৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:২৯:৫০ অপরাহ্ন


রিমান্ড রেখে হত্যা মামলার আসামী মুক্তি কিসের লক্ষণ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-১০-২০২৪
রিমান্ড রেখে হত্যা মামলার আসামী মুক্তি কিসের লক্ষণ আদালতে তোলা হচ্ছে সাবের হোসেন চৌধুরীকে


গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের করুণ বিদায়ের পর বেশ কয়েকবার প্রতিবিপ্লব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কঠোর হাতে কখনও ছাত্র জনতা, কখন সংশ্লিষ্ট স্থানের লোকজন সামাল দিয়েছেন। সর্বশেষ যেটা ছিল তা গার্মেন্টস সেক্টরে। তারও মোটামুটি অবসান। আশান্ত পাহাড়েও এখন আর্তনাত থেমে গেছে। সচিবালয়ে যে তোলপাড় চলছিল, সেটাও এখন আর নেই। তবে নির্বাহী মেজিস্ট্রেট উর্মির ইউনূসের বিরুদ্ধে যে বিষাদগার করে স্ট্যাটাস দেন ও কথাও বলেন সেটাতে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামীপন্থী যাদের উপর অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেরই ব্যাপক আস্থা তাদের কিছু কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ হতাশা ব্যক্ত করছে। 

বিগত হাসিনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী ৬ হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলায় আসামী সাবের হোসেন চৌধুরীকে আটকের দুইদিনের মাথায় রিমান্ড স্থগিত করে আদালতে তুলে ম্যাজিকাল জামিন প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটা মামলাই হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলা। এরপরও পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া ও রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ‘অসুস্থতার’ অজুহাত দেখিয়ে হাসপাতালে না নিয়ে সরাসরি মুক্তি দিয়ে দেয়া কিসের আলামত এটা নিয়ে তোলপাড়।

অবশ্যই শীর্ষ পর্যায়ের ইঙ্গিত বা নির্দেশনা ছাড়া ৬ হত্যা মামলার আসামীকে জামিন দেয়া হতো না। প্রশ্ন উঠেছে সাবের হোসেন চৌধুরী এতটাই পাওয়ার হোল্ড করেন দেশ ও বিদেশে তাহলে তাকে আটক করতে গেল কেন পুলিশ। কেনই বা তাকে আদালতে উঠনো হলো, রিমান্ড মঞ্চুর করা হলো। 

বিগত সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রীকে এখনও পুলিশ আটক করেনি। সাবেরকে সে তালিকাভুক্ত করে রাখা হলেও ঠিক ছিল। কিন্তু আটক করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আবার জামিন দিয়ে দেয়া কিসের ইঙ্গিত সেটাতে আতঙ্ক এখন জনমনে। 

ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষ বলতে শুরু করেছেন, যদি প্রভাবশালী মন্ত্রী বলে তাকে জামিন দেয়া হয় মুহূর্তেই, তাহলে আটক হওয়া প্রভাবশালী অন্যরাও বের হয়ে আসবে দ্রুত। এমনকি যারা আটক হননি, তাদের কাছেও ম্যাসেজ চলে গেছে যে এমন আটক ও জামিন হয়ে যাওয়া বা বিচার বিচার খেলা নর্মাল কোনো ইস্যু। শুধু এখানেই সব শেষ নয়, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, যারা আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী,আমলাদের যারা পালিয়ে ভারত গেছেন ভিসা ছাড়া, তারা যদি দেশে ফিরতে চান, তাহলে তাদের জন্য ট্রাভেল পাস ইস্যু করে দেবেন। 

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বময় শান্তির বার্তা ছড়িয়ে ব্যাক্তিজীবনে সফল হওয়া যাবে কিন্তু একটি দেশের প্রশাসনের শীর্ষে থেকে সমঝোতামূলক আচরণ, কী দেড় হাজারের উপর নিহত হওয়া ছাত্র জনতার রক্তের জবাব দেয়া কী সম্ভবপর হবে।

সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিএনপির কর্মী হত্যা মামলা যেমন রয়েছে, তেমনি জুলাই আগস্ট ছাত্র জনতার হত্যা মামলার আসামী হিসেবেও তার নাম রয়েছে। এমন একজন হত্যা মামলার আসামীকে কোনোরকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া দুই দিনের মাথায় ছেড়ে দেয়া বা জামিন দিয়ে দেয়া মুহূর্তেই তাও আবার রিমান্ড স্থগিত করে কিসের লক্ষন? 

