৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৬:০৪:১৪ অপরাহ্ন


বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন
সংস্কারের পক্ষে ব্যাপক জনমত রয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৮-২০২৫
সংস্কারের পক্ষে ব্যাপক জনমত রয়েছে বক্তব্য রাখছেন বদিউল আলম মজুমদার


‘সংস্কারের পক্ষে ব্যাপক জনমত রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারে কর্ণপাত না করলে এর মাশুল তাদেরকে দিতে হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন সুজন সম্পাদক ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘প্রস্তাবিত জুলাই সনদ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে উক্ত মন্তব্য করেন। নাগরিক সংলাপটি রাজধানীর তোপখানা রোডে অবস্থিত সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সুজন-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বিচারপতি এম এ মতিন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক মহা হিসাব নিরীক্ষক ও অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান, সুজন-এর নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম প্রমুখ। 

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন-এর জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের স্বার্থকর্তা নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের ওপর। সনদটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রয়েছে। নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এবং পরবর্তী সংসদে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে- এমন মনোভাব পোষণ করলে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমি মনে করি, সংস্কারের ব্যাপারে ব্যাপক জনমত রয়েছে, যা সুজনের জনমত জরিপ থেকেও অনুধাবন করা যায়। তাই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যদি শুধু নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে এবং সংস্কার বাস্তবায়ন না করে, তাহলে তাদেরকে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে।’ 

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় সনদ তৈরির ক্ষেত্রে সুজন দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে যা অত্যন্ত প্রশাংসাযোগ্য। কোনো একটা বিষয়কে মৌলিক অধিকারের মধ্যে নেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পদের বরাদ্দের বিষয়টি যুক্ত। তাই মৌলিক অধিকারের মধ্যে যুক্ত হওয়া নতুন বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা স্পষ্ট নয়। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে শুধু মতামত নেওয়ার এত খরচ করে উচ্চকক্ষ তৈরি করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’ সনদ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বলেন, গণভোটের মাধ্যমেই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায়। এছাড়া প্রোক্লোমেশন করে পরবর্তী সংসদে সনদ পাশ করা যেতে পারে।’ 

মনির হায়দার বলেন, ‘সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও ঐকমত্য কমিশন সংলাপে পাঁচবার উত্থাপন করেছে। এ বিষয়ে প্রথম সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ব্যাপারে দলগুলো একমত না হওয়ায় কমিশন রাজনৈতিক দল কর্তৃক এক-তৃতীয়াংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব আনে। কিন্তু তাতেও দলগুলো সম্মত হয়নি। এখন অনেকেই এ বিষয়ে কমিশনকে দোষারোপ করছেন। আমরা দেখিনি কোনো নারীনেত্রী তাদের দাবি আদায়ে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ঘেরাও করতে কিংবা এ ব্যাপারে কোনো শক্ত দাবি তুলে ধরতে।’ সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে এখন যেটা হয়েছে সেটা মন্দের ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন বিগত ছয় মাসে যা অর্জন করেছে তাতে হতাশ করার কারণ নেই। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, অন্যান্য দেশে এসব অর্জন করতে সময় লেগেছে গড়ে আড়াই বছর।’ কমিশন এখন দফায় দফায় জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোতে যে পরিমাণ নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে তাতে মনে হয় না কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করবে। ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসবে তার স্বৈরাচারী ও আধিপত্যবাদী হওয়ার সুযোগ খুব একটা কমাবে না এই সনদ। এত নোট অব ডিসেন্ট-সহ জুলাই সনদ কীভাবে গণভোটে দেওয়া হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।’ রাজনৈতিক দলগুলো যদি নোট অব ডিসেন্টের ক্ষেত্রে ছাড় না দেয়, তাহলে সনদটি অর্থবহ পরিবর্তন আনবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ড. মির্জা হাসান বলেন, ‘তত্ত্বগতভাবে নাগরিকরা দেশের মালিক হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় না। যেমনটা আমরা দেখেছি সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়। একটা কথা আছে ‘আর্ট অব দ্য পসিবল, যতদূর সম্ভব’- এমন একটা মনোভাব নিয়ে বর্তমানে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ঐকমত্যের বিভিন্ন নিয়ে যে পরিমাণ নোট অব ডিসেন্ট এসেছে তা বেশ হতাশাজনক বিষয়। এতগুলো সংস্কার একসঙ্গে গণভোটে দেওয়া একটি জটিল বিষয়।’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় আসেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে একরাম হোসেন বলেন, ‘সুজন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সাল থেকে একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সুজন। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরেও রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার রয়েছেন সুজন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে সুজন-এর প্রস্তাবিত জাতীয় সনদে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। প্রস্তাবিত জাতীয় সনদের খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য ১৫টি নাগরিক সংলাপের আয়োজন করে এবং জনমত জরিপ পরিচালনা করে। এর ভিত্তিতে প্রস্তাবিত খসড়া জাতীয় সনদটি চূড়ান্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে পেশ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিগত পাঁচ দশকে দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে প্রথম গঠিত ছয়টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ইতোমধ্যে কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ শেষে ১১টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট-সহ ৮৪টি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। 

একরাম হোসেন বলেন, জাতীয় সনদে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলোর মধ্যে কতগুলো হলো মৌলিক সংস্কার, যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, জনপ্রশাসন, পুলিশী ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হবে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে সীমিত করা, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকার বিধান, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ও আনুপাতিক পদ্ধতিতে এর সদস্য নির্বাচিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দেওয়া, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও গঠন পদ্ধতি, সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন করার বিধান, বিশেষায়িত কমিটির মাধ্যমে সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, ইত্যাদি।’

তিনি তাঁর বক্তব্যে জুলাই জাতীয় সনদ থেকে কয়েকটি প্রাপ্তি তুলে ধরেন। যেমন, ক. মৌলিক অধিকারসমূহের সম্প্রসারণ, খ. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া, গ. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় লাগাম টানা, ঘ. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, ঙ. সংবিধানের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, চ. জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোটদান, ছ. সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি, জ. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, ইত্যাদি। জুলাই সনদের অপ্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে: জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মাধ্যমে মাধ্যমে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ; সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব; বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; স্থানীয় সরকারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর আসন সংরক্ষণ, ইত্যাদি। 

একরাম হোসেন বলেন, জাতীয় সংসদে নারীদের নায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি, যা হতাশাব্যাঞ্জক। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যাপারে জনমত থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো উদারতার পরিচয় দেয়নি। বরং বিদ্যমান আলঙ্কারিক ৫০টি সংরক্ষিত আসনের বিধান বহাল রয়েছে এবং নারীদের সরাসরি জিতে আসার সুযোগ বাড়েনি। আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে নারীর যথার্থ প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অধিকার পরাজিত হয়েছে এবং পুরুষতন্ত্রের জয় হয়েছে। আরেকটি হতাশার বিষয় হলো যে, অনেকগুলো মৌলিক বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল বার বার ডিসেন্ট দিয়েছে। আশা করি, ডিসেন্ট অব ডিসেন্ট দেওয়া দলগুলো অধিকাংশ দলের সম্মতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এগুলো মেনে নেবে, যেমনিভাবে ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদে উত্থাপিত বেশকিছু বিষয়ে কোনো কোনো গণপরিষদ সদস্যের দ্বি-মত থাকলেও সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং সেগুলো তারা মেনে নিয়েছিলেন।’ 

প্রবন্ধের শেষভাগে একরাম হোসেন বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু এর স্বার্থকর্তা নির্ভরতা করবে বাস্তবায়নের ওপর, যা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, এ বিষয়ে দ্রুতই একটি সমাধানে পৌঁছাবে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো। আমরা মনে করি, সংস্কারের কোনগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে, কোনগুলো অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, কোনগুলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন করা হবে এবং এর মধ্যে কোনগুলো আশু বাস্তবায়নযোগ্য তা আলাদা করা দরকার।’

শেয়ার করুন