০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:২৯:৩১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


কোটা সংস্কার আন্দোলনে পশ্চিমা ইন্ধন সন্দেহে হার্ডলাইনে সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৭-২০২৪
কোটা সংস্কার আন্দোলনে পশ্চিমা ইন্ধন সন্দেহে হার্ডলাইনে সরকার কোটা আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা


শেষ পর্যন্ত সংঘাতে রূপ নিল কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন। গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার এ রিপোর্ট লেখাঅব্দি সর্বশেষ তথ্য মিলেছে তাতে দেখা গেছে যে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন ঘিরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ২ জন (সিটি কলেজ এলাকায়), চট্টগ্রামে ৩ জন ও রংপুরে ১ জন রয়েছেন। একই সঙ্গে এ ঘটনায় সাড়ে তিনশত’র মত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ হামলায় আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর বদলে ক্ষমতাসীন দলের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগকে সর্বমহল দায়ী করেছে। কিন্ত প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি আলোচনার ঝড় বইছে- কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন কেনো সরকার এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? কেনো এমন মারমুখী আচরণ করছে? কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারীদের নিয়ে কিসের ভয়ে ভীত ক্ষমতাসীন সরকার? 

২০১৮ সালের প্রথম কোটাবিরোধী তুমুল আন্দোলনের পর সরকার একতরফভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে কোটা তুলে দেয়। এটা নিয়ে সরকারের অনেক প্রশংসা এই ছাত্ররাই করেছে। অর্থ্যাৎ ২০১৮ সালে নির্বাহী আদেশে বাতিল হওয়ার আগে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা ছিল অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক- যা সরকার নৈতিকভাবেই স্বীকার করেছিল। সম্প্রতি এই কোটা ইস্যুতে ছাত্ররা আবার মাঠে নেমেছে। 

কারো কারো মতে, এত দিন শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঁধা না দিয়ে সহযোগিতা করেছে সরকার। বলা যায় সরকারের প্রচ্ছন সমর্থনই দৃশ্যমান ছিল। অনেকেই মনে করেছে ছাত্র আন্দোলন বান্ধব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকে পেছনে কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজপথে নামিয়েছে। কেননা কোটা সংস্কার দাবিতে এবারের আন্দোলন শুরু হয়েছে ঠিক ভারতের সঙ্গে ১০ চুক্তি সইয়ের পর থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে গতমাসে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যান। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটি প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। এসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে ১০ চুক্তি সই করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বৈঠকে এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তির পরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় মাঠের সবক’টি বিরোধী দলই বলেছেন, ভারতের সঙ্গে করা সমঝোতা চুক্তিগুলোর অর্থই হচ্ছে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে নির্ভরশীল করে ফেলা। বলা হয় চুক্তির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে ভারতকে রেল করিডর দেওয়া, যেটা বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগবে না। একথাও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে নয়াদিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কী ধরনের বোঝাপড়া, সম্মতি বা চুক্তি করেছেন, সেগুলো প্রকাশের দাবি জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। জোটের নেতারা বলেছেন, দেশের সংবিধান অনুসারে অন্য দেশের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক করতে হলে তা দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করা জরুরি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে জনগণকে আড়ালে রেখেই এ ধরনের চুক্তিগুলো করা হয়। জাতিকে অন্ধকারে রেখে পর্দার আড়ালে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি জনগণ মানবে না- রাজনৈতিক মাঠে যখন এমন হুঙ্কারে ক্ষমতাসীন ছাড়াও এব্যাপারে যাদের সায় রযেছে তারা বিপাকে পড়ে। একারণে কারো কারো মতে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন দিয়ে এটা ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে সরকারের বা অন্য কারোর পরামর্শে। কেননা ভারতের সাথে চুক্তির খবরের পাশাপাশি দেশে একের পর এক দুর্নীতির ভয়াবহ খবরও প্রকাশিত হচ্ছিল যার পেছনে সরকারের রাঘব বোয়ালরাই জড়িত। আবার এসব রাঘব বোয়ালরাই খুব সুন্দরভাবে দেশ ত্যাগও করে ফেলে, যা নিয়ে সরকারে বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে নানান ধরনের সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। আর এই ধরনের বিষয়গুলি যেনো ঢাকা পড়ে যায় সেজন্যই কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনে সরকার সায় দিয়েছে বলে এতদিন সবাই ধারণা করেছিল। কারো কারো এগুলি ছাড়া সরকারের মৌন সম্মতি অবশ্যই ছিল এমন আন্দোলনে। 

