০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩৮:৫৩ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১২-২০২৫
দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের মার-আ-লাগো রেসিডেন্স থেকে থ্যাংকসগিভিং উপলক্ষে সেনাসদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় হাতে একটি প্রিন্টেড ছবি তুলে ধরে দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প


হোয়াইট হাউসের মাত্র কয়েক ব্লক দূরে দুই ন্যাশনাল গার্ড সদস্যের ওপর ঘটে যাওয়া হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অভিবাসন নীতি নিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ২৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, হামলায় গুরুতর আহত হওয়া দুই সৈন্যের একজন ২০ বছর বয়সী স্পেশালিস্ট সারাহ বেকস্ট্রম অবশেষে মারা গেছেন। অন্য সদস্য স্টাফ সার্জেন্ট অ্যান্ড্রু উলফ (২৪) আশঙ্কাজনক অবস্থায় লড়াই করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে একজন আফগান নাগরিক, যিনি আফগানিস্তানে সিআইএর হয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি তাকে এক বর্বর দানব বলে আখ্যা দিয়েছেন। থ্যাংকসগিভিং উপলক্ষে বিদেশে অবস্থানকারী মার্কিন সেনাদের উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিফোন বার্তায় ট্রাম্প বলেন, তিনি সামরিক কর্তৃপক্ষ থেকে বেকস্ট্রমের মৃত্যুসংবাদ মাত্রই পেয়েছেন এবং অপর সৈন্যের জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক এই হামলার ঘটনা ইতিমধ্যেই অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরো তীব্র করে তুলেছে, আর এ পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে, তিনি দারিদ্র‍্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে চান এবং একই সঙ্গে দেশটিতে বসবাসরত লক্ষাধিক বৈধ অভিবাসীর আইনি অবস্থান প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছেন।

‘রিভার্স মাইগ্রেশন’-ট্রাম্পের নতুন স্লোগান

২৬ নভেম্বর হামলার পর নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যাল-এ ব্যাপক সমালোচনামূলক বার্তা দেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি অভিবাসীদের ওপর আমেরিকার অপরাধপ্রবণতা থেকে শুরু করে আবাসন সংকট পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার দায় চাপান। তিনি বলেন, শুধু রিভার্স মাইগ্রেশন অর্থাৎ অভিবাসীদের দেশত্যাগই-আমেরিকার এই পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলাতে সক্ষম। তার বক্তব্যে আরো বলা হয়, ধন্যবাদজ্ঞাপনের দিনে সবাইকে শুভেচ্ছা। তবে যারা আমেরিকাকে ঘৃণা করে, চুরি করে, হত্যা করে এবং আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করে; তাদের এখানে আর বেশিদিন থাকতে দেওয়া হবে না। গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো এ বছরের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে সবচেয়ে কঠোর।

হামলার সূত্রপাত ও সন্দেহভাজনকে ঘিরে তদন্ত

ডিসির কেন্দ্রস্থলে টহলরত দুজন ন্যাশনাল গার্ড সদস্যের ওপর বুধবার যে হামলা ঘটে, তা ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশে রাজধানীসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের অংশ। তদন্তের সূত্রে জানা গেছে, ২৯ বছর বয়সী রহমানুল্লাহ লাখানওয়াল নামের এক আফগান নাগরিক ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। লাখানওয়াল আফগানিস্তানে প্রায় ১০ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন এবং মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর ‘অপারেশন অ্যালাইজ ওয়েলকাম’ কর্মসূচির আওতায় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়। হামলার পর তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনিও গুলিবিদ্ধ হন, তবে তার আঘাত প্রাণঘাতী নয়।

লাখানওয়ালের পরিবারের এক সদস্য জানান, তিনি ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের বেলিংহামে স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করছিলেন। পরিবারের সদস্যের ভাষ্য, আমরা নিজেরাই আফগানিস্তানে তালেবানের টার্গেট ছিলাম। সে এমন কাজ করতে পারে-এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সিআইএ-এর এক মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন যে, লাখানওয়াল কন্দহারের একটি অংশীদার বাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কাজ করতেন যা ২০২১ সালে শেষ হয়। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা ট্রাম্পকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সে পাগল হয়ে গেছে। এমনটা ঘটে-দুঃখজনকভাবে অনেকবারই ঘটে।

অভিবাসীদের দোষারোপ-প্রশাসনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া

হামলার ঘটনার পর থেকেই প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা অভিবাসন নীতি পুনর্বিবেচনার কথা জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছেন। ইউএসসিআইএস-এর পরিচালক জোসেফ এডলো জানিয়েছেন যে, তারা ১৯টি ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশের নাগরিকদের অতিরিক্ত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াকে আরো কঠোর করবেন। এর মধ্যে আফগানিস্তান, সোমালিয়া, ইরান, হাইতি ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশও রয়েছে।অন্যদিকে মার্কিন বিচার বিভাগ জানিয়েছে, লাখানওয়ালের অভিবাসন ইতিহাস এবং তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি কীভাবে দেওয়া হয়েছিল-তা আবারও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ন্যাশনাল কাউন্টারটেররিজম সেন্টারের পরিচালক জো কেন্ট দাবি করেন যে, বাইডেন প্রশাসন আগের মতো কঠোর যাচাই ছাড়া ৮৫ হাজারেরও বেশি আফগানকে যুক্তরাষ্ট্রে এনেছিল। যদিও হোয়াইট হাউস জবাবে জানিয়েছে, অপারেশন অ্যালাইজ ওয়েলকামের আওতায় আসা প্রত্যেক অভিবাসীকে বায়োমেট্রিক ও বায়োগ্রাফিক নিরাপত্তা যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এবং লাখানওয়ালের আশ্রয় প্রক্রিয়া ট্রাম্প প্রশাসন পর্যন্ত চলমান ছিল।

অভিবাসনবিরোধী অবস্থান অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি?

ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন কমানোর নীতি অনুসরণ করছে দীর্ঘদিন ধরে। তার আগের মেয়াদেও নির্মাণশিল্প থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নানা জায়গায় অভিবাসনবিরোধী অভিযান চালানো হয়, যা লক্ষাধিক পরিবারকে আতঙ্কে ফেলেছিল। শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৫ কোটি বিদেশে জন্মগ্রহণকারী মানুষ বাস করেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ১০ লাখ শ্রমবাজারে সক্রিয়। নির্মাণশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিকাজ, স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রযুক্তিগত খাতে বিদেশি শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ব্যাপক-যা হঠাৎ করে কমিয়ে দিলে শ্রমবাজারে সংকট দেখা দিতে পারে।

আর অপরাধপ্রবণতার ক্ষেত্রে অভিবাসীরা বড় উৎস-ট্রাম্পের এই দাবি বহু গবেষণায় খণ্ডিত হয়েছে। অ্যানুয়াল রিভিউ অব ক্রিমিনোলজির এক পর্যালোচনায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে অভিবাসী জনসংখ্যা বেশি হলেও অপরাধের হার সমানুপাতে বাড়ে না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম থাকে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী নাগরিকদের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম হারে কারাগারে যান। গবেষকেরা উল্লেখ করেন, গত ১৫০ বছর ধরেই এই প্রবণতা একই রকম রয়েছে।

ট্রাম্পের নতুন হুমকি : আইনি অবস্থান বাতিল, ডিন্যাচারালাইজেশন ও গণনির্বাসন

তার সাম্প্রতিক পোস্টে ট্রাম্প শুধু অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধই নয়, বরং দেশে অবস্থানকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের আইনি স্ট্যাটাস প্রত্যাহারের কথাও জানান। তিনি বলেন, তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের সময় যেসব মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে, তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন আবেদন তিনি বাতিল করতে চান।এছাড়া তিনি ঘোষণা করেন, অনাগরিকদের জন্য কোনো ফেডারেল সুবিধা বা অর্থসাহায্য বন্ধ করা হবে, সামাজিক শান্তি নষ্টকারী ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে এবং পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে অসঙ্গত বিদেশি নাগরিকদের বহিষ্কার করা হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের ওপর এ ধরনের নীতি প্রয়োগ হলে তা দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপক বহিষ্কার অভিযান হিসেবে গণ্য হবে।

ট্রাম্প তার সাম্প্রতিক বার্তায় মিনেসোটার সোমালি অভিবাসীদেরও লক্ষ্য করে বলেন যে, তারা একসময়কার মহান রাজ্যটিকে দখল করে নিচ্ছে। তিনি রাজ্যের গভর্নর টিম ওয়াল্জকে উদ্দেশ করে মানহানিকর শব্দ ব্যবহার করেন। তার এই মন্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।

হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া এবং প্রশাসনের পরবর্তী নির্দেশনা

হোয়াইট হাউস এই পোস্টকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বলে আখ্যা দিলেও বিপুল সংখ্যক বিশ্লেষক মনে করছেন এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।এদিকে হামলার ঘটনার পরপরই প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, আফগান নাগরিকদের যেকোনো ধরনের আশ্রয় আবেদন আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হবে। একই সঙ্গে ১৯টি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত নজরদারি ও স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া চালানো হবে বলে ইউএসসিআইএস জানিয়েছে। ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি যে এক নাটকীয় মোড় নিয়েছে, তা এখন স্পষ্ট। ট্রাম্প প্রশাসনের রিভার্স মাইগ্রেশন নীতি এবং দারিদ্র‍্যপীড়িত দেশ থেকে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ঘোষণা ব্যাপক সমালোচনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বহু বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন যে, জনসংখ্যাগত ভারসাম্য, অর্থনীতি এবং মানবাধিকার এই তিন দিকেই এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৫ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করেই নিজের সমর্থনঘরকে আরো দৃঢ় করতে চাইছেন আর এই কৌশল আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে।

শেয়ার করুন