৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:১৭:২৫ অপরাহ্ন


সকলের কাছে দোয়া চাইলেন আলমগীর খান আলম
নীরবেরই মায়ের ছেলে মায়ের কোলে
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০২-২০২৫
নীরবেরই মায়ের ছেলে মায়ের কোলে আলমগীর খান আলম


নিউইয়র্কে যেন বজ্রপাত পড়ার মতো খবর। হঠাৎ করেই একেবারে নীরবে মায়ের ভালোবাসার টানে নিউইয়র্ক, তথা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিচিত ও প্রিয়মুখ ‘শোটাইম মিউজিক’-এর স্বত্বাধিকারী, বলা যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ধারক এবং বাহক, প্রবাসে ‘ঢালিউড ফিল্ম অ্যান্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’, ‘এনআরবি অ্যাওয়ার্ড’-এর প্রবর্তক আলমগীর খান আলম বাংলাদেশে চলেই গেলেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সকালে আমিরাত এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিনি বাংলাদেশে চলে যান। সাদালাপী এবং মিষ্টিভাষী আলমগীর খান আলম তার মাকে খুব ভালোবাসতেন। প্রতিদিনই মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন ফোনে। গর্ভধারিণী সেই মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেই পাগলের মতো ছুটে গেলেন বাংলাদেশে। বন্ধুবান্ধব কাউকে জানানোরও প্রয়োজনবোধ করেননি। অন্যদিনের মতো তার প্রিয় স্থান জ্যাকসন হাইটসে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে আড্ডাও দিয়েছেন, শাকিল মিয়া গ্রাফিকস ডিজাইনের অফিস আলমগীর খান আলমের প্রিয় জায়গার একটি। সেখানেও গেলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। শতব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন আলমগীর খান আলম তার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। গত দুইদিন তিনি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তার বড় ভাইকে ফোন দিয়েও মায়ের ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানতে পারেননি। তার বড় ভাই নিউইয়র্কের একজন সাংবাদিককে জানিয়েছেন, তার মা দুইদিন আগে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তার শরীরের দুই-তৃতীয়ংশ আগুনে পুড়ে গিয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মায়ের এ খবর তিনি তার ছোট ভাই আলমগীর খান আলমের কাছে লুকিয়ে ছিলেন। এরপর আলমগীর খান আলম কানাডায় বসবাসরত তার ছোট বোনের বাসায় ফোন করেন এবং কোনো না কোনোভাবে ৭ জানুয়ারি রাতে জানতে পারেন। তিনি জানতে পারেন যে, তার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালোে নয়। তাই তিনি ৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার সময় জ্যাকসন হাইটসের একটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে টিকেট কাটেন এবং পরদিন সকালের ফ্লাইটে বাংলাদেশে চলে যান। আলমগীর খান আলম প্রবাসে তার বন্ধুবান্ধবদের যেভাবে সারপ্রাইজ দিয়েছেন, বাংলাদেশে তার পরিবারকেও সারপ্রাইজ দিয়েছেন। তিনি যে বাংলাদেশে যাচ্ছেন, সেটা তার বড় ভাইকেও তিনি জানাননি। আলমগীর খান আলম সোজা গিয়ে হাসপাতালে তার মায়ের বেডে গিয়েছেন। নিজের ফেসবুকে শেয়ারও করেছেন। তার বড় ভাই জানালেন, তার মা নাকি আলমকে দেখে খুশি হয়েছেন এবং বলেছেন, এতোদিন আসতে বললাম আসলি না, এখন আমি হাসপাতালে আর তাই আসলি। অন্যদিকে আলমগীর খান আলম ঢাকা থেকে ফোন করে তার মায়ের সুস্থ্যতার জন্য সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি বলেন, আমি আমার মায়ের আগুনে পুড়ে যাওয়ার বিষয়টি জানার পর আর স্থির থাকতে পারিনি। যে কারণে কাউকে কিছু বলার সুযোগও পাইনি। এভাবে আমি চলে যাবো তা আমি নিজেও ভাবিনি কোনদিন।

