০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:৩৩:১৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যায় আ’লীগ জড়িত, হাসিনার গ্রিন সিগন্যাল
বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড়
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১২-২০২৫
বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় প্রধান উপদেষ্টার কাছে রিপোর্ট হস্তান্তর করা হচ্ছে


বাংলাদেশে বহুল অলোচিত পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে বাংলাদেশের চৌকষ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দলগতভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা পেয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। ঢাকার পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ -বিজিবি) সদর দপ্তরে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১১ মাস ধরে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে এই কমিশন। 

তারা বলছে, এ ঘটনার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল। এ ছাড়া এই ঘটনায় সীমান্তবর্তী দেশ ভারতেরও সম্পৃক্ততা পেয়েছে কমিশন। তদন্ত কমিশনের এমন রিপোর্ট সারসংক্ষেপের খবরে তোলপাড়। দেশের সর্বত্র এ রিপোর্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। মানুষ ভুলে যাওয়া সে ঘটনা করে মনে করে শিহরিত হচ্ছেন। এমন রিপোর্টের পর অভিযুক্তদের কিভাবে বিচারের আওতায় এনে সঠিক বিচারকার্য হবে সেটা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। 

জানা গেছে, ‎২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের তদন্তে মোট ৬০০ ঘণ্টা ভিডিও রেকর্ডিং, ভিডিও রেকর্ডিং রিভিউ ও অডিও ট্রান্সক্রিপশন সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ৮০০টি স্থিরচিত্র ও ছবি নিয়ে বিডিআর বিদ্রোহ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে কমিশন।

আ ল ম ফজলুর রহমান ‎‎বলেন, আমরা তদন্তের জন্য বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রচারিত সংবাদ নিয়েছি ২১৫টি, সরকারি ও বেসরকারি মোট ২৭টি প্রতিষ্ঠানের সাথে পত্রালাপ করা হয়েছে। পত্রালাপের মধ্যে ৯০৫টি এবং প্রতিমাসে ৮১টি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ৬টি তদন্ত আদালতের প্রতিবেদন সেনাবাহিনীকে ফেরত দেয়া হয়েছে। জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেরত দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন বিডিআর পরিচালিত ৫২টি তদন্ত প্রতিবেদন বিজিবিতে ফেরত দেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইট/ ইমেইল /জবানবন্দি ভিডিও ক্লিপ এর মাধ্যমে ৩১৬টি বিভিন্ন তথ্য আমরা পর্যালোচনা করেছি।

‎‎তিনি বলেন, ‘আজ (গত ৩০ নভেম্বর রোববার) সন্ধ্যায় আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। ১১ মাস পর আমরা ২৮০ পৃষ্ঠার এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমরা তদন্তের জন্য শতশত চিঠি লিখেছি বিভিন্ন কোম্পানী ও সংস্থার কাছে। বিভিন্ন বিদেশী নম্বর থেকে যে নাম্বারগুলোতে কথা হয়েছে। সেসব কোম্পানীর কাছে আমরা চিঠি দিয়েও কোন সহায়তা পাইনি। আমরা মোবাইল কোম্পানীগুলোকে চিঠি দেওয়ার কয়েকমাস পর তারা রিপ্লাই দিয়ে বলেছে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই।

‎তিনি আরও বলেন, ২৮০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে আমরা ২৪৭ জনের সাক্ষী নিয়েছি। এদের মধ্যে শহীদ পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দী ১৪ জন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ১০ জন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ২ জন, সামরিক কর্মকর্তা ১৩০ জন, অসামরিক কর্মকর্তা ৪ জন, পুলিশ কর্মকর্তা ২২ জন, বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ৯ জন, সাবেক ও বর্তমান বিডিআর /বিজিপি সদস্য ২২ জন, কারাগারে আছেন ২৬ জন ও সাংবাদিক ৩ জন। এর মধ্যে আমরা ৬০০ ঘণ্টা ভিডিও সাক্ষাৎকার ও রেকর্ডিং রিভিউ করেছি।

প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা 

তদন্ত কমিশন গত রোববার (৩০ নভেম্বর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এ সময় সেখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ ও স্বরাষ্ট্রসচিব নাসিমুল গনি উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিবেদনের বিষয়ে গণমাধ্যমে জানায়। 

এসময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে ছিলো। আপনারা সত্য উদ্‌ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন জাতি তা স্মরণে রাখবে। জাতির পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

তিনি বলেন, ইতিহাসের এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে জাতির অনেক প্রশ্ন ছিলো, এই কাজের মধ্য দিয়ে সেসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনে শিক্ষণীয় বহু বিষয় এসেছে। জাতির জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে এটি।

প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে তদন্ত কমিশন। কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।

কমিশনের সভাপতি বলেন, সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিডিআর সদস্যদের মধ্যেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ছিল বলেও কমিশনপ্রধান জানান।

পিলখানায় সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ চৌকষ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। সব মিলিয়ে তখন পিলখানায় নিহত হন ৭৪ জন। সেদিন পিলখানায় থাকা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও নৃশংসতার শিকার হন। 

তদন্ত কমিশন প্রধান যা বললেন

অন্তর্বর্তী সরকারর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমশন প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান এ সময় বলেন, এ ঘটনার আদ্যোপান্ত তাঁরা বের করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের তদন্তে উঠে এসেছে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত, কারা আলামত নষ্ট করেছে, এর স্বরূপ কী, কেন এটা হলো, কারা দায়ী, কীভাবে প্রতিরোধ করা যেত অথবা প্রতিরোধ করা যেত কি যেত না। তিনি বলেন, তদন্তে এটাও উঠে এসেছে কেন সেনাবাহিনী সামরিক পদক্ষেপ নিল না, কেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলো এবং কীভাবে ষড়যন্ত্র দানা বেঁধেছিল? পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের তথ্যও বের হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম জানান। তাঁরা হলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিদেশে পলাতক শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাবেক (বর্তমানে মৃত) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন।

এর বাইরে শেখ হাসিনার সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর। 

দলগত ভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত প্রধান সমন্বয়কারী তাপস 

কমিশনের প্রধান ফজলুর রহমান বলেন, তদন্তকাজ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ত্রুটিমুক্ত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব বজায় রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন ১৬ বছর আগের এই ঘটনার বহু আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। আমরা দুটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি। সাক্ষীদের ডাকলাম, কারও কারও আট ঘণ্টা পর্যন্ত বক্তব্য শুনেছি। যতক্ষণ তিনি বলতে চেয়েছেন। যাঁরা তদন্তে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের তদন্তের রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি, অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ করেছি।’

ফজলুর রহমান বলেন, তদন্তে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রোববার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সেখানে কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেছেন, এই ঘটনার কিছু বাহ্যিক ও প্রকৃত কারণ বের করেছে কমিশন। এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত এবং এর পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। তারা ২০-২৫ জনের একটি মিছিল নিয়ে পিলখানায় ঢুকেছে এবং বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে দুই শতাধিক মানুষ ছিল।

পরে তদন্ত কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয় মিছিলকারী এই ব্যক্তিরা কারা ছিলেন? জবাবে কমিশনপ্রধান ফজলুর রহমান বলেন, ‘এরা ছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। এরা যে সংখ্যক ঢুকেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক বের হয়েছিল। আমাদের ধারণা, এদের সঙ্গে অনেক কিলারও (হত্যাকারী) বের হয়ে গেছে।’

হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের নেতারা কীভাবে সমন্বয় করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনপ্রধান বলেন, ‘এটা এক দিনে হয়নি, দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে। যেমন তাপস মসজিদে বসে মিটিং করেছে। বিভিন্ন ট্রেনিং গ্রাউন্ডে বসে মিটিং হয়েছে। একটা দীর্ঘ সময় ধরে ষড়যন্ত্রগুলো হয়েছে। সর্বশেষে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ডটা হয়েছে।’

শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেছেন, পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল। তিনি এ ঘটনার দায় নিরূপণের ক্ষেত্রে বলেন, দায় তৎকালীন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধানেরও। এ ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুলিশ, র‍্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও রয়েছে চরম ব্যর্থতা।

জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার আরও বলেন, ওই ঘটনার সময় কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল অপেশাদার। ওই হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন) যেসব বিডিআর সদস্যের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন, তাঁদের সঠিক নাম-পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি।

ভারতের সম্পৃক্ততা

সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতা থেকে লাভবান হয়েছে।

কেন এই ঘটনা ঘটল, সে প্রসঙ্গ টেনে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সভাপতি আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, ‘ওই সময়কার সরকার তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল এবং সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে দুর্বল করতে চেয়েছিল।’

কমিশনের সুপারিশ 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করে, যাতে করে ভবিষ্যতে বাহিনীগুলোয় এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায় এবং এ ঘটনার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পান।

কমিশনের সদস্যের সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে ছিল। আপনারা সত্য উদঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন, জাতি তা স্মরণে রাখবে। জাতির পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইতিহাসের এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে জাতির অনেক প্রশ্ন ছিল, এই কাজের মধ্য দিয়ে সেসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে। এই প্রতিবেদনে শিক্ষণীয় বহু বিষয় এসেছে। জাতির জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে এটি।

মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের সদস্যরা হলেন মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. সাইদুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি এম আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তদন্তে দেখা গেছে, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তৎকালীন সেনাপ্রধান সদর দপ্তর ছেড়ে চলে যাওয়ায় সময়মতো সেনা অভিযান পরিচালনা করা হয়নি, যা হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করেছিল। ভুক্তভোগী সেনা কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, সেই লক্ষ্যে প্রশাসন ও বাহিনীর সংস্কারের জন্য বিস্তৃত সুপারিশ সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে।

পরিবারের সদস্যরা যা বলছেন

বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ১ ডিসেম্বর সোমবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে জড়িত কেউ যেন বিচার থেকে রেহাই না পায়, সে বিষয়ে সরকারের কঠোর ভূমিকা কামনা করেছেন তারা। নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা উল্লেখ করে শহীদ পরিবারগুলো নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও দাবি জানিয়েছেন। 

বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কর্নেল কুদরত এলাহী রহমান সিদ্দিকের ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটা মামলা করেছিলাম। এখন তদন্তে যাদের নাম এসেছে তাদের যেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর প্রসিকিউট করেন। সেটা করার পরপরই প্রতিবেদন যেন প্রকাশ করা হয়। কারণ আমরা জানি এখানে সামরিক বাহিনীর অনেক কর্মকতার নাম আছে। সেই কারণে সবার নাম প্রকাশ করা হয়নি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই তদন্ত কমিশনের এখতিয়ার হলো মামলাটি যে পর্যন্ত হয়েছে তার বাইরে। ফলে হত্যা মামলায় যাদের দণ্ড হয়েছে যেটা নিয়ে নতুন করে কিছু করার সুযোগ নেই। কারণ তাদের অপরাধ প্রমাণিত, সেটা সেভাবেই থাকবে।’

‘তবে ৯ হাজারের মতো বিডিআর সদস্যের অভ্যন্তরীণ বিচারে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছে। তারা সাজা খেটে বের হয়ে গেছে। তারা এখন ক্ষতিপূরণ চাইছে। সেটা তো আমাদের কাছে চায় না। সরকারের কাছে চায়। সরকার দিলে দেবে। আর বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮০০ জনকে আটক রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তাদের বিচারই শুরু হয়নি। তাদের মধ্যে ৩৫০ জনের মতো জামিন পেয়েছে গত বছরের ৫ আগস্টের পর। তারা জামিন পেতেই পারে। কিন্তু হত্যা মামলার ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না,’ বলেন তিনি।

বিডিআর কল্যাণ পরিষদের সভাপতির বক্তব্য

বিডিআর বিদ্রোহে চাকরিচ্যুত এবং সাজাপ্রাপ্তদের সংগঠন বিডিআর কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মো. ফয়জুল আলম বলেন, ‘তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে, বিডিআর সদস্যরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত না। এরসঙ্গে জড়িত শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের নেতারা আর ভারত। তাই ফাঁসি, যাবজ্জীবন থেকে বিভিন্ন মেয়াদে যারা দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন তাদের মুক্তি দিতে হবে। তারা তো দায়ী নয়, তাদের ওপর দায় চাপানো হয়েছে।’

‘এর বাইরে ১৮ হাজার ৫১৯ জন বিডিআর সদস্যকে বিডিআরের অভ্যন্তরীণ বিচারে চাকরিচ্যুত করা হয়েছেন এবং শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর বিস্ফোরক মামলায় এখনো যারা আটক আছেন তাদের জামিন দিতে হবে। তাদের মধ্যে তিনশ’র কিছু বেশি গত বছরের ৫ আগস্টের পর জামিন পেয়েছেন,’ বলেন তিনি। ফয়জুল আলম নিজেও সাত বছর কারাভোগ করে মুক্ত হয়েছেন। এই দাবিতে সোমবার বিকেলে তারা সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও বিচার

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিজিবির (তখনকার বিডিআর) বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়ে একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা। 

পরে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একই সঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। 

এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখে হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দুইজন আসামির মৃত্যু হয় এবং ১২ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মামলায় এত বেশিসংখ্যক আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় আর কখনো হয়নি। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সবাই সাবেক বিডিআরের সদস্য। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশ রাইফেলস-এর (বিডিআর) নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়।

এই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা আরেকটি মামলার এখনো বিচার শুরু হয়নি। ওই মামলায় কমবেশি ৮৩৫ জন বিডিআর সদস্য কারাগারে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাড়ে তিনশ’র মতো জামিন পেয়েছেন। আর বিডিআরের অভ্যন্তরীণ বিচারে কয়েক হাজার বিডিআর সদস্যকে চাকরিচ্যুত এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া তাহলে কী 

ডয়চে ভেলে জানায়, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বিডিআর হত্যা মামলাটি এখন আপিল আদালতে আছে। বিচারিক আদালতের রায়ে অনেকেরই মৃত্যুদন্ডের আদেশ হয়েছে। এখন একই ঘটনায় যেমন দুটি মামলা চলতে পারে না, তেমনি এখন যে বিচার সর্বোচ্চ আদালতে চলছে সেটাতো বন্ধ করা যাবে না। ফলে আপনি যদি বলেন আবার মামলা করে নতুনদের সেখানে আসামি করতে হবে তাহলেতো আগের মামলা বাতিল করতে হবে। যারা দন্ডিত হয়েছে তাদের দন্ড বাদ হয়ে যাবে। এটাতো আইনে নেই। তবে যদি রিকল করা হয়, আদালত যদি মনে করেন তাতে যুক্তি আছে তাহলে নতুন করে আবার তদন্ত শুরু হতে পারে। তাতেও আগের দণ্ড স্থগিত হয়ে যাবো।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘এই তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের কোনো আইনগত মূল্য নেই। আবার তদন্ত করতে হলে পুলিশ বা পুলিশের যে সব সংস্থার তদন্তের এখতিয়ার আছে তারাই তদন্ত করতে পারবে। ওই তদন্তে কমিশনের তদন্ত সহায়ক হতে পারে।’

‘আর এই কমিশন গঠন করার সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয়েছিল যে, যেটার বিচার হয়ে গেছে সেটা নিয়ে যেন আর কিছু করা না হয়। এখন সমস্যা হলো যাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে তাদের কি আপনি ছেড়ে দিয়ে আবার তদন্ত করবেন? তাহলে যে সেনা কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা কি সেটা মানবেন?’

শেয়ার করুন