ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৯ নভেম্বর রোববার তার প্রশাসনের অন্যতম আলোচিত অর্থনৈতিক নীতি ট্যারিফ ঘিরে নতুন এক প্রস্তাব আমেরিকানদের সামনে এনেছেন। তিনি ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ট্যারিফ থেকে অর্জিত রাজস্ব দিয়েই ২ হাজার ডলার করে ডিভিডেন্ড বা অর্থসহায়তা প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, ট্যারিফ থেকে অর্জিত রাজস্ব থেকে এই ডিভিডেন্ডের অর্থায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের। ট্রাম্পের দাবি, তার আরোপিত ট্যারিফ নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন রাজস্ব এনে দিয়েছে এবং এর ফলে দেশে উৎপাদন খাতে রেকর্ড বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কীভাবে এই ডিভিডেন্ড বিতরণ করা হবে সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কোনো কাঠামো উপস্থাপন করেননি। ট্যারিফ-ভিত্তিক রিবেট বা আর্থিক পুনর্বণ্টনের ধারণাটি নতুন নয়। এর আগে চলতি বছরের জুলাই মাসেও ট্রাম্প প্রশাসন একই ধরনের প্রস্তাব দেয়, যেখানে বলা হয়েছিল সরকার ট্যারিফ থেকে প্রাপ্ত বিলিয়ন ডলার রাজস্বের একটি অংশ সাধারণ জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও নীতি-পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আইনি, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা বাধার মুখোমুখি হতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে পূর্বে বিতরণ করা আর্থিক প্রণোদনা বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ের স্টিমুলাস চেক বিতরণ কর আইনের মাধ্যমে পাস করা হয়েছিল। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া ট্রেজারি বিভাগ সাধারণ নাগরিকের মাঝে চেক বিতরণ করতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে রিপাবলিকানদের প্রণীত ‘বিগ বিউটিফুল’ কর ও ব্যয় সংক্রান্ত আইনটিতে জনগণের কাছে কোনো নগদ রিবেট প্রদানের ধারা রাখা হয়নি। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের সরাসরি নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে এই অর্থ বিতরণ করা সম্ভব কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।
এদিকে ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। বিশেষ করে ১৯৭৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল ইমারজেন্সি ইকনমিক পাওয়ারস অ্যাক্ট (আইইইপিএ)-এর আওতায় ব্যাপক আমদানি শুল্ক আরোপের বৈধতা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলেছে। যদি সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে এসব ট্যারিফ আরোপ অবৈধ, তাহলে ব্যবসায়ীরা সরকারি কোষাগারে পরিশোধ করা অর্থ ফেরত পাওয়ার অধিকারী হবেন। এর ফলে ট্যারিফ রাজস্বের উল্লেখযোগ্য অংশই সরকারের হাতে থাকবে না। রায়টি সরাসরি ট্রাম্পের ডিভিডেন্ড পরিকল্পনাকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক আয় ১ লাখ ডলারের নিচে এমন প্রায় ১৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে ২ হাজার ডলার করে দিতে হলে সরকারের প্রয়োজন হবে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন ট্যারিফ থেকে সরকারি আয় মাত্র ১২০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০২৪ অর্থবছর শেষে মার্কিন ট্রেজারির তথ্যমতে, কাস্টমস ডিউটি থেকে অর্জিত রাজস্ব মাত্র ১৯৫ বিলিয়ন ডলার। ফলে আয় ও ব্যয়ের বিশাল এই ব্যবধান পূরণ করা অর্থনৈতিকভাবে কঠিন হবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।
মহামারির সময় প্রণোদনা চেক বিতরণের ফলে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তা এখনো অর্থনীতিবিদদের স্মৃতিতে সতেজ। সেই সময় শুধু আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু পণ্য ও সেবার সরবরাহ বাড়েনি। এই চাহিদা-উদ্দীপিত মূল্যবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে ৪০ বছরের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির পর্যায়ে নিয়ে যায়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই নতুন ডিভিডেন্ড নীতি অর্থনৈতিকভাবে সেই একই ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এছাড়া ট্যারিফ নিজেই মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পণ্য ও উপাদানের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের কিছু অংশ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বাজারে দাম বাড়ছে, সরবরাহ চেইনে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। এরিকা ইয়র্ক বলেন, প্রস্তাবিত এই ট্যারিফ ডিভিডেন্ড মুদ্রাস্ফীতি ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে-যদিও এর মাত্রা মহামারিকালীন পরিস্থিতির মতো নাও হতে পারে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ডিভিডেন্ড বিতরণের পরও অতিরিক্ত অর্থ থেকে যাবে, যা দিয়ে তিনি জাতীয় ঋণ কমাবেন। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান ঋণের পরিমাণ ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি; সেখানে ১০০ বা ২০০ বিলিয়ন ডলার অত্যন্ত অপ্রতুল। তাছাড়া প্রস্তাব বাস্তবায়নে দেশকে নতুনভাবে ধার নিতে হবে, যা ঋণের বোঝা আরও বাড়াবে।অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে যা ভাবছেন তা হলো-১) কংগ্রেস ছাড়া এটি সম্ভব নয়, ২) ট্যারিফ রাজস্ব যথেষ্ট নয়, ৩) এর মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে, ৪) ব্যবসা বিনিয়োগ ব্যাহত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে।
সার্বিকভাবে, ট্রাম্পের প্রস্তাবটি ভোট–মনস্তত্ত্বের রাজনীতি বা পপুলিস্ট অর্থনীতি হিসেবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ২০২৬ নির্বাচনের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক চাপ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে সাধারণ জনগণের হাতে বাড়তি অর্থ তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় শোনায়। তবে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, আইনি কাঠামো ও বাজেট ভারসাম্যের প্রশ্নে এটি গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন এখন একটাই-সুপ্রিম কোর্টের রায়, কংগ্রেসের অনুমতি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা-এই তিনের ছেদবিন্দুতে ট্রাম্পের ডিভিডেন্ড পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেবে?