০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:১৯:২৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


এবার ‘খেলা হবে’ বাংলাদেশে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৯-২০২২
এবার ‘খেলা হবে’ বাংলাদেশে মমতা ব্যানার্জি


বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মুখে এখন ‘খেলা হবে’ উচ্চারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা যেমনটা বলছেন ‘খেলা হবে’। ঠিক পাল্টা জবাবে বিএনপি নেতৃবৃন্দের মুখেও এখন ‘খেলা হবে’। পলিটিক্যাল লিডারদের মুখে এমন ‘খেলা হবে’ বাক্যটা মোটেও ভালো ঠেকছে না সাধারণ মানুষের। এ নিয়ে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে এখন বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গে এখন ১৬ আগস্ট ‘খেলা হবে’ দিবসও পালন করছে। ওইদিন প্রায় ২১ রাজ্যে খেলা হবে দিবসও পালন করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। পরবর্তীতে এটাকে তারা বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে পর্যায়ক্রমে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেও ‘খেলা হবে’ ছড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। ওইদিনকে কেন্দ্র করে ভারতের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করছে।

মূলত মুখে খেলা হবে মানে বলছেন তারা চারদিকে কর্মীদের মাঝে ফুটবল বিতরণ করে। যাতে কর্মীরা ফুটবল খেলে একযোগে। আসলে এর পেছনে রহস্য হলে রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে হুঙ্কার দিয়ে এ কথা বলা যে ‘খেলা হবে’। সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা- সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতে তার অঞ্চলে নির্বাচনের প্রচারণায় ভোটের দিনটাকে তিনি ‘খেলা হবে’ অভিহিত করে ঘোষণা দেন এবং সে নির্বাচনী জনসভায় তিনি দর্শকের দিকে ফুটবল ছুড়ে মেরে (বল উপহার দিয়ে) ঘোষণা করেন খেলা হবে। নির্বাচনের মাঠেও খেলা হবে। মমতা সেই ‘খেলা হবে’ চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়েছেন। ভারতে এ খেলা হবে নিয়ে তোলপাড়। শীর্ষ মিডিয়াও এ খেলা হবে নিয়ে আর্টিক্যাল প্রকাশ করে। তারা এর উৎপত্তিও খুঁজেছেন। 

মূলত ভারতে তোলপাড় হওয়া ‘খেলা হবে’ নিয়ে বাংলাদেশ থেকেই ‘খেলা হবে’-এর উৎপত্তি এ দাবি নারায়ণগঞ্জের ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ শামীম ওসমানের। তিনি বলেছেন ২০১৪ সনের দিকে তিনি একবার ওই কথা বলেছিলেন বলে নিজের মুখে স্বীকার করেন। এরপর তিনি ২০১৬ সনেও একবার তার এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে গিয়েও খেলা হবে। কিছু ব্যক্তি ও দলের নাম উচ্চারণ করে বলেছিলেন-  তোর শক্তিশালী সহযোগীদের নিয়ে আয়, খেলা হবে। আমরা খেলবো’ বলেছিলেন। এখন সে ‘খেলা হবে’ এবারের বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে। শামীম ওসমান নিজে আবারো ওই খেলা হবে বলার পর এরপর সেটা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনিও বলেন ‘খেলা হবে’ এবার। নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মীদের উৎসাহ বাড়াতে খেলা হবে কথা ঠিক থাকলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ খেলা কোন খেলা হবে সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা ভারতের গণতন্ত্রের ভীত খুবই শক্তিশালী। নির্বাচনটাও তাদের খুবই স্বচ্ছ ও ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। তাদের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই। হেরে যাওয়া প্রার্থী ও দল অনায়াসে জনগণের রায় মেনে নেয়। এর কারণ তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাদের নির্বাচন কাঠামোর ওপর অগাধ বিশ্বাস। তারা জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘঠানোর স্থানটাতে কোনো ছলচাতুরি করার সামান্যটুকু অবকাশ রাখে না। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের শতবছরের ঐতিহ্য। এটাকে তারা শ্রদ্ধা করে। লালন করে। রেফারেন্স তৈরি করে রেখেছে। কথিত আছে নিজ দলের প্রার্থীদের ভোটে সহায়তা পাবার আশায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার এক মন্দিরে যেয়ে পূজা অর্চনা করেছেন। সেখানকার লোকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এটা তো খুব বেশিদিন আগের কথা না। কারণ বাংলাদেশের অনেক হিন্দুধর্মের লোকজন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন। তাদের আত্মীয়স্বজনরা সেখানে। ফলে এ সুযোগটা হাতছাড়া করেননি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

কিন্তু বাংলাদেশে? বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা যে স্বচ্ছ নয়, সেটা খোদ শীর্ষ দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মুখে মুখে। যে বা যারা নির্বাচনে হেরে যায় তারাই বলেন, কারচুপি হয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ কোটির অধিক মানুষ এখন বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন। এক্ষেত্রে বড় দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়েছেন ইতিমধ্যে। গত দুই জাতীয় নির্বাচনে তো ভোটেই যায়নি মানুষ। ২০১৪ ও ২০১৮ সনের নির্বাচনে কী হয়েছে এগুলো আর নতুন করে বলার নেই। বহু কেন্দ্রে ভোটারই যায়নি। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস। বাকিগুলোতেও মানুষ যায়নি। ২০১৮-তে বিএনপির অভিযোগ- দিনের ভোট আগের দিন রাতে সম্পন্ন হয়েছে। ব্যালট পেপার সিল মেরে বক্সে ভরে রাখা হয়েছে এবং নাকি হাজার হাজার কোটির টাকা খেলা হয়েছে। বিএনপির ও দেশের অনেক বিরোধীদলের এ অভিযোগ সরকার পক্ষ খ-ন করতে পারেনি। কারণ তখনকার সিইসি তার বক্তব্যে ইশারা-ইঙ্গিতেও বলে ফেলেছেন। আর পর্যবেক্ষক মহল তো বলছেনই হরহামেশা। কথা উঠছে ২০০৮ সনের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়েও। জেনারেল মইন শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি আগ থেকেই সিট ভাগাভাগি করে ফেলেছিলেন- এগুলো অভিযোগ। মানুষ সেটাতেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে।  

