ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর অভিযান চলাকালীন দৃশ্য
ডালাসে অবস্থিত ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর ফিল্ড অফিসের সামনে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ও ভয়াবহ ঘটনা। মানসিকভাবে অসুস্থ এক তরুণ বন্দুকধারী একটি ভবনের ছাদে উঠে গুলি চালাতে শুরু করেন। তার গুলিতে তিনজন হাতকড়া পরা অভিবাসী আহত হন, যাদের মধ্যে নরলান গুজম্যান-ফুয়েন্টেস ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল গার্সিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অন্যজন হোসে আন্দ্রেস বোর্দোনেস-মোলিনা এখনো হাসপাতালে ভর্তি। যদিও এ হামলার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এখনো পরিষ্কার নয়, ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত এটিকে ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং আইস-কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন-এর ফল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, ডেমোক্র্যাট নেতাদের বক্তব্যই ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আইনপ্রয়োগকারী সদস্যদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য দায়ী। এতে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসোমের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি আইস এজেন্টদের মাস্ক খুলে ফেলতে বলেছেন।
তবে বাস্তবতা আরো গভীর ও জটিল। কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য বা ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনা নয়, বর্তমান প্রশাসনের বাস্তব কর্মকাণ্ড এবং কৌশল অনেক বেশি মানুষকে উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আইসের কাজকর্ম এক ঐতিহাসিক মোড় নিয়েছে- যেখানে গণগ্রেফতার, ভীতিকর অভিযান, বর্ণভিত্তিক লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ এবং শাস্তিমূলক নীতি সাধারণ মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তাবোধ পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছে। এ গণপ্রত্যাবাসনের অংশ হিসেবে হাজার হাজার ফেডারেল এজেন্ট, ডিইএ, এটিএফ, এফবিআই স্থানীয় ও ছোটখাটো অপরাধ দমন না করে বরং অভিবাসীদের ধরতে নিয়োজিত রয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন শুধু অপরাধীদের নয়, কাজের স্থানে, রাস্তাঘাটে-এমনকি আদালতের বাইরে সাধারণ অভিবাসীদেরও লক্ষ্য করছে। বহু ক্ষেত্রে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে জাতি ও চেহারার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে নিজস্ব এজেন্টরাও স্বীকার করেছেন।
এ ধরনের দৃশ্য যেমন মুখোশধারী এজেন্টদের অচেনা ভ্যানে করে হোম ডিপোর মতো জায়গা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যাওয়া বা কাঁদতে থাকা পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা আমেরিকান সমাজে এক গভীর ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে এসব ঘটনার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর, সাধারণ মানুষ এখন এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে।
তবে সমস্যার গভীরতা এখানেই শেষ নয়। এসব অভিযান ও ধরপাকড়ের ফলে শুধু অবৈধ অভিবাসীই নয়, বৈধ অভিবাসী এবং মার্কিন নাগরিকরাও গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। জাতিগত প্রোফাইলিং এবং আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ বেড়েই চলেছে। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো জবাবদিহি নেই। বরং তারা এ বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার জন্য দায় চাপাচ্ছে মিডিয়া ও বিরোধীদের ওপর।
একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ঘটেছে নিউইয়র্ক ইমিগ্রেশন কোর্টে, যেখানে এক আইস অফিসার আদালতের ভেতরে একটি কাঁদতে থাকা নারীকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। পরে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এ ঘটনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে অফিসারকে সাময়িক বরখাস্ত করে। কিন্তু মাত্র তিনদিনের মাথায় সেই অফিসার আবার দায়িত্বে ফিরেন। এ ধরনের ঘটনায় স্পষ্ট যে, প্রশাসন নিজের বাহিনীকে কোনো জবাবদিহির আওতায় আনতে আগ্রহী নয়। এর ফলে জনগণের মাঝে আইস এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে। আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ গণপ্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বিষয়ে, যেমন রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ এবং শিশু শোষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকেও মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। এতে করে জাতীয় নিরাপত্তা এক ভয়াবহ সংকটে পড়ছে।
এছাড়াও এজেন্টদের আচরণ যেমন মুখ ঢেকে রাখা, পরিচয় গোপন রাখা, জাতিগত বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষকে থামানো-এগুলো পেশাদার আইনপ্রয়োগের পরিপন্থী। এতে মানুষের মাঝে ক্ষোভ আরো বাড়ছে এবং বহু মানুষ নিজ নিজ কমিউনিটি থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব প্রতিবাদ শুধু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নয়, বরং মূলত নিচু স্তর থেকে উঠে আসা মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
গণপ্রত্যাবাসনের এ বিপজ্জনক কৌশল শুধু অভিবাসীদেরই নয়, বরং আমেরিকার প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এমনকি ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও আইসের নিজস্ব কর্মকর্তারাও এখন ঝুঁকির মুখে। ডালাসের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে কোনো সময় ঘটতে পারে যদি প্রশাসন তার বর্তমান নীতি থেকে সরে না আসে।
সারসংক্ষেপে, ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি একটি বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে যা দেশকে বিভাজিত করছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা কমাচ্ছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এ গণভিত্তিক ধরপাকড়, ভয় দেখানো এবং জবাবদিহিহীন আচরণ চালু থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাস্তবতায় শুধুই আরো অস্থিরতা যুক্ত হবে।