২৮ মার্চ ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৯:২৬:৫৬ অপরাহ্ন


দেশকে শরীফ নুরুল আম্বিয়া
অনেক কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৫-২০২২
অনেক কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই শরীফ নুরুল আম্বিয়া/ছবি সংগৃহীত


বাংলাদেশ জাসদ সভাপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, দেশের অনেক কিছুই এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হয় না।দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে তার বক্তব্য জানতে চাইলে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে শরীফ নুরুল আম্বিয়া এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি।

বাংলাদেশ জাসদের বর্তমান সভাপতি শরীফ নুরুলআম্বিয়া ১৯৪৮সনে নড়াইল জেলার ভবানীপুরের এক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শরীফ আবুল বাশার, মাতা মনোয়ারা বেগম।

১৯৬৪ সনে তেজগাঁও টেকনিক্যাল হাইস্কুল (বর্তমানে সায়েন্স কলেজ) থেকে এসএসসি ও ১৯৬৬ সনে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ১৯৭০ সনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৬৮সনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেন। পাকিস্তানের ফৌজি শাসক জেনারেল আয়ুব খানের উচ্ছেদ এবং শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১দফা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০সনে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিতহন। ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন,’৭১-এরঅসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রনেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। 

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিএলএফ তথা, মুজিববাহিনীর প্রথম ব্যাচে দেরাদুনে গরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি ১৯৭৭-৭৮সনে ১৫ মাস কারাবরণ করেন। জাসদের সকল সিনিয়র নেতা যখন কারাগারে তখন আত্মগোপনে থেকে তিনি সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামে দলের নেতৃত্ব দেন। কর্নেল তাহের ও জাসদ নেতৃবৃন্দকে আসামি করে যে মামলায় কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয় সেই মামলায়ও তিনি অন্যতম আসামি ছিলেন।

 অপরদিকে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামে তিনি দৃঢ় ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৭৭-৭৮সনে ৮মাস বিনাবিচারে কারাগারে ছিলেন। সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমায়  শরীফ নুরুল আম্বিয়া ২০১০ সালে জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৬ সনের কাউন্সিলে গণতন্ত্র চর্চা ও প্রতিশ্রুত সংস্কারের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি আরোপের প্রেক্ষাপটে জাসদ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং শরীফ নুরুল আম্বিয়া বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। 

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন উদার গণতান্ত্রিক ও বামপন্থীদের জোট ১৪ দলকে বিদায় জানিয়েছেন সম্প্রতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া।  

দেশ পত্রিকাকে শরীফ নুরুল আম্বিয়া আরো বলেন, এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক কারণে পরিস্থিতি খারাপ আছে। দেশের অনেক কিছুই এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হয় না। একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে, সরকার নির্বাচনের বিষয়টা আলোচনায় সামনে নিয়ে এসেছে। তবে একটা বিষয় সরকার পরিষ্কার করে কিছু বলছে না যে, আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে? কীভাবে হবে তা পরিষ্কার করে জানানো হচ্ছে না। এব্যাপারে অন্যরা তাদের একের পর এক মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা মনে করি, জনগণের ভোটের অধিকারটা তাদের ফিরিয়ে দেয়া উচিত। এর পাশাপাশি সমস্ত রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে জনমত ও জনগণ যা চাচ্ছে, অর্থাৎ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেমন হবে সেব্যাপারটি তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করে ফেলা।  

দেশ: দেশে একটি সংবিধান রয়েছে। সেখানেই তো বলা হয়েছে, নির্বাচন কীভাবে হবে বা করতে হবে।

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। 

দেশ:আপনি কি মনে করে জনগণ এটা চায়? এটা জনদাবি?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: অবশ্যই এটা জনগণের দাবি। জনগণ এটা চায়। আপনি জনগণের সাথে কথা বলে দেখেন,তারা এভাবে দিনের ভোট আর রাতে দেয়ার নির্বাচন দেখতে চায় না।  

দেশ: বর্তমানে যে সংবিধানের অধীনে কি দেশে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব না?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: এসরকারের আমলে তো অনেকগুলো নির্বাচন হয়ে গেলো। এসব নির্বাচনে জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন হয়নি। এতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই পারেনি। ভোটই দিতে পারেনি। 

দেশ:বর্তমানে দেশে যে সংবিধান আছে এবং এতে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা আছে তা তো আপনি ১৪ এবং সরকারের সাথে থাকা অবস্থাতেই হয়েছে। আপনিও তো এর সাথে একমত ছিলেন। এখন দ্বিমতের কারণ কি?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: অবশ্যই এ প্রক্রিয়ার সাথে ছিলাম। আমরা সংবিধান সংশোধনকে সাপোর্ট করেছি,পক্ষে ছিলাম। আবার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিকে বলছি কিন্তু এটা পরিবর্তন করা উচিত।  বর্তমানে যা আছে তা পরিবর্তন করা উচিত এবং সর্বসম্মতিতে একটা পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমরা তো বলেছি ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন হয়েছে তার চেয়ে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হওয়া ব্যাটার ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনটা যেভাবে হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি বলি না আগের যে কেয়ারটেকার ব্যবস্থা ছিল তা ফিরে আসুক। আমি বলছি সবাই মিলে একসাথে সামনের দিকে আগানোর একটা প্রচেষ্টা থাকুক। আলোচনা করে একটা ব্যবস্থা নেয়া হোক। কেননা প্রত্যেকবারই দেশে একটা নির্বাচন করার পর তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০১৮ সালের নির্বাচনটা যেভাবে হয়েছে, তা যদি না হতো তাহলে তো এখন এব্যাপারে কোনো কথা উঠতো না। তাই জাতি বারবার এমন পরিস্থিতিতে যেন না পড়ে সেজন্য সব্বাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। 