ব্যক্তি সাবের হোসেনের অপরাধ নাও থাকতে পারে, সেটা আদালত বিচারের মাধ্যমে নির্ণয় করবেন। কিন্তু মেজিট্রেট মুক্তি দিয়ে দিলেন? অবশ্য মহামান্য হাকিম অভিজ্ঞ এবং তার অবশ্যই বিচারিক জ্ঞানসমৃদ্ধ। কিন্তু যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এক ঘটনায় বাংলাদেশে মামলা হওয়া এবং সেটার কোনো যথাযত সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া জেল হওয়া এক আসামীর (সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান) আদালতে আত্মসমর্পন করার পর কারাগারে পাঠাতেই যদি হয় অন্তর্বর্তী এ সরকারের আমলেই সে প্রেক্ষাপটে সাবের হোসেনের হত্যা মামলা ইস্যুর মূল্যায়ণ কী আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সমঝোতার নাটকের অংশ বিশেষ মঞ্চস্থ হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে? 

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারত পালিয়ে যাবার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এ দুইমাসে সরকার যেভাবে পরিচালিত করে দেশ তাতে সরকারের চরম দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে ইতিমধ্যে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের উর্দ্ধগতি প্রতিনিয়ত। বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে গা নেই সরকারের। বিগত কোনো সময় ডিমের ডজন ১৮০ টাকা হয়নি। সরকার সেটাকে কন্ট্রোল না করে উল্টা ৪ কোটি ডিম আমদানি অনুমতি দেয়ার পেছনে ওই দাম বৃদ্ধির কারসাজি কি না সেটা মানুষ বলতে শুরু করেছে।

পুলিশকে এ দুইমাসেও এখনও আগের মত সক্রিয় করা যায়নি। ফলে সেনাবাহিনীকে এখনও মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে। এভাবে কতদিন পুলিশের কাজ সেনাবাহিনী করবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। 

ইতিমধ্যে অন্তত দুই দফা সংলাপ সম্পাদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বিরোধী দলসমূহের সঙ্গে। সেখানে দলগুলোর দাবির সঙ্গে অন্তর্বর্তী ঐক্যমত প্রকাশ করলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন সামান্য। কিছুটা ঢিলেমি লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করা এক নির্বাহী মেজিস্ট্রেটের উদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা ও মন্তব্য যা সরকারি চাকরিজীবির নীতিবর্হিভূত হওয়া সত্ত্বেও সে কাজ করা কিছু একটা আলামত মনে হচ্ছে। এতটা নির্বোধ নন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এরপর জেনেশুনে প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি দেয়ামূলক মন্তব্য প্রশাসনে যে ঘাপটি মেরে থাকা ব্যাক্তিবর্গ সোচ্চার তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

যেসব অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের শিকার হতে হয়েছে এগুলোর মধ্যে বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলাচত্বরে হেফাজতের উপর গুলিবর্ষণ, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থ লোপাট, হত্যা, গুম খুন প্রভৃতি অভিযোগ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এসবে বিচার কার্য সম্পাদনে এখণ মনযোগ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে।

সদ্য কারামুক্ত সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান প্রশ্ন তোলেন, মানুষ এতদ্রুত দেড় সহস্রাধিক হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের নির্দেশনায় ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা এত দ্রুত কমে যায় কিভাবে? অন্তর্বর্তী সরকারও এ ব্যাপারে খুব একটা কথাবার্তা বলেনও না। 

মামলা হচ্ছে, কিন্তু তাতে আটকের সংখ্যা নগন্য। এরপর সাবের হোসেনকে জামিনে মুক্তি দেয়া মূলত জুলাই আগস্টের হত্যাকাণ্ড ইস্যু দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে বৈ কি! 

