০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:৪৯:১৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহতা কী?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১০-২০২৩
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহতা কী? গোলাম মাওলা রনি


মার্কিন ভিসানীতির কার্যক্রম কী সেটা নিয়ে অনেকেই হিসাব কষতে চাচ্ছেন না বা বিষয়টি অনুধাবনেরও চেষ্টা নেই। কিন্তু এ ভিসানীতি কীভাবে কাজ করে। এক্ষুনি পুরোনো কথা নতুন করে একটু স্মরণ করে দেখা যাক। মার্কিন ভিসানীতি। হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বা বসবাসে ভিসাপ্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট কতিপয় মানুষের জন্য স্পেশাল একটি নিয়ম। আর এ নিয়ম যার ওপর প্রয়োগ হবে তার বেলায় হয়ে যাবে মার্কিন ভিসানীতি, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা। এটাই সহজ হিসাব আপাতত। 

এ ভিসানীতি যার ওপর প্রয়োগ হয় তাকে কীভাবে জনজীবন, আশা-নিরাশা থেকে নিয়ন্ত্রণহীন করে দেয়, সেটা একমাত্র যার ওপর প্রয়োগ হয়েছে তিনিই অনুভব করতে পারছেন। শুধু পলিটিকসের জন্য পলিটিকস বিষয়টি এমন নয়। এ মার্কিন ভিসানীতি একটা পরিবারকে পথে বসিয়ে দেওয়ার মতো যা যা রয়েছে, সেটা করে থাকে। সর্বসাধারণ তো আর এ ভিসানীতিতে আক্রান্ত নন। সমাজের একটা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপরই এর কার্যক্রম আরোপিত হয়। আর মার্কিন ভিসানীতি শুধুই যে আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি তেমনও নয়। ভিসা না দেওয়া বা ভিসা ক্যানসেল সেটা তো একটা বিষয় রয়েছেই। কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে অনেক কিছু বিষয়, যা কুরে কুরে খায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়া ব্যক্তি ও তার পরিবারকে। ফলে এটাকে আমেরিকা যাবো না বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই, যা এখন বাস্তবে ঘটছে বাংলাদেশে। মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগ নিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সর্বত্রই তোলপাড়। কিন্তু একশ্রেণির মানুষ, বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, মার্কিন ভিসানীতি ঠিক আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা গেলাম না। না গেলে কী হবে? 

কিন্তু বিষয়টা কী এমন? 

প্রথমই জানা প্রয়োজন মার্কিন ভিসানীতিটা কি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা রনি একটি টেলিভিশনে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, এই ভিসানীতিটা কি, সেটা আমরা আসলে আন্দাজ করতে পারছি না। এটাতে দেশে ও দেশের বাইরে যে একটা রসায়ন সৃষ্টি করেছে। কেমিস্ট্রি সৃষ্টি করেছে যারাই যেখানে রয়েছেন, তারা চিন্তিত এ বিষয়টা নিয়ে। বিশেষ করে এর প্রভাব কি এটা একটা জাতীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের রেমিট্যান্সে কতটা প্রভাব পড়বে, সেটা জানার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এটা কেন হয়েছে আওয়ামী লীগ, না বিএনপি, না কার জন্য মার্কিন ভিসানীতি দেশে এসেছে, সেটা আর চিন্তার অবকাশ নেই। কেননা এর প্রভাব এখন দেশের সর্বত্র বিরাজমান। প্রশাসনে এ ব্যাপারে চলছে ফিসফাস। একে অপরকে জিজ্ঞাসা করেন, তার নাম তালিকায় আছে কি না। রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এই একই অবস্থা। একজনকে আরেক জন দেখছে সন্দেহের চোখে। একে অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করেন, তার নাম তালিকায় আছে কিনা, কারণ তার নিজের নামও আছে। এটাতে প্রমাণিত হয় মানুষের মধ্যে একটা বৈকলিঙ্গতা শুরু হয়ে গেছে। সাধারণত মানুষ একটা চড় বা থাপ্পড় খাইলে, মানে বেইজ্জতি হইলে সাধারণত মানুষ এগুলো পাগল না হইলে বলে না। এখন এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে উথালপাতাল শুরু হয়েছে, যে যা মনে আসছে বলে ফেলছে।’ তিনি একটি উদাহরণ টানতে গিয়ে বলেন, ‘বিজেএমইএর সভাপতি বললেন, আমি বিদেশে না যেয়েও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব। আমেরিকার ভিসা যদি না-ও পাই, তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। আমার কাছে মনে হয়েছে আমার বন্ধু মি. ফারুখের মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। কেননা সে সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু সে কি প্রধানমন্ত্রী যে, তাকে সভাপতি করেছে তার প্রতিদান দিল, না কি তার যে ৪ হাজারের মতো সদস্য আছে, তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখল। তিনি যদি এ বিষয়গুলো দেখতেন, তাহলে তার মুখ দিয়ে এ কথাগুলো বের হতো না।    

এটা জাতির ঘাড়ে, জাতির চিন্তা-চেতনায় সর্বত্র এ ভিসানীতি ঢুকে গেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাংবাদিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরে একটা প্যানিক ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্যানিকটা আমাদের বহুদিন ভোগাবে এবং আমাদের বিপদগ্রস্ত করবে। 