জানা যায়, দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে নিউইয়র্ক প্রবাসী আলমগীর খান আলম। ১৯৯৪ সালে তরুণ বয়সে পড়ালেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন তিনি। স্থানীয় একটি কমিউনিটি কলেজেও পড়াশোনা করেছেন। তার ফেসবুক পেজে দেখা যায়, তিনি সিটি কলেজ, ঢাকা ও দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে পড়াশোনা করেছেন। তিনি তার কলেজের ছাত্রসংসদের নেতাও নির্বাচিত হয়েছিলেন। চাকরি করেছিলেন জিএনসি নামক একটি প্রতিষ্ঠানেও। ২০০৪ সালে ঢালিউড ফিল্ম অ্যান্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ ও ‘এনআরবি অ্যাওয়ার্ড’-এর অনুষ্ঠান চালু করে আলমগীর খান আলম কমিউনিটিতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। আর এ অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান ঘিরে বাংলাদেশর সিনেমা ও নাট্যজগতের বহু অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, গায়িকা তার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বলিউড ও কলকাতার নায়ক-নায়িকা ও গায়ক-গায়কীরাও। বিশেষ করেন বাংলাদেশের ও সংগীত জগতের দুই জীবন্ত কিংবদন্তি ও জনপ্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীনকে নিয়ে একত্রে এক মঞ্চে গানের অনুষ্ঠান আয়োজন ছিল তার সেরা আয়োজন।

প্রায় তিন দশক ধরে আলমের প্রবাস জীবনের সময়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তার অকস্মিক চলে যাওয়ায় তারা সবাই আলমের জন্য মনঃকষ্টে ভুগছেন। অনেকের নীরবে চোখের পানি গড়িয়ে পড়েছে। তারা আলমের এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলেন না। তারপরও তারা আলমগীর খান আলমের উজ্জ্বল জীবন এবং দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন। তবে আলম কাউকে কোনো সুযোগ দেননি, নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেলেন। অন্যদিকে প্রতি সমাজেই কিছু দুষ্টু মানুষ থাকে, তাদের কাজই হলো মানুষের সমালোচনা করা। সে রকম কিছু মানুষের আক্রোশের শিকারও তিনি হয়েছেন। কিন্তু কোনোদিন কারো সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেননি আলমগীর খান আলম। মিথ্যা সমালোচনা করেছেন হাসিমুখে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। অসম্ভব এ ভদ্র মানুষটি কিছুদিন আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন থেকেই তিনি ভিন্ন কিছু চিন্তা করছিলেন।

জানা গেছে, শনিবার আমিরাত এয়ারলাইনসের বেলা সাড়ে ১১টার একটি ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন আলমগীর খান আলম। এ সময় কোনো এক বাংলাদেশি তাকে দেখে তার বন্ধুবান্ধবদের জানালে খবরটি কমিউনিটিতে চাউর হয়ে যায়। চলতে থাকে সঠিক সন্ধানের। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় দিনভর চলতে থাকে আলমকে নিয়ে নানা কথা। ফলে খবরটি ‘টক অব দ্য কমিউনিটি’তে পরিণত হয়। অবিবাহিত আলম নিউইয়র্কে একাকী জীবন কাটালেও একাধিকবার তার বিয়ের গুঞ্জন উঠলেও তিনি অবিবাহিত ছিলেন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিয়ে করে সংসার করারও। কিন্তু ব্যাটে বলে হয়নি।

এদিকে আলমগীর খান আলমের চলে যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেনেই অনেক কথা লিখছেন, বলছেন। প্রসঙ্গে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আবিদ রহমান লিখেছেন: ‘আপন সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বীর বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। অভিনন্দন অবিরাম ভালোবাসা।’

ফটোসাংবাদিক নিহার সিদ্দিকী লিখেছেন: মায়ের অসুস্থতার জন্য চার ঘণ্টার নোটিশে বাংলাদেশে চলে গেলেন বহির্বিশ্বের জনপ্রিয় প্রমোটার আলমগীর খান আলম। তার এই চলে যাওয়া বন্ধু মহল এবং শিল্পীদের মনে বেদনার সৃষ্টি করেছে। গত ৭ জানুয়ারি (শুক্রবার) রাত ১০টা পর্যন্ত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে তার প্রিয় জায়গা গ্রাফিক্স ওয়ার্ল্ডে দেখা গেছে। 

বাংলাদেশ সোসাইটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক অনিক রাজ লিখেছেন: আলম ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয় যখন আমার অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যান জ্যাকসন হাইটস। গতকাল (শুক্রবার) জুমার নামাজ পড়ে দেখা হলে বলি আলম ভাই চলেন একসঙ্গে লাঞ্চ করি। খুবই ভারাক্রান্ত মনে হলো, বললেন রাতে আসবো। রাতে এলেন তখনও মন খারাপ। পরে ভাইয়ের (শাহ নেওয়াজ) সঙ্গে শেষ কথা হয় গতকাল ১২টার (রাত) দিকে। সকালে এরকম একটা খবর শুনে ঘুম ভাঙবে ভাবতেও পারিনি। মনটাও খুবই খারাপ। তারপর থেকে ফোন আসতেই থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। নিজের রক্তের না হলেও আলম ভাই অসুস্থ হওয়ার পর থেকে কেন জানি আগের থেকে একটু বেশিই আমার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে এবং আলম ভাই অনেকটা চুপচাপ হয়ে যান। আপনি নিজেও জানেন না মানুষ কত ভালোবাসে আপনাকে। এতো ফোন পেয়েছি। আপনি অনেক কিছু দিয়েছেন বাঙালি কমিউনিটিকে। আপনার অবদান অনেক। আলম ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন।

বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক কর্মকর্তা আহসান হাবীব লিখেছেন: মায়ের টানে একজন সজ্জন নির্মোহ ও নিভৃতচারী মানুষের নীরব প্রস্থান। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে লিখতেও পারছি না। অভিমানে নীরবে এভাবেই স্বদেশের উদ্দেশে চলে গেলেন ভাই! ভালো থাকুন আলম ভাই। আপনার সহচার্য খুবই মিস করবো। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। কিছু ভালোবাসার সত্যিই প্রতিদান হয় না। আপনার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অবিরাম। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। 

‘ওই আস্তাবলের মাথায় যে আকাশটা, ওরই ওপারে পূর্বদিকে বহুদূরে তাহাদের নিশ্চিন্দিপুর। আজ কতদিন সে নিশ্চিন্দিপুর দেখে নাই-

তি-ন বছর! ক-ত-কা-ল!

সে জানে নিশ্চিন্দিপুর তাকে দিনে রাতে সব সময় ডাকে,

শাঁখারীপুকুর ডাক দেয়,

বাঁশবনটা ডাক দেয়,

সোনাডাঙ্গার মাঠ ডাক দেয়,

কদমতলার সায়েবের ঘাট ডাক দেয়’

(পথের পাঁচালীর) অপুর তিন বছর অসীম মহাকালের অন্তহীন চক্রে হয়তো অতিনগণ্য। কিন্তু ভাগ্যান্বেষণে স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন দেশে পাড়ি জমানো কোনো প্রবাসীর অস্থির অনুভবে ৩০ বছরের ব্যাপ্তি অপরিমেয়। এখানে ঝলমলে হাসি, ঝিকিমিকি সুখ আর জমকালো আনন্দের মধ্যেও কি যেন নেই। দিনের অবসরে অবর্ণনীয় এক শূন্যতা, রাতের নীরবতায় এক বুক হাহাকার..

‘কুল ছেড়ে এসে মাঝ দরিয়ায়

পিছনের পানে চাই,

ফেলে আসা তীরে, কি মায়া যে টানে

মন বলে ফিরে যাই-সব সময়। সব সময়।

শেয়ার করুন