১৮ জুন ২০১২, মঙ্গলবার, ০৮:০২:৫৫ অপরাহ্ন


তৃণমূলে আস্থাহীনতায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিএনপিতে
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৬-২০২৪
তৃণমূলে আস্থাহীনতায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিএনপিতে


বিএনপির তৃণমূল নেতা আব্দুল হালিম। পেশায় ব্যবসায়ী। বিএনপিতে অগাধ বিশ্বাস ও সাংগঠনিক দক্ষতায় বছরখানেক আগে ইউনিয়ন নেতৃত্বের দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু হালিমের মন ভালো নেই। রাজনীতিতে সক্রিয়তা আগ থেকেই। কিন্তু দায়িত্ব লাভের পর থেকে প্রচণ্ড প্রেশার। নিজেই জানালেন, ‘ভালো নেই। কারণ কর্মীদের আটকানো মুশকিল। সবাই নির্বাচন করতে চলে যেতে চায়। বোঝেনই তো।’ দলীয় আস্থায় ঘাটতি নেই, কিন্তু গ্রামের মানুষের মধ্যে নির্বাচনের সময় একটা অন্যরকম প্রতিযোগিতা চলে। সেখানে প্রভাব-প্রতিপত্তির পাশাপাশি অর্থের ঝনঝনানিও। সেগুলো থেকে বঞ্চিত বিএনপির কর্মীরা। প্রতিপক্ষ যখন ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসব করে বেড়ায়, তখন বিএনপির কর্মীরা মুখ গোমড়া করে আড়ালে-আবডালে মুখ লুকাতে হয়। কারণ বিএনপি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত নির্বাচনি মাঠে। কেউ কেউ ওই নির্বাচনে অংশ নিতে চলে যায় বিভিন্ন উপায়ে। এ উদাহরণ এক স্থানের নয়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বছরখানেক আগ থেকে বিএনপি যে সভা-সমাবেশ করে আসছিল, সেখান থেকেই ছিল ধরপাকড়। জাতীয় নির্বাচনের পর অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন। এতে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস তারা ফেললেও দলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কী হবে এ ভেবে অস্থির কেউ কেউ। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে এর একটা প্রমাণও দেখা গেছে। 

উপজেলা নির্বাচনের চারদিনে বিএনপি ২১৭ জন উপজেলা প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় বিএনপি। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৮০ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৬৯ জন, তৃতীয় ধাপে ৫৫ জন এবং চতুর্থ বা শেষ ধাপে ১৩ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। অর্থাৎ বিএনপির কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করাকে দলের প্রতি আস্থা সংকট ও নেতৃত্বের প্রতি অবিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকে বিএনপির এসব নেতা নির্বাচন করেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। দল থেকে কঠোরতা না থাকলে এ সংখ্যা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেতো। নিঃসন্দেহে দলের জন্য, দলের নেতৃত্বের জন্য এগুলো সুখকর। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা হয়েছে দলের নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকেই। 

গত ১৬ এপ্রিল দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান সরকার ও তার আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, বেসামরিক ও পুলিশ প্রশাসন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ নেই। তাই উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেবে না বিএনপি।’

তবে দলের হাই কমান্ডের সেই সিদ্ধান্তকে থোড়াই কেয়ার করে বিভিন্ন উপজেলা থেকে উল্লেখযোগ্য হারে বিএনপি নেতা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তাদের সঙ্গে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীও মাঠে নেমে কাজ করেছেন। তালিকা করে সেই নেতাদের বহিষ্কার করছে বিএনপি। কিন্তু কর্মীদের কী হবে? দলের ভেতরে তাদের বিরুদ্ধেও তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস। ওই সব কর্মীর ভবিষ্যৎ কি, দল কোনো সিদ্ধান্ত নেবে কি না, সেটা নিয়েও নতুন করে কৌতূহল শুরু। যা স্থানীয় পর্যায়ের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেখানেও দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করেছে। এটা সামাল কীভাবে দেবে বিএনপি এ নিয়ে ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। কেননা দুই শতাধিক নেতার অধীনস্থ উপজেলাতে এতো বিশাল পরিমাণ কর্মীর অনাস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে দল কতটা এগোতে পারবে সে প্রশ্ন চলে এসেছে। উল্লেখ্য, মোট চারটি ধাপে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবার। 

কবে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি 

এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপি কবে নির্বাচনে যাবে, কবে ক্ষমতায় যাবে এগুলো ভেবে অনিশ্চয়তার ঘোরটোপে বিএনপির নেতাকর্মী। এর কোনো সঠিক দিনক্ষণ কেউ বলতে পারে না। বিএনপি কবে নির্বাচনে যাবে বা যেতে পারবে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল কিছু একটা হওয়ার। কিন্তু ভারতসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে শেষ মুহূর্তে পাল্টে যায় সব। একতরফা এক নির্বাচন অনুষ্ঠান করে আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি দলটির। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশসমূহও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিএনপির শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এসব অবলোকন করেছে। 

দ্বাদশ নির্বাচনের যেমনটা প্রতিবাদস্বরূপ লিফলেট বিতরণ করেছে, উপজেলাতেও একই তরিকায় লিফলেট বিতরণ। কিন্তু আওয়ামী লীগকে কি লিফলেট বিতরণ করে দমানো সম্ভব? 

