় হতাহত ও নানাবিধ অনিয়মের কারণে জনগণ স্বাধীনভাবে নিজেদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে নির্বাচনে জনগণ তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না।

এমএসএফ’র তথ্যানুসন্ধান এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক ২০২৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ার, আইনবর্হিভূত হত্যাকান্ড, বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে। অপহরণ বা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। অন্যদিকে দেশের সীমান্তগুলিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিক হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অবিরত হুমকির সম্মুখিন হয়েছেন। ডিজিটাল-সাইবার সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকের বস্তুনষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনা ঘটেছে যা একটি ভয়ঙ্কর অপতৎপরতার সামিল। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনাসমূহ কমেনি বরং অধিক সংখ্যায় ঘটেছে যা ছিল ২০২৩ সালের অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয়। ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত হত্যা, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনার সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণপিটুনির ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে যা মানবাধিকারের চরম লংঘন।

এমএসএফ’এর রির্পোটে আরো বলা হয় বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ২০২৩ সময়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সর্বপরি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বরং ক্ষেত্রে বিশেষে অবনতি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ সময়কালে, দেশে বিরাজমান সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক, গণতান্ত্রিক, আইনি পরিবেশ ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়ভাবে উদ্বেগজনক।

২০২৩ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রবণতা এমএসএফ’এর রির্পোটে আরো বলা হয় এ বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিশ্লেষণে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় ছিল যথেচ্ছ রাজনৈতিক সহিংসতা, গায়েবি মামলা, গণগ্রেফতারের পাশাপাশি নির্বাচনী সহিংসতা। এ ধরনের গায়েবি মামলার টার্গেট ছিল বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী। বিশেষ করে বিএনপি’র বিরুদ্ধে কথিত গায়েবি মামলা এবং এ সকল মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়তে দেখা গেছে। বিএনপি’র মহাসচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন এবং তারা জামিনও পাচ্ছেন না। এখনও গ্রেফতার অব্যহত রয়েছে। পুরানো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রাতারাতি বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এর ফলে নাগরিকের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও রাজনীতিতে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার খর্ব হয়েছে।

শেয়ার করুন