২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:৪৪:৩৬ পূর্বাহ্ন


৬৮ মিলিয়ন ডলারের মেডিকেইড প্রতারণা মামলায় জাকিয়ার দোষ স্বীকার
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১২-২০২৫
৬৮ মিলিয়ন ডলারের মেডিকেইড প্রতারণা মামলায় জাকিয়ার দোষ স্বীকার জাকিয়া খানের ডে কেয়ার ও জাকিয়া খান


ব্রুকলিনের কনি আইল্যান্ডে অবস্থিত দুটি সোশ্যাল অ্যাডাল্ট ডে কেয়ার সেন্টারের মালিক বাংলাদেশি জাকিয়া খান ব্রুকলিনের ফেডারেল আদালতে প্রায় ৬৮ মিলিয়ন ডলার মেডিকেইড প্রতারণার অভিযোগে দোষ স্বীকার করেছেন। আদালতে দোষ স্বীকার করার ফলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ডসহ অন্যান্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে। দোষ স্বীকারের অংশ হিসেবে জাকিয়া খান আদালতের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন, যার আওতায় তিনি পাঁচ মিলিয়ন ডলার, কয়েকটি সম্পত্তি এবং তিন লাখ ডলারের বেশি নগদ ও স্বর্ণালংকার বাজেয়াপ্ত করতে সম্মত হয়েছেন। এই সম্পদগুলো পুলিশের তল্লাশি চলাকালীন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।

আদালতে অভিযোগ করা হয়েছিল যে জাকিয়া খান মেডিকেইড থেকে প্রাপ্ত অর্থের অভাবে বিভিন্ন ধরনের ঘুষ ও অনৈতিক অর্থ প্রদান করে বাংলাদেশি ও অন্যান্য পেনশনপ্রাপ্তদের প্রলোভিত করে ভেজাল সেবা প্রদান করতেন। মার্কিন সরকারের মতে, খানের মালিকানাধীন দুটি সোশ্যাল অ্যাডাল্ট ডে কেয়ার সেন্টার হলো হ্যাপি ফ্যামিলি সোশ্যাল অ্যাডাল্ট ডে কেয়ার সেন্টার ইনক. (হ্যাপি ফ্যামিলি) এবং ফ্যামিলি সোশ্যাল অ্যাডাল্ট ডে কেয়ার সেন্টার ইনক. (ফ্যামিলি সোশ্যাল)। এছাড়া তিনি হোম হেলথ কেয়ার ফিসক্যাল ইন্টারমিডিয়ারি ও ট্যানউই সার্ভিসেস ইনক পরিচালনা করতেন, যা প্রতারণার অর্থ গ্রহণ ও লন্ডার করার কাজে ব্যবহৃত হতো। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেডিকেইড থেকে প্রাপ্ত অর্থকে অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেছেন এবং এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে রেখে ব্যবহার করেছেন।

জানা গেছে, তিনি মেডিকেইডে বিলিং করে প্রাপ্ত অর্থকে কিকব্যাক ও ঘুষের মাধ্যমে ভিন্ন পথে ব্যবহার করতেন। ট্যানউই সার্ভিসেস ইনকের মাধ্যমে তিনি এ অবৈধ অর্থ লুকাতেন এবং লন্ডার করতেন। অক্টোবর ২০১৭ থেকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত, খান ও তার নিয়োগকৃত মার্কেটিং কর্মীরা মেডিকেইড গ্রাহকদের উন্নত সেবার নামে হ্যাপি ফ্যামিলি ও ফ্যামিলি সোশ্যালে ভর্তি করতেন। তারা মেডিকেইডের নামে বিলিং করতেন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে সেবা সরবরাহ করা হত না, বা তা কিকব্যাক ও ঘুষের মাধ্যমে প্ররোচিতভাবে করানো হতো। ফলে মেডিকেইডের নামে বিল জমা পড়তো যা প্রকৃতপক্ষে প্রদান করা হয়নি।

প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক ছিলেন বয়স্ক, অসুস্থ ও দরিদ্র মানুষেরা, যারা মেডিকেইড সুবিধার অধিকারী। অভিযোগপত্র অনুযায়ী, বেশিরভাগ গ্রাহক কখনো ডে কেয়ার সেবা গ্রহণ করেননি এবং সিডিপ্যাপ হোম হেলথ সার্ভিসও পাননি। অনেক সময় গ্রাহকরা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করলেও তাদের নামে মাসের পর মাস বিল করা হতো। এ সেবাগুলোর বদলে গ্রাহকদের নগদ অর্থ দেওয়া হতো, যা মাসে ৫০০ থেকে দেড় হাজার ডলার পর্যন্ত ছিল। ফেডারেল নথি অনুযায়ী, এই নগদ অর্থকে ব্রেড বাকমিশন বলা হতো এবং গ্রাহকরা শুধু নাম ব্যবহার করার জন্য অর্থ গ্রহণ করতেন।