তৃণমূলের প্রত্যাশা ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার পতনের কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি। যার ওপর নির্ভর করে কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ও নির্বাচন কশিনের অধীন। কিন্তু বিএনপি হঠাৎ রণে ভঙ্গ। চেয়ে চেয়ে দেখলো তারা আওয়ামী লীগের নির্বাচনি তফসিল, একতরফা অর্থাৎ মূল প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দলেরই একজনকে বাছাই করে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের নির্বাচনে বিরল ঘটনা। বিএনপি এসব দৃশ্য দেখে দেখে সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সেটা ব্যবহার করে নির্বাচনে বিপুল আসনে জয় নিয়ে সরকার গঠন করে ক্ষমতায়। এগুলো সবার জানা থাকলেও আবার একবার বলা আর কি! 

উপজেলাতেও বিএনপি লিফলেট বিতরণ করেছে। উপজেলাতে নির্বাচন শেষ। বিএনপির কর্মসূচিও শেষ। এ মুহূর্তে বিএনপি নেতাদের সভা সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য, সরকারের থাকা লোকজনের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা ও তাদের উপহাসমূলক কথাবার্তার জবাব দেওয়া ছাড়া আর কোনো কর্ম নেই। 

বিএনপির অভ্যন্তরীণ খবর আবারও দল গোছানোর কাছে মনোনিবেশ করতে চায় দলটি। আসলে এ মুহূর্তে এমন কাজ ছাড়া আর কিছুই নেই সামনে। এখন অবিশ্বাসের দোলাচালে থাকা নেতাকর্মীরা কেন মাঠে নামবে। ডাকলেও তারা মাঠে নামবে না এ আস্থাহীনতা কেন্দ্রেরও। 

শুধু তৃণমূল ও মিড লেভেলই বা কেন, স্থায়ী কমিটির সদস থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে বিএনপির শত শত কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। কিন্তু মাঠে ঘাটে ক’জনকে দেখা যায় বক্তব্য দিতে, কথা বলতে? তাই বলে সম্প্রতি যেসব আন্দোলন সভা- সমাবেশ হয়েছে তাতে লোকসমাগম হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু সেখানে তরুণ প্রজন্মকে ফ্রন্টলাইনেই দেখা গেছে। 

সিনিয়রদের মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল, রুহুল কবীর রিজভী, গয়েশ্বর চন্দ্র, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এমন সব মিলিয়ে ডজনখানেক কে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা কথা বলছেন। পাশাপাশি থাকছেন আরো ডজনখানেক। এই তো! তাহলে বাকিরা কী করছেন? তাদের ওপর কি কোনো দায়িত্ব নেই। দলের একটা ক্রান্তিকালই বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক চালে। সেখানে এসব নেতা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছেন কীসের জন্য।

পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে বিএনপির একটি বিশাল শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অংশ আগামী পাঁচ বছরের মাথায় যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তারা সেখানে নিজেদের সেভাবে আর উপস্থাপন করতে পারবেন না। কারণ বয়স একটা ফ্যাক্টর। ওই বয়সে রাজনীতির ঝক্কি পোহানো কষ্টকর। এরা কিছুটা পিছুটান দিয়ে রয়েছেন। তাছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাররই তরুণ নেতৃত্বের উপর আস্থাশীল। সেটাও তারা বুঝে গেছেন। ফলে নির্বাচনের মাঠে কে নমিনেশন পাবেন আর কে পাবেন না সেটারও একটা হিসাবনিকাশ তারা কষে ফেলেছেন। তাছাড়া বিএনপি যে ধরনের আন্দোলনে মনোনিবেশ, তাতে বর্তমান সরকার নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যাবে আরো পাঁচটি বছর। ফলে এ দীর্ঘদিন মাঠঘাটের আন্দোলনে নিয়োজিত থেকেও সন্দিহান যখন নমিনেশন প্রাপ্তি তখন এমন পরিশ্রম করে লাভ কী-এমনটাও ভাবছেন হয়তো অনেকেই। 

বিএনপি নেতা বলেই নয়, অনেকেই বাস্তব জীবনে টিকে থাকতে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে থাকতে হয়। টানা চতুর্থ টার্ম ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বিএনপির এসব নেতাদের নির্বিঘ্নে সে কাজটা করতে দেবেন সেটা কী বিশ্বাসযোগ্য? আওয়ামী লীগ বলে কথা না, অন্য যে কেউ হলেও একই কাজটা করতেন। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের একটা অংশ নিষ্ক্রিয়। যাদের অনেককে দেখা যায়নি ২৮ অক্টোবর বিএনপির সেই পল্টনে মহাসমাবেশ শুরুর পরপর পণ্ড হওয়ার পর। একটা বড় ফ্রন্টলাইনারদের কারাগারে পাঠালেও অন্যরা ছিলেন না মাঠে। ফলে রিজভী, গয়েশ্বরের মতো দু-তিনজন মাঠে বিবৃতি দিয়ে ওই সময় পার করেছেন। কিন্তু এর বাইরেও অনেক ডাকসাইটে নেতা ছিলেন যারা মাঠে যায়নি। এখন পর্যন্ত অনেকেই নিষ্ক্রিয় বা দু-একবার মুখ দেখা যায় মিডিয়ায়। ফলে এগুলোও এখন একটা ফ্যাক্টর বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিক্রমায়। অনেকেই সন্দিহান নিজের ও দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও। এতে পিছিয়ে। সব মিলিয়ে বিএনপি একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

শেয়ার করুন