২৫ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০৯:৫৯:০৫ অপরাহ্ন


গুম খুনের বিচার নিশ্চিতের আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টাকে ৬ আন্তর্জাতিক সংগঠনের চিঠি
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১০-২০২৫
প্রধান উপদেষ্টাকে ৬ আন্তর্জাতিক সংগঠনের চিঠি


বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।

বাংলাদেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে। গুম-খুনের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ), বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজের অধিকার রক্ষায় কাজ করা দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সংস্থা সিভিকাস, রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা থাইল্যান্ডভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফোরটিফাই রাইটস, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট এ চিঠিটি দিয়েছে।

রোববার এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে ওই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে মানবাধিকার সংক্রান্ত নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে যৌথ এই চিঠিটি দেওয়া হয়েছে।

চিঠিটির অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

‘প্রিয় প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস,

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মৌলিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার, আইন সংস্কার শুরু করা এবং গুমসহ অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।

২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে সীমিত সময়ের এই পরিসরে আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি মানবাধিকার সুরক্ষাকে আরো প্রসারিত করতে এবং এমন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, যা স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক অধোগতি রোধ করবে। আমরা উদ্বিগ্ন যে নিরাপত্তা খাত এখনো মূলত সংস্কারবিহীন রয়ে গেছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য এখনো দায়মুক্তি ভোগ করছে ও জবাবদিহির প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে না। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারে সরকারকে আরো পদক্ষেপ নিতে হবে, তবে একইসঙ্গে এখনো চলমান নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক কার্যক্রম, বিশেষত আওয়ামী লীগ সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রমাণবিহীন মামলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে আপনি বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনই সংকটের একমাত্র সমাধান এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে নতুন আগত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের সুযোগ দিতে হবে। রোহিঙ্গারা সব সময় তাদের মাতৃভূমি মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষদিক থেকে আগত ১ লাখ ৫০ হাজারসহ সব রোহিঙ্গার জন্য মায়ানমারের কোনো অংশই এখনো নিরাপদ নয়, যা স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনকে অসম্ভব করে তুলেছে।

আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি নিচের পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে, যাতে বাংলাদেশের সবার অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়-গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করুন।

জুলাই বিপ্লব ও গত ১৫ বছরে সংঘটিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের ঘটনায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনুন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ইতোমধ্যে র‌্যাব ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিযোগ ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে- যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সামরিক বাহিনীকে এসব বিচার কার্যক্রমে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং আইসিটির এখতিয়ার মেনে চলতে হবে। আমরা অনুরোধ করছি, আইসিটি যেন আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং সব রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বিবেচনা নির্বিশেষে ন্যায্য বিচার সম্পন্ন করতে পারে। আইসিটির অধীন থাকা মামলাসহ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারকে অবিলম্বে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করা উচিত।

নিরাপত্তা খাত সংস্কার করুন

র‌্যাব বিলুপ্ত করা এবং ডিজিএফআইয়ের ক্ষমতা সীমিত করা অপরিহার্য। র‌্যাবের দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস প্রতিষ্ঠানটিকে সংস্কারের বাইরে নিয়ে গেছে। সামরিক সদস্যদের বেসামরিক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থেকে সরিয়ে নিন। ডিজিএফআইয়ের ক্ষমতা ও ভূমিকা শুধু সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমে সীমিত করতে হবে এবং একটি স্পষ্ট আইনগত কাঠামোর আওতায় আনুন।

গুম অপরাধ হিসেবে দণ্ডনীয় করুন এবং অনুসন্ধান কমিশনের কার্যক্রম নিশ্চিত করুন

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ’-এর খসড়া অবিলম্বে অনুমোদন করুন, তবে মৃত্যুদন্ড সংক্রান্ত ধারা বাদ দেওয়া উচিত। ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস’ গ্রহণ করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সংস্কার করুন

প্যারিস নীতিমালা অনুযায়ী কমিশনের স্বাধীনতা, অর্থায়ন এবং সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার করতে হবে। কমিশনকে নিরাপত্তা বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী আইনসমূহ বাতিল বা সংশোধন করুন।

সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৫, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং মানহানির ফৌজদারি বিধানসমূহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে সংশোধন করতে হবে। ২০২৩ সালের আইন বাতিলের পর প্রণীত সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৫ এখনো অস্পষ্ট ও ব্যাপক ক্ষমতা দেয়- যা অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে।

তথ্য সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার আইন সংশোধন করুন

‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ ও ‘জাতীয় তথ্য ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ খসড়ায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত ছাড় বা ক্ষমতা সীমিত করতে হবে। এসব খসড়াকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশোধন এবং নাগরিক সমাজের পরামর্শে চূড়ান্ত করতে হবে।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করুন

রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে সাংবাদিকদের গ্রেফতার, হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রমাণবিহীন বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থি, সেগুলো বাতিল করতে হবে। মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের আন্তর্জাতিক মানসম্মত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

নির্বিচার গ্রেফতার ও রাজনৈতিক মামলা বাতিল করুন

আগস্ট ২০২৪-এর আগে ও পরে দায়েরকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা- যে দল বা মতেরই হোক বাতিল করতে হবে। বিশেষত আওয়ামী লীগ সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রমাণবিহীন অভিযোগ দ্রুত খারিজ করতে হবে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুন।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে আরোপিত দলীয় নিষেধাজ্ঞা মতপ্রকাশ, সংগঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করছে। জাতিসংঘের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, সরকার যেন ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এমন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ থেকে বিরত থাকে।’

নাগরিক সমাজ ও এনজিওদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করুন

এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো এবং বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) নিয়ন্ত্রণ আইন সংস্কার করতে হবে। নাগরিক সমাজের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ, আন্তর্জাতিক তহবিলে প্রবেশাধিকার, ও প্রশাসনিক বাধা কমাতে হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন থেকে রক্ষা করুন

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পূর্বে কোনো জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন করা যাবে না। ক্যাম্পে চলাচল, জীবিকা ও শিক্ষার সুযোগে আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিল করতে হবে। সাহায্য হ্রাসের প্রেক্ষাপটে এসব সুযোগ রোহিঙ্গাদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করুন

বাংলাদেশ-মায়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আইসিসির চলমান তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং আদালতের চাহিদা অনুযায়ী অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে।

বিনীত,

সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ফোরটিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট।”

শেয়ার করুন