০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:৩১:০৬ পূর্বাহ্ন


‘হায়ার অ্যাক্ট’ : ভারতীয় আইটি খাতে নতুন আশঙ্কার ছায়া
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৯-২০২৫
‘হায়ার অ্যাক্ট’ : ভারতীয় আইটি খাতে নতুন আশঙ্কার ছায়া যুক্তরাষ্ট্র সিনেট


যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সম্প্রতি প্রস্তাবিত ‘হ্যালটিং ইন্টারন্যাশনাল রিলোকেশন অব এমপ্লয়মেন্ট (হায়ার) অ্যাক্ট’ বিল ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য এক নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর রিপাবলিকান সিনেটর বার্নি মোরেনো এই বিলটি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবিত এ আইনের মূল লক্ষ্য হলো, বিদেশি কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালিত আউটসোর্সড সেবায় কর আরোপের মাধ্যমে দেশীয় কর্মসংস্থানকে উৎসাহিত করা। হায়ার অ্যাক্ট অনুযায়ী, যদি কোনো মার্কিন প্রতিষ্ঠান বিদেশি কোনো কোম্পানিকে সেবা প্রদান বাবদ অর্থ প্রদান করে এবং সে সেবা যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের জন্য হয়, তাহলে সে অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এ করকে ‘আবগারি কর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই আউটসোর্সিং খরচ আয়কর রিটার্নে করছাড় হিসেবে গণ্য করা যাবে না, অর্থাৎ এ খরচ করযোগ্য আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।

এ বিল কার্যকর হলে ভারতের আইটি খাত থেকে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো, টেক মহিন্দ্রার মতো শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্লায়েন্টদের জন্য কাজ করে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মার্কিন বাজার থেকেই ৬০ শতাংশের বেশি রাজস্ব আসে। ফলে এই বিল তাদের ব্যবসায়িক মডেলকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বিলটিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এমন কোনো কর্মীকে নিয়োগ দেয় যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ট্যাক্স রেসিডেন্ট’ নন এবং অন্তত তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেননি, তাহলে সে নিয়োগকেও বিদেশি আউটসোর্সিং হিসেবে গণ্য করে ২৫ শতাংশ কর আরোপ করা হবে। অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিকরা যদি যুক্তরাষ্ট্রে এইচ-১বি, এফ-১, জে-১, এইচ-২বি বা অন্যান্য ভিসায় থেকে কাজ করেন, তাহলেও এই কর প্রযোজ্য হতে পারে। এর ফলে শুধু ভারতীয় কোম্পানিই নয়, মার্কিন কোম্পানির ভারতে অবস্থিত গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টারসের ওপরও চাপ তৈরি হবে।

বিলটির পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, বহু বছর ধরে মার্কিন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সস্তা শ্রমের খোঁজে বিদেশে কাজ পাঠিয়ে দেশীয় কর্মসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সিনেটর বার্নি মোরেনো বলেন, ‘আমেরিকার কলেজ গ্র‍্যাজুয়েটরা যেখানে চাকরি পাচ্ছেন না, সেখানে করপোরেট কোম্পানিগুলো বিদেশে সস্তা মজুরির পেছনে ছুটে দেশীয় অর্থনীতি ধ্বংস করছে। এ দিনগুলোর অবসান ঘটাতে হবে।’ এ বক্তব্যে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ ধারা এবং জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক নীতির প্রতিফলন স্পষ্ট। ভারতের ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের আইটি খাত, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ, এই নতুন শুল্কের মুখোমুখি হলে বড় ধাক্কা খেতে পারে। এমনিতেই মার্কিন বাজারে মন্দার কারণে অনেক ভারতীয় কোম্পানির আয় প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। ক্লায়েন্টরা অনাবশ্যক খরচ কমিয়ে দিচ্ছে, যার ফলে ভারতের আইটি খাত ইতিমধ্যেই চাপে রয়েছে। তার ওপর যদি এই নতুন কর আরোপ করা হয় এটি স্টেট ও স্থানীয় কর মিলে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তাহলে মার্কিন বাজারে অনেক কোম্পানির টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

বিলটিতে বলা হয়েছে, এই নতুন কর থেকে যে রাজস্ব আসবে তা দিয়ে ‘ডোমেস্টিক ওয়ার্কফোর্স ফান্ড’ গঠন করা হবে। এ তহবিলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। তবুও বাস্তবে যদি দেশীয় কর্মী দক্ষ না হন, তাহলে আউটসোর্সিং বন্ধ করেও সমস্যার সমাধান হবে না। এছাড়া বিল অনুসারে প্রতিটি কোম্পানিকে তাদের আউটসোর্সিং সংক্রান্ত সব ধরনের লেনদেন সরকারের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। করপোরেট অফিসারদের এ তথ্যের সত্যতা শপথ করে নিশ্চিত করতে হবে। কর ফাঁকি দিলে থাকবে কঠোর শাস্তির বিধান। তবে এই কর নির্ধারণ, কর ফাঁকি প্রতিরোধ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা একটি জটিল কাজ হয়ে উঠতে পারে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ ও আইআরএসের জন্য।

বিশ্ববাণিজ্যের ওপরও এ বিলের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশ, যারা যুক্তরাষ্ট্রে আইটি সার্ভিস রফতানিতে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এর পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এককালীন ১ লাখ ডলারের এইচ-১বি ফি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে যুক্তরাষ্ট্র পরিস্কার করেছে, এ ফি শুধু নতুন আবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য এবং পুরোনো বা নবায়নের ক্ষেত্রে নয়। এ বিল পাস হোক বা না হোক, এটি এক স্পষ্ট বার্তা বহন করে যে আমেরিকা ক্রমশ আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। যদি এই প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে ভারতের মতো প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির জন্য তা সতর্ক সংকেত হয়ে দাঁড়াবে। এখনই সময়, ভারতীয় আইটি খাতকে মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প বাজার, পণ্য উদ্ভাবন এবং গুণগত দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ব্যবসার নতুন পথ তৈরি করতে পারলে এই সংকটকেও পরিণত করা যেতে পারে নতুন এক সম্ভাবনায়। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘কর নীতি’র দীর্ঘ ছায়া ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ওপর কালো মেঘ হয়ে নেমে আসতে পারে।

শেয়ার করুন