২০ মে ২০১২, সোমবার, ০২:৩২:৪০ পূর্বাহ্ন


প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৫-২০২৪
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ ঢাকায় প্রচণ্ড গরম


প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। অবশ্যই এটা এমনিতেই তো হয়নি। এর মূল কারণ, মানুষের স্বেচ্ছাচার। যার সূত্র ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডেকে এনেছে। বিশ্বজুড়ে অনিয়ন্ত্রিত বৈষয়িক উষ্ণতা বৃদ্ধি, এর সঙ্গে বাংলাদেশে নির্বিচার বৃক্ষনিধন, জবরদখলের মাধ্যমে নদী, জলাশয়ের অপমৃত্যু ঘটনায় শীতকালে শীতের তীব্রতা, গ্রীষ্মে তাপদাহ এবং বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি বন্যার কবলে পড়ে বাংলাদেশ এখন গভীর সংকটে।

২০২৪ সালের এপ্রিলে দেশে তাপদাহ নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। অনেকের ধারণা এবার অতিবৃষ্টির যে সম্ভাবনা, যার কারণে প্রলয়ঙ্করী বন্যা জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে। ইতিমধ্যে সিলেটে উজান তথা, পাহাড় থেকে ঢল নামতে শুরু করেছে। বৈষয়িক বিষয়গুলো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচার, সম্পদ অর্জনের লালসা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর যথাযথ পরিকল্পনা তথা মনিটরিং ব্যবস্থার অভাবে জাতীয় সংকটে পরিণত পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে এখন প্রয়োজন সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ। 

পরিবেশ রক্ষার জন্য জাতীয় আন্দোলন হওয়া বাঞ্ছনীয় বা বেগবান হওয়া উচিত। দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, দেশ না বাঁচলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ জীবন সব বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। অন্যসবের মতো সরকারেরই নিঃসন্দেহে এসবের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় দলমতনির্বিশেষে এক হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, মিডিয়াগুলোর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। দেশে বাস্তবায়িত অধিকাংশ মেগা অবকাঠামোগুলো পরিকল্পনাকালে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয়নি। নগরায়ণের অজুহাতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করে সবুজ শহর নগরগুলোকে কংক্রিটের জঙ্গল তথা, গ্যাস চেম্বার বানানো হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বহমান নদনদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত জলপ্রবাহ সংকুচিত করে রেখেছে। উপরন্তু একশ্রেণির উন্মাদ জমিখেকো নদী-জলাধার দখলদার সিন্ডিকেট নদী-জলাশয়গুলোকে অপমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। সীমিত সড়ক-মহাসড়কে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ফসিল ফুয়েল পুড়িয়ে পরিবেশদূষণ করছে। পরিস্থিতি এমন যে, বিচ্ছিন্নভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেই আশু মুক্তি মিলবে না। ঢাকা মহানগরীসহ পুরো দেশকে বিদ্যমান পরিবেশ দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগে জাতীয় মহাপরিকল্পনা গ্রহণ, সব স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করে পেশাদারদের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। 

দেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবুজায়ন করতে জনমত সৃষ্টি করতে হবে 

বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্রতম দেশ। কিন্তু এর রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। সীমিত এলাকায় বিপুল জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার অনেক চ্যালেঞ্জ। সবুজ বৃক্ষরাজি অক্সিজেন সরবরাহ করে, কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ ক্ষতিকর পরিবেশদূষণকারী গ্যাসগুলো শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একই সঙ্গে নদী, জলাশয়গুলো পরিবেশ সুশীতল রাখায় বিশাল ভূমিকা পালন করে। 

১৯৬০ সাল থেকে ঢাকায় ছিল সবুজের সমারোহ, নদী, খাল-বিলের কল্যাণে ঢাকা ছিল তিলোত্তমা শহর। আজও সে স্মৃতি ভাসছে চোখের সম্মুখে। স্বাধীনতার পর থেকেই অপরিকল্পিত নগরায়ণ তথা, শিল্পায়নের অশুভ প্রভাবে পরিবেশ ধ্বংস হতে থাকে। ঢাকা থেকে ক্রমাগত বৃক্ষরাজি নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়। চারপাশে বহমান নদীগুলো জবরদখল হয়। ঢাকার বুকে বহমান খালগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। কোনো ধরনের বিল্ডিং কোড না মেনে অসংখ্য পরিবেশ বিধ্বংসী বহুতল অট্টালিকা গড়ে ঢাকাকে গ্যাস চেম্বার বানানো হয়েছে। আধুনিক নগরগুলোর নগরায়ণের বিচারে ঢাকার সব ধরনের নাগরিক পরিবেশের ক্ষমতা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ১ কোটি মানুষ বসবাস করা যুক্তিযুক্ত। সেখানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। 

নাগরিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর পক্ষে কোনোভাবেই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও শহরের অকল্পনীয় যানজট, শব্দজট, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সামান্য বৃষ্টি হলেই ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। অসংখ্য পরিবেশদূষণকারী যানবাহন ঢাকার বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলেছে। এই মহানগর তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়েছে নিজেদের ভুলে। সরকার, রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সুধীসমাজ, মিডিয়াগুলো সত্যিকারার্থে জনসচেতনা সৃষ্টি করতে পারেনি। ১৯৭০ দশকে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুলালালামপুর ঢাকা থেকে ভিন্ন ছিল না। এখন ওই শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকার তুলনায় হতে পারে না। 

তবু যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঢাকাসহ বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে সরকারকে অবশ্যই পরিবেশ বিপর্যয়কে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে জাতিকে সংঘবদ্ধ করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দেশকে সবুজায়ন করতে সর্বত্র পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক বনজ, ফলদ এবং ভেষজ বৃক্ষ রোপণ করে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। পরিকল্পিত পন্থায় পরিবেশসম্মত উপায়ে নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন করতে হবে। নদী-জলাধার সংরক্ষণ এবং দূষণমুক্ত রাখার জন্য নিবিড় মনিটরিং করতে হবে। ঢাকাসহ সব মহানগরী এবং শহরগুলোতে চলাচলকারী পরিবেশদূষণকারী যানবাহন পরিবেশবান্ধব যানবাহন দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। 

সর্বোপরি নগর-গ্রামাঞ্চল নাগরিক রিভার্স মাইগ্রেশন সৃষ্টি করে নগরীর জনসংখ্যা ধারণক্ষমতায় সীমিত করতে হবে, সেক্ষেত্রে গ্রামগুলোতে শহরের নাগরিক সাবিহা সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামগুলোর উন্নয়ন সর্বোতভাবে সবুজ উন্নয়ন হতে হবে। কেবল জনগণের কাছে দায়বদ্ধ প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই এটি সম্ভব।

শেয়ার করুন