যুক্তরাষ্ট সুপ্রিম কোর্ট গত ২৭ জুন এক ঐতিহাসিক রায়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশগুলোর বিরুদ্ধে ফেডারেল বিচারকদের যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী স্থগিতাদেশ জারির ক্ষমতা সীমিত করেছে। ৬-৩ ভোটে গৃহীত এই রায়ে বলা হয়েছে, এখন থেকে ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারকরা শুধু মামলার বাদী পক্ষের জন্যই রায় দিতে পারবেন, আর পুরো দেশের জন্য সর্বজনীন নিষেধাজ্ঞা (ইউনিভার্সাল ইনজাংশন) জারি করতে পারবেন না। এই সিদ্ধান্তের ফলে কোনো ফেডারেল নীতিকে আর একযোগে সারাদেশে স্থগিত রাখা সম্ভব নয়। যদিও আদালত জন্মসূত্রে নাগরিক বাতিল করেনি বা ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের নির্বাহী আদেশের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত রায় দেয়নি, তবে এই রায়ের ফলে বিতর্কিত সেই আদেশটি আংশিক বাস্তবায়নের পথ খুলে গেছে।
রায়ে বিচারপতিরা বিভক্ত ছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের পক্ষে থাকা বিচারপতি অ্যামি কনি ব্যারেট বলেন, যদি একজন গর্ভবতী অভিবাসী মা মামলার বাদী হন এবং তার সন্তানের বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশ প্রয়োগ না হয়, তবে সেই বাদী সম্পূর্ণ আইনি সুরক্ষা পাচ্ছেন। আর সেই সুরক্ষাকে সবাইকে দেওয়া আদালতের বাধ্যবাধকতা নয়। অন্যদিকে বিচারপতি সোনিয়া সোটোমায়োর তার বিরোধী মতামতে বলেন, এই রায়ের ফলে মনে হচ্ছে, সংবিধানিক অধিকার এখন শুধু মামলার পক্ষভুক্তদের জন্য প্রযোজ্য, যা আমেরিকার সমতা এবং ন্যায়বিচারের মূল চেতনাকে দুর্বল করে।
রায়ে সরাসরি জন্মসূত্রে নাগরিকত্বকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়নি, ফলে এই অধিকার এখনো কার্যকর আছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায় ভবিষ্যতে ১৪তম সংশোধনীর নাগরিকত্ব ধারা নিয়ে নতুন করে আইনি লড়াইয়ের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এখন আদালতের ওপর নির্ভর করছে তারা এই মামলাগুলোকে ক্লাস অ্যাকশন হিসেবে গ্রহণ করে কি না, যার মাধ্যমে বৃহৎ জনগোষ্ঠী একসঙ্গে ন্যায়বিচার চাইতে পারে। বর্তমানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে একই দিনে জন্ম নেওয়া শিশুদের নাগরিকত্ব ভিন্নভাবে নির্ধারিত হতে পারে শুধু তারা কোন রাজ্যে জন্ম নিয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। যেমন