পরবর্তী অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন এখনো প্রায় বছর দেড়েক বাকি। কিন্তু ওই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। বিএনপিসহ বেশক’টি বিরোধীদল বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিএনপির দাবি নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সেটাতে যাবে না তারা। কারণ সে নির্বাচনে অংশ নেয়া আর ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচের পুনরাবৃত্তি একই কথা। 

কিন্তু সরকার এটা মানছে না। অপরদিকে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়ন সহযোগী বা দাতা দেশসমূহের স্পষ্ট দাবি সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সব মিলিয়ে টেবিলের আলোচনায় উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। 

বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধীদল ইতিমধ্যে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। সেটাও জনগণের চাহিদা মোতাবেক বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক দাম ও সরকারের দুর্নীতি ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে। কিন্তু এ দাবি নিয়ে মাঠে নেমেই প্রচ- বাধার মুখে বিরোধীদল। ভোলাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পর বিক্ষোভ করার চেষ্টাকালে পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত হন। এরপর থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু। এ নিয়ে বিএনপি হরতাল ধর্মঘটের মতো বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি না দিলেও পল্টনে সমাবেশ ও দেশব্যাপী ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু ওই কর্মসূচি শুরুর পর প্রায় অনেক স্থানেই বাধার সম্মুখীন বিএনপি। সমাবেশে হামলা বা সমাবেশের স্থলে পাল্টা সমাবেশ আহ্বান বা পুলিশের বাধা প্রদান। এসবের পর আবার একের পর এক মামলা-ধরপাকড় ও সেই বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বিএনপির নেতাদের বাড়িঘরেও হামলার ঘটনা ঘটছে। 

এমনি মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জে গত ২৭ আগস্ট এক জনসভায় শামীম ওসমান বলেন, ‘আপনারা খেলতে চান। সুযোগ নিতে চান? আপনারা খেলতে চান। আপনারা মরণ খেলায় খেলতে চান। কী করবেন? বাংলাদেশকে ধ্বংস করবেন। আপনারা খেলবেন আমাদের সাথে? খেলতে চান। কবে খেলবেন? কবে খেলবেন বলেন। আমরাও খেলতে চাই। আপনারা খেলবেন। আমরাও বলছি খেলা হবে ইনশাল্লাহ। আপনারা খেলবেন ধ্বংসের পক্ষে, আমরা খেলবে ধ্বংসের বিপক্ষে। আপনারা খেলবেন বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করার জন্য। আমরা খেলবো আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো করে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করার জন্য খেলবো। আপনারা খেলবেন সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। আমরা খেলবো অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সেই বাংলাদেশ করার জন্য। আর যদি মনে করেন সে খেলায় আপনারা জিতবেন। তাহলে ডেট দেন। সারা বাংলাদেশে ঝামেলা করে লাভটা কী। এক জায়গাতেই খেলি।’ তিনি অনেকটাই দরাজ কণ্ঠে বলেন এ কথা। 

এর আগে গত ১৭ আগস্ট এক সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছিলেন খেলা হবে সে কথা। তিনি বলেন, ‘খেলা হবে আন্দোলনের মাঠে হবে খেলা।’ তিনি বলেন, রাজপথে হবে। নির্বাচনে হবে, মোকাবিলা হবে (দুইবার বলেন), প্রস্তুত হন, খেলা হবে। বিএনপি বলে- আওয়ামী লীগের পায়ের তলায় নাকি মাটি নেই।’ তিনি বলেন, ‘কী নিয়ে খেলবেন। গতবারের মতো জগাখিচুড়ি ঐক্য করে ধরা খেয়েছেন। এবারো ধরা খাবেন। বিএনপি ধরা খাবে। আবারো ধরা খাবে। সময় ঘনিয়ে আসছে।’ 

এদিকে গত পয়লা সেপ্টেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রায় বাধা দেয় পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ রাস্তা বন্ধ করে মিছিল করায় বাধা দেয়া হয়েছে। যাতে পূর্ব অনুমতি ছিল না। এতে দুপক্ষে সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাওন নামক এক যুবদল কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। তাকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি মারা যান। এ ঘটনার পর বিএনপি জানায়, নিহত শাওন যুবদলের নেতা এবং মিছিলের অগ্রভাগে শাওনকে দেখা যায় বলে ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। ফলে খেলা হবে নিয়ে বিএনপির এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাও প্রশ্ন তুলেছেন সংসদে।   

‘খেলা হবে’ ঘোষণার পর এমন ঘটনা অনেকেই খেলা শুরু হওয়ার ইঙ্গিত দেখছেন, যা আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছে।

শেয়ার করুন