এই জালিয়াতির মূল চালিকাশক্তি ছিল মার্কেটার ও রিক্রুটার নেটওয়ার্ক। তারা মেডিকেইড গ্রাহক খুঁজে আনতেন, মেডিকেল মূল্যায়নে আত্মীয় বা কেয়ারগিভারের ভান দেখাতেন, ভুয়া সাইন-ইন শিট তৈরি করতেন এবং সিডিপ্যাপ টাইমশিট সাজাতেন। এরপর তারা এমএলটিসি প্ল্যানে বিল জমা করতেন। এসব মার্কেটার মাসের পর মাস কমিশন পেতেন এবং নগদ অর্থ বিতরণে সম্পৃক্ত থাকতেন। সিডিপ্যাপ প্রোগ্রাম, যা প্রকৃত উদ্দেশ্যে পরিবারের মাধ্যমে হোম হেলথ সেবা নিশ্চিত করে, সেটিকেও জালিয়াতির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। ফেডারেল অভিযোগ অনুযায়ী, কেয়ারগিভারের নাম দেখানো হতো যারা আসলে কাজ করেননি এবং গ্রাহক জানতেনও না কে তার হেলথ এইড।

অর্থপাচারের জন্য জটিল করপোরেট কাঠামো ব্যবহার করা হতো। হ্যাপি ফ্যামিলি এবং ফ্যামিলি সোশ্যাল থেকে চেক পাঠানো হতো বিভিন্ন শেল কোম্পানিতে যেমন ফাইভ রোজেস, জেডএনকে হেলথ অ্যান্ড বিউটি, এসএল এল্ডারলি সার্ভিসেস, আইকোনিক ওয়ার্ল্ড, গ্রেসভিল এবং আমেরিকান হেল্পিং। এসব কোম্পানির মাধ্যমে নগদ অর্থ বের করা হতো এবং মূল উৎস লুকানো হতো। ফেডারেল নথি থেকে জানা যায়, প্রতিটি পদক্ষেপ পরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত ছিল। মালিক, অপারেশন ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের রিক্রুটাররা সবাই জানতেন কে কতদিন ‘সেবা’ নিয়েছেন এবং কত কমিশন পাওয়া উচিত। অডিট বা তদন্ত এলে তারা মিথ্যা চিঠি জমা দিতেন এবং দাবি করতেন কেউ নগদ পাননি। এই মামলার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, মানবসেবার আড়ালে মেডিকেইড ব্যবস্থায় একটি কিকব্যাকমুখী অপরাধ চক্র গড়ে উঠেছিল। অভিযোগের পরিমাণ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়; এতে ক্ষতি হয়েছে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি বিশ্বাস এবং মেডিকেইড ব্যবস্থার সততার।

এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ তারা বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করত: অর্থ লুকানো, নগদ হিসাব করা এবং তারপর সে অর্থ পুনরায় কিকব্যাক ও ঘুষ হিসেবে বিতরণ করা হত। জানা যায়, জাকিয়া খান ও তার সহযোগী কর্মীরা পেনশনপ্রাপ্তদের কাছে নানান প্রলোভন ও অর্থ প্রদান করতেন যাতে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে জড়িয়ে পড়েন এবং মেডিকেইড নামে বিল জমা হয়। খানের সহযোগীদের মধ্যে সীমা মেমন ও আমরান হাস্মি, যারা তার কর্মচারি ছিলেন, ইতিমধ্যেই দোষ স্বীকার করেছেন এবং তাদের সাজা অপেক্ষা করছে। এছাড়া এগারো জন আরো সহযোগী রয়েছেন, যারা বর্তমানে মামলার মধ্যে এবং বিচারাধীন।

মামলাটি পরিচালনা করছে ক্রিমিনাল ডিভিশনের ফ্রড সেকশন থেকে অ্যাটর্নি প্যাট্রিক জে ক্যাম্পবেল ও লিওনিড স্যান্ডলার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ইউএস অ্যাটর্নি মাইকেল কাস্টিগ্লিওনে বাজেয়াপ্তি বিষয়গুলি তদারকি করছেন।

শেয়ার করুন