প্রথমে সহানুভুতি পরে এ্যাকশন

কিন্তু হঠাৎ গত কয়েকদিনে সরকারের চেহারায় উদ্বেগের ছায়া লক্ষ্য করা গেছে। দেখা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার হঠাৎ কোটা সংস্কার দাবিতে সরকার যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলে সহানুভুতি দেখিয়েছে তার বিরুদ্ধে বেঁকে বসেছে। শুধু তাই নয় নিজ দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে লেলিয়ে দিয়েছে। রীতিমত ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্তপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। কিন্তু কেনো? কেনো কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারীদেরকে প্রতিপক্ষ ভাবছে সরকার?

আন্দোলনে পশ্চিমাদের প্রতি সন্দেহ

কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন নিয়ে সরকারের নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে বেশ কয়েকটি কারণে। এমন আন্দোলনে সরকারের ছাত্র সংগঠন জড়িয়ে পড়েছে বা ফেলা হয়েছে অদৃশ্য কোনো কারণে। দেখা গেছে যে, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যেমনি হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, তেমনি এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গণহারে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। 

শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার প্রতিবাদে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গণহারে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এর বাইরেও বিভিন্নস্থানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পদত্যাগের খবর আসছে। যা ক্ষমতাসীনদের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে, ঠেকেছে রহস্যময়। 

অন্যদিকে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনের কয়েকদিন আগে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক আন্দোলনে নামে। ফলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একধরনের টেনশন দেখা দেয়। ক্ষমতাসীদের কারো কারো সাথে কথা বলে জানা গেছে, কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা নেপথ্যে। ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ নেতাদের ধারণা কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনে পেছনে পশ্চিমাদের হাত আছে। আছে আরো অন্য কোনো দেশের ইন্ধন। 

কারণ পশ্চিমারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক সর্বোপরি বাংলাদেশে কার্যত তাদের মতো শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের ভূ-রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা নিয়েও পশ্চিমারা কঠোর নজরদারিতে রেখেছে বাংলাদেশকে। সম্প্রতি বাংলাদেশের চীন সফরে দৃষ্টি কাড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের। এমনকি আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নেতাদের চীন সফর নিয়েও কূটনৈতিক অঙ্গনে চলে নানামুখী আলাপ আলোচনা। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই দেশই ১৪ দল এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের চীন সফরের ব্যাপারে প্রখর দৃষ্টি রাখে। সম্প্রতি চীন সফর নিয়ে ভারতীয় পত্র-পত্রিকা অনেক বিরূপ মন্তব্য আওয়ামী লীগের নজর কেড়েছে। ভারতের পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন থেকে খালি হাতে ফিরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর থেকে নির্ধারিত সময়ের আগে ফিরে আসাতেও আলোচনা তৈরি করেছে। জানা গেছে, এসব বিষয় মাথায় রেখেই কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্নভাবে দেখছে। 

তবে ক্ষমতাসীনদের সন্দেহের তালিকায় পশ্চিমাদের পাশাপাশি আরো অনেক কঠিন গেম প্লেয়িং দেশের প্রতি। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে সম্প্রতি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুই’র একটি মন্তব্য। তার এই ধরনের মন্তব্যের আগে অনেকে মনে করতেন ফ্রান্সসহ অন্যান্য পশ্চিমারা বাংলাদেশে মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থেই বেশি আগ্রহ। বলা হয়েছিল দেশটি এয়ারবাস চুক্তি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশের প্রতি এরা আগ্রহী। কিন্তু ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুই সম্প্রতি এব্যাপারে খোলামেলাই সব বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। বাংলাদেশ কোন দিকে যায়, তা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী ফ্রান্স। এসব কারণ বিশ্লেষণ করেই হঠাৎ কঠোর হয়ে গেছে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে- এমন ধারণাও রাজনৈতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের।

শেয়ার করুন