দেশ: সেদিন সংবিধান এমন সংশোধনে সমর্থন দিয়ে কি ভুল করেছিলেন?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:আমরা সেদিন এব্যবস্থায় সমর্থন দিয়েছিলাম আমাদের তখনকার অভিজ্ঞতা থেকে। এখন সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই বলছি, আমরা সামনের দিকে এগোতে নতুনভাবে ভাবতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থা দিয়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। 

দেশ:আপনারা তো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে ছিলেন?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:আমরা ১৪দলে ছিলাম, এখন নেই। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪দল একটা অতীত। আগামী দিনে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ১৪ দলের সে রোল আর নেই। 

দেশ:এটা কি কেবল আপনি একাই বুঝলেন, বাকি শরিকরা কি বোঝে না? 

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: সেটা তাদের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিন...তারা বুঝছে, না বোঝে নাই তা আমি কি করে বলবো। 

দেশ:আপনি কি মনে করেন দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:অবশ্যই। রাজনৈতিক সংকটের দিকে উপনীত হচ্ছে।

দেশ: দেশে এমন রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার পেতে আপনার পরামর্শ কি?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠুভাবে হবে তা বসে ঠিক করা। কীভাবে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সরকার গঠন করা যায়, সে ব্যাপারেই দ্রুত আলাপ-আলোচনা করা।

দেশ: আপনি কি মনে করেন সরকারে এমন পরামর্শ শুনবে?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: যদি তারা এমন পরামর্শ না শোনেন তাহলে তার খেসারত দিতে হবে এবং এই খেসারতের শিকার দেশের জনগণও হবে। 

দেশ: দেশে জাতীয় সরকার নিয়ে একটি আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এব্যাপারে আপনাদের কোনো বক্তব্য আছে কি?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: জাতীয় সরকার নিয়ে জেএসডি সভাপতি আ স ম রব ভাই এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহেব প্রস্তাব দিয়েছেন। দুই প্রস্তাবের মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই। তবে এটা নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এব্যাপারটি আলোচনার টেবিলে আছে। আমি মনে করি, সরকারের এবিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা উচিত।  

দেশ: আপনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় সরকারের একজন শরিক। এখন ১৪ দল ত্যাগ করেছেন। বলছেন এতে থেকে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আসলে কি তাই? নাকি মন্ত্রিত্ব পাননি বলেই ১৪দল ত্যাগ করেছেন? কোনটা ঠিক?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:আসলে এটা আমাদের দলের রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত না। বলতে পারেন ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বা পরে আমাদের সাথে সুবিচার করা হয়নি। সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। সেটা নিয়ে আমাদের দলের ভেতরে ক্ষোভ আছে। সেটা কোনো বিষয় না। তবে এসব বিষয় দেখে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আসলে ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে যা ঘটে গেলো তাকে অকল্পনীয় বলা যায়। এটা আমাদের ধারণার বাইরে। এটা একটা জালিয়াতি। ভোটের আগের রাতের নির্বাচন। এনির্বাচন এবং এর ফলাফল কোনোটার সাথেই জনগণের সম্পর্ক নেই। আমাদের দলের ন্যাশনাল কমিটি থেকে একই কথা বলেছেন। আমাদের দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এমন নির্বাচনের পর ১৪দলের সাথে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততাকে সমর্থন করেনি। আমরা ১৪দলের সভাতেও এসব বিষয় তুলে ধরেছি। কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। 

দেশ: ১৪দলের সভাতেও এসব বিষয়ে প্রকাশ্যেই বলেছেন? এর জবাবে কি পেয়েছেন?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: হ্যাঁ বলেছি। তবে সে সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা মো. নাসিম ছিলেন ১৪দলের সমন্বয়ক। তিনি এধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক গ্রহণ করেছেন,শুনেছেন,আলোচনা করেছেন, তবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। ১৪দলের বৈঠকগুলি আসলে এভাবেই হয়। এরপর করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জুম বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকেও আলোচিত হয়েছে। তবে সব শেষ কথা হলো যে, এসব বৈঠকে আলাপ-আলোচনার মূলকথা ১৪দল সব কিছুতেই সরকারকে সহযোগিতা করা। এটা হলো আসলে সরকারের একধরনের চাটুকারিতা করা। 

দেশ: ১৪দলের যারা শরিক আছে, তারাসহ আপনারা কেন পারলেন না এই জোটকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে? ১৪ দলের শরিকে অনেক জাদরেল নেতা আছেন। তারা কি কথা বলেন না,তা পারেন না?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া:এটা আসলে একদলীয় জোট। একদলীয় সিদ্ধান্ত মতোই চলেছে। এক ব্যক্তির ব্যাপার। এক ব্যক্তি যেভাবে বলে, সেভাবেই চলবে ১৪দল। কারো কিছুই করার নেই এব্যাপারে। যারা এর সাথে সম্পৃক্ত আছে, তারা একদলীয় ব্যবস্থাকে কায়েম করতেই সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তারা তো কি করেছেন, দেখেছেন। যারা পারেন না, তারা পারছেন না, তাদের অবস্থান তো দেখছেনই।


শেয়ার করুন