এটা কীভাবে বিপদগ্রস্ত করবে তার একটা বিবরণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ‘আমি একটি কারণে ২০১৫ সালে ফ্যামিলিসহ এই মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছি। আমার অপরাধ কী। ভিসা নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত  আমার সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের সম্পর্ক ছিল দুর্দান্ত। এমনকি বড় বড় মার্কিন সিনেটর, বড় বড় কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নোবেল প্রাইজ গিভিং অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম। অনেক মন্ত্রীর চেয়েও আমি তাদের কাছে বেশি পছন্দসই মানুষ ছিলাম। আমি বিদেশিদের প্রায় সব প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকতাম। কিন্তু ওই সময় একটি টকশোতে আমি দুষ্টুমিটা একটু বেশিই করে ফেলি। দুষ্টুমির ছলে সে সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে নিয়ে ছোট্ট একটা কমেন্টস করি। কারণ দেখলাম, তখন সৈয়দ আশরাফ (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) তাকে কাজের মেয়ে মর্জিনা বলেছেন, কিছুই হয়নি। আমিও একটু ঠাট্টা করি। কী এমন হবে। এর পরক্ষণেই প্রথম আমার ভিসা ক্যানসেল হওয়ার খবর আসে। এরপর আমার স্ত্রী-পরিজনের। আসলে ওরা মনে করে যাদের কাছে স্বার্থ আছে, তাদের ওরা খুব আপন করে নেয়। আমার সঙ্গেও তেমন, যে কারণেই হোক ব্যবসা হোক আর সম্পর্কের খাতিরেই হোক ছিল। কিন্তু ওরা কাছের মানুষের কাছ থেকে কটূক্তি নিতে পারে না, সিংগেল ডট পড়বে, সেটা ওরা মানতে পারে না। ওদের শত্রু উত্তর কোরিয়া যা বলে বলুক। কিন্তু তাদের কাছের মানুষ কিছু বললে সেটার প্রভাব অনেক দূরে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তো অনেক ভালো ছিল। সে যা হোক, বিষয়টি এখানেই থেমে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বড় কয়েকটি বায়ার ছিল। সেখানে আমার কয়েক লাখ ডলারের মালামাল ছিল। সেখানে আমার উপস্থিতি ছিল জরুরি। কিন্তু আমি যেতে পারছিলাম না ভিসা ক্যানসেলের কারণে। আমার সে মালগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছিল। টাকা আনতে পারিনি। এর সঙ্গে কানাডা অ্যাপলাই করলাম। কানাডাও আমায় ভিসা দিল না। সেখানেও আমার ব্যবসা ছিল। সবচেয়ে বড় বায়ার বাফেলো জিন্স। সেটাও আমার চলে গেল। তখন আমি খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। 

গোলাম মওলা রনি বলেন, ‘আমি চেষ্টা করলাম নেদারল্যান্ডস (ইউরোপ) যাওয়ার। সেখানেও বিজনেসসংক্রান্ত বিষয়। নেদারল্যান্ডস আমাকে ভিসা দেয়নি। এসবই ওই মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার সুফল।’ তিনি বলেন, আমার মনে হলো সিইএ, র, এনএসআই, ডিজিএফআই-এগুলোর একটি আন্তঃইনফরমেশন নেওয়া দেওয়ার একটা চ্যানেল আছে। আমি তখন রানিং সংসদ সদস্য। আমি মালয়েশিয়ায় যাবো, কিন্তু আমাকে এয়ারপোর্টে একটি ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হলো। অথচ যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। নিছক হয়রানি টাইপের কিছু। পরে আমার সন্দেহ হয়েছিল। যে আমেরিকার ভিসার সঙ্গে এগুলোর একটা যোগসাজশ আছে।’ রনি বলেন, এমনকি আমাকে নেদারল্যান্ডসও ভিসা দিল না। অথচ নেদারল্যান্ডসের ভিসা না দেওয়ার কোনো কারণই ছিল না। দেখা গেল আমার বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুতে একটা গৃহবন্দি হয়ে পড়ে গেলাম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, আমি ভিসার জন্য কোনো দূতাবাসে যে আমি যাবো সে সাহসটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। ফলে ২০১৮ থেকে অদ্যাবধি দেশের বাইরে, কিন্তু এখন পর্যন্ত যাইনি। ফলে এখন যারা-ব্যবসায়ী, সাংবাদিকরা বড় বড় কথা বলছেন, এদের যে পরিণতি এখন পর্যন্ত কল্পনা করতে পারছে না, এর পরিধিটা যে কতদূর।’

সর্বশেষ

শুধু গোলাম মাওলা রনিই নয়, এমন ভিসাপ্রাপ্তদের রীতিমতো এখন নাভিশ্বাস। বলার আর অপেক্ষা রাখে না ভিসা নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের বহু মানুষ ইতিমধ্যে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। কে ভিসানীতিতে পড়েছে এটা আসলে প্রকাশ না করার নীতি মার্কিন দূতাবাসের। ফলে আসলে কে কে পড়েছে এর আওতায় তার বোঝা যাচ্ছে না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে। কারো কারো ফ্যামিলি, সন্তানও আমেরিকা থেকে ফিরে আসছে বলেও উড়ো খবর বা অসমর্থিত জোন থেকে খবর ভাসছে। এমনকি এ ভিসানীতিতে বাংলাদেশের বাইরে যারা আমেরিকা, যুক্তরাজ্য বা কানাডাসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশসমূহে রয়েছেন, তাদের জন্যও দুশ্চিন্তার কারণ। কখন কার ওপর এ নিষেধাজ্ঞা বর্তাবে সেটা কেউ জানে না। এতে করে এটা একরকম বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক, যারা দেশ ও বিদেশেও অবস্থান করছেন সবার জন্য দুশ্চিন্তা, বড্ড দুশ্চিন্তা।

শেয়ার করুন