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের এমন দুর্বল কর্মকাণ্ডে অনেকেই সেনাশাসনের একটা আলামত লক্ষ্য করছেন। যদিও সে সম্ভাবনা নেই সংবিধানমতে। কিন্তু সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারেরও কোনো অস্তিত্ব নেই, যদিও কোর্টের একটি রেফারেন্সের ভিত্তিতে এটা হচ্ছে। 

সাবের হোসেনের এ জামিনে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে যে বিষয়টা এখন ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেটা হলো এখন সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি কর্মকর্তারা যারা কারাগারে তারা, দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসবেন? সাবের চৌধুরী যদি হত্যা মামলায় এত দ্রুত জামিন পান। একই রেফারেন্সে অন্য গ্রেফতারকৃত ভিআইপিরা শিগগিরই মুক্ত হবেন এই ধারণা অমূলক নয়। আরেকটা বিষয় সাবের হোসেন ওয়ান ইলেভেনেও সংস্কারপন্থী ছিলেন। মাইনাস টু ফর্মুলার অগ্র সৈনিক। যদিও সে ফর্মুলা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে শেখ হাসিনা কম ভোগান্তি দেননি সাবেরকে। ফলে সেই ব্যক্তির ব্যাপারে অতি আগ্রহ মানেই ‘ডাল মে কুচ কালা’ জাতীয় কিছু। 

জামিন হওয়ার বিবরণে জানা গেছে, খিলগাঁও থানায় করা চার মামলায় জামিন পেয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।

মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৪টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তাকে হাজির করে জামিন চেয়ে শুনানি করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী জামিন আবেদনের ঘোর বিরোধিতা করে শুনানি করেন।

শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান খিলগাঁও থানার চার মামলায় সাবের হোসেন চৌধুরীর জামিন মঞ্জুর করেন। আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ক্ষোভে আদালত থেকে বের হয়ে যান। একই সময়ে তড়িঘড়ি করে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক। এর ফলে বাকি মামলার শুনানি অপেক্ষমাণ থেকে যায়। মুহূর্তেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে আদালতপাড়ায়।

এর আগে গত ৭ অক্টোবর সোমবার বিকেলে পল্টন মডেল থানায় দায়ের করা বিএনপি কর্মী মকবুল হত্যা মামলায় সাবের হোসেন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে দেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে আসামিকে উপস্থিত করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর নাজমুল হাসান। এ সময় তিনি আসামির ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এদিকে আদেশের পর আদালত প্রাঙ্গণে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের মধ্যে মুহুর্মুহু ডিম নিক্ষেপ করে রীতিমতো গোসল করিয়ে দেওয়া হয় সাবের হোসেন চৌধুরীকে। তৎক্ষণাৎ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ চেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। আর পুরো সময়জুড়ে হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে সাবের হোসেন চৌধুরীকে।

মামলার এজহারের থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ের কর্মসূচি ঘিরে নেতাকর্মীরা রাজধানীর পল্টন এলাকায় জড়ো হতে থাকলে মামলার আসামিরা সমাবেশ বানচালের চক্রান্ত করে। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। আন্দোলন দমন করতে নির্বিচারে লাঠিচার্জ, ককটেল হামলা, টিয়ারসেল নিক্ষেপ, সাউন্ড-গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলিবর্ষণ করে। এতে বিএনপির কয়েকশো নেতাকর্মী আহত হন এবং মকবুল হোসেন নামক এক বিএনপি কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন, এজহারনামীয় আসামিদের অবস্থান শনাক্তকরণ ও মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিকে রিমান্ডে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন বলে জানায় পুলিশ।

রোববার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সর্বশেষ সংসদে ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।

এদিকে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার অব্যাহত আছে। বলা যায় গত কয়েকদিন ধরে গ্রেফতার কার্যক্রম চলছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। সাবের চৌধুরীর জামিনের ঘটনায় তারাও খুশি হবেন। মানসিক স্বস্তি ফিরে পাবেন। যারা পালিয়ে আছেন তারাও মানসিক শক্তি পাবেন। যা প্রকারান্তে আওয়ামী লীগকে পুর্নবাসন করার আলামত মনে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। 

শেয়ার করুন