বিএনপিকে ভয়াবহভাবে মিডিয়া ট্রায়ালে ফেলার আবারও চক্রান্ত শুরু হয়েছে। দলীয় কোন্দল, বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন স্থানে চাঁদাবাজির পাশাপাশি কতিপয় নেতার মেজাজ হারিয়ে ফেলা বক্তব্যকে পুঁজি করা হচ্ছে। বিএনপি বিরোধী কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পাল্লা দিয়ে বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালে ফেলে রাজনৈতক অঙ্গনের নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হচ্ছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আরো পরে আয়োজনের একটি সুস্পষ্ট ক্ষেত্র তৈরি করা। একই সঙ্গে এই দীর্ঘ সময়ের ফাঁকে বা গ্যাপেই মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে দলটির ইমেজে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব তথা জানা গেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে।
দলীয় কোন্দল হাইলাইট হচ্ছে
বিএনপির ইমেজে বড়ো ধরনের ধাক্কা দিতে বেশি বেশি করে নেতিবাচক সংবাদকেই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- বিএনপি’র কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি। আছে সিনিয়র জুনিয়র নেতাদের মধ্যে মারাত্মক বিরোধ। দেখানো হচ্ছে মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা। আর এসব নেতিবাচক খবর দিয়ে বলা হচ্ছে এমন পরিস্থিতির কারণে গত আট মাসে সংর্ঘষে বিএনপি’র নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। হয়েছেন শত শত আহত। আর এমন সব খবরকে কখনো সর্ট ভিডি-ও বা টিকটক বানিয়ে বিএনপি’র বিরুদ্ধে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করা হচ্ছে।
প্রচার করা হচ্ছে বিএনপি সংস্কারবিরোধী
বিএনপি কোনোভাবেই সংস্কার চায় না। দলটি চায় যেনোতেনভাবে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় বসে যেতে। প্রচার করা হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই লুটপাটে ব্যস্ত বিএনপি। বলা হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে লুটপাট করে দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। বিভিন্ন গণমাধ্যম, টক শো, সোস্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করা হচ্ছে দলের চাঁদাবাজ, শৃংখলাবিরোধীদের বিরুদ্ধে বিএনপি’র হাই কমান্ডের নেয়া ব্যবস্থা লোক দেখানো। বলা হচ্ছে চাঁদাবাজ, শৃংখলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য এখন যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সব্বাইকে ক্ষমতায় বসেই বুকে টেনে নেয়া হবে। রাখা হবে জামাই আদরে। আবার বলা হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তাদের সাথে গোপনে দলের শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ ঠিকই আছে।
বিএনপি মৌলবাদির আস্তানা
খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘেঁটে এখনো দেখা যায় যে বিএনপিকে একটি পক্ষ বাংলাদেশে মৌলবাদিদের আশ্রয় প্রশয়দাতা বলে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী ও এর পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দলগুলির সাথে আঁতাত করে ক্ষমতা আসতে চায়। অভিযোগ করা হচ্ছে মূল বিএনপি ছাড়াও দলটির কেনো অঙ্গসংগঠনেও অন্য ধর্মের লোকজনকে কমিটির শীর্ষ পর্যায়ে রাখা হয় না। এমনকি এমন অভিযোগ করা হচ্ছে যে বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী খুবই শক্তিশালী ও বেশ সক্রিয়।
সামনে আরও চক্রান্ত
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামনের দিনে বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালে ঘায়েল করে ফেলতে আরও বড় ধরনের চক্রান্ত করা হচ্ছে। এজন্য ওই রাজনৈতিক দলটি একটি অত্যন্ত স্মার্ট, দক্ষ আইটি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাচ্ছে। দেশে এবং প্রবাসে তারা কাজ করবে। একটি সূত্র জানায়, আগামীতে সবদিকে থেকেই মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে বিএনপি’র বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হবে। এজন্য ব্যবহার করা হবে জনপ্রিয় গণমাধ্যমে, টক শোসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে। সেখানে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হবে ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপি যে লুটপাট, খোনাখুনি শুরু করেছে, তার চেয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস সরকারই ক্ষমতায় থাকা ভালো হবে। আর এসব বক্তব্য দেয়ার জন্য বিএনপি বিরোধী রাজনৈতিক দলটি বিভিন্ন ধরনের কৌশলও নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তথাকথিত জাতীয়তবাদী আর্দশে বিশ্বাসী বলে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক জনপ্রিয় ব্যক্তিদের চড়াদামে তাদের মেধা-মননকে কিনে কিংবা ভুল বুঝিয়ে, টোপ দিয়ে বিএনপি’র বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। এ কাজে তারা নিজেদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে কৌশলে বিএনপি বিরোধী ওই রাজনৈতিক দলটি ঢুকে পড়েছে। তারা ওইসব গণমাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ঘরনার পরিচয় দিয়ে ঢুকে এখন খুবই কূটকৌশলে বিএনপি’র বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা জোরদার করছে বলে শোনা যাচ্ছে।
বিপরীতে বিএনপি’র প্রতিক্রিয়া
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমন চক্রান্ত ও প্রচার প্রপাগান্ডার বিপরীতে বিএনপি’র প্রতিক্রিয়া খুব জোড়ালো না। বিএনপি’র একটি সূত্র জানায়, সাচ্চা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জাতীয়তাবাদী সমর্থকরা এখনো মিডিয়া ট্রায়ালের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কিছুই করছে না, বা বুঝে উঠতেই পারছে না। একারণে তারা বিএনপি’র বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়ায়লকে আমলেই নিচ্ছে না। তাদের ধারণা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার বিএনপি’র বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না-যে কারণে তারা যেন গভীর নিদ্রায় রয়েছেন।
শেষ কথা
ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন জনের লেখায় যা জানা গেলো তা হলো, মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে খুব সহজ কথায়, কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং বিচারিক রায় ঘোষণার আগেই সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণ তার বিরুদ্ধে একধরনের রায় দিয়ে ফেলেন। জনসাধারণের দেওয়া সেই রায় ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেও যেতে পারে, আবার পক্ষেও যেতে পারে। সাধারণত সোস্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত জনসাধারনের মতামত, তাদের লেখা বিভিন্ন স্ট্যাটাস এর মধ্যে পড়ে। এই ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে অভিযুক্ত যে কেউ আদালতে বিচারের রায় ঘোষিত হবার আগেই জনতার আদালতে বহুভাবে এবং বিচিত্রভাবে রায়ের সম্মুখীন হন। এতে করে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে মর্যাদা ক্ষুন্ন হবার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মনে গভীর রেখাপাত করে। অতীতে দেখা যায় বিএনপি এমনই মিডিয়া ট্রায়ালে পড়ে দলটির খোদ শীর্ষ নেতার ইমেজ ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছিল। ২০০৭ সালের গণমাধ্যমের খবরে দেখা দেয় সেই সময়ে মিডিয়া ট্রায়ালের ন্যাক্কারজনক শিকার হয়ে বিএনপি নেতারা ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়েছিল। মিডিয়া ট্রায়ালের কারণেই ২০০৭ সালের ৭ মার্চ কোনো ধরনের মামলা ছাড়াই তৎকালীন সেনা সমর্থিত মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের ওয়ান-ইলেভেনের সরকার জরুরি বিধিমালায় তারেক রমহানকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। এরপর থেকেই তারেক রহমানের চরিত্র হননে হেন প্রচারণা না যে চালানো হয়নি। অথচ সেই আমলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরে টাস্কফোর্স, এনবিআর, দুদকসহ সরকারের সব সংস্থা অনুসন্ধান করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অথবা অবৈধ সম্পদ অর্জনের কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তবে তারেক রহমানকে এরপর থেকে ‘টেন পার্সেন্ট’ বা ‘খাম্বা তারেক’ বলে নেতিবাচক বিশেষণে হাজির করতো পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার অর্থানুকূল্যে বেড়ে উঠা বুদ্ধিজীবী ও একশ্রেণীর গণমাধ্যম কর্মী। আর এখনো এমন অবস্থা বা পরিস্থিতির মারাত্মক ফলাফল আঁচ করতে পেরেই বিএনপি শীর্ষ পর্যায় থেকে কিছু সর্তকমূলক বক্তব্য বা মন্তব্য করা হয় মাত্র কয়েকদিন আগেই খোদ দলটির হাই কমান্ড থেকে। বলা হয় যে, এক-এগারোর সময়কার মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। সম্প্রতি এমন অভিযোগটি করেছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছিলেন নির্বাচনে জেতার জন্য বিএনপির যত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তত বেশি বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তারেক রহমানের এমন বক্তব্যের পরও বিএনপি’র পক্ষ থেকে সেই মিডিয়া ট্রায়ালের বিরুদ্ধে দলটির কোনো পর্যায়ে নেতকর্মী রুখে দাঁড়ায়নি। শোনা যায়নি বা যাচ্ছে না যে মিডিয়া ট্রায়াল রুখে দিতে তরুণ সাচ্চা জাতীয়তবাদীদের নিয়ে একটি চৌকস প্লাটফরম তৈরি করা হয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, যত বলা হউক না কেনো একটি সাচ্চা জাতীয়তবাদীদের নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল রুখে দিতে একটি প্লাটফরম তৈরি করতে আসলে-ই কিন্তু বিএনপি’র পক্ষে সম্ভব হবে না। কেননা সেখানেও ওই ঘাপটি মেরে থাকা সেই রাজনৈতিক দলটির পক্ষে সুবিধা নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম কর্মী বা তথাকথিত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরাই কৌশলে ঢুকে যাবে। বিএনপি’র এই নেতার মতে, খোদ বিএনপি হাইকমান্ডের আশে পাশে এখনো ওই শক্তিটিই ঘুরে-ফিরেই বিচরণ করছে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি’র বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল রুখে দিতে দলটি কতটা সফল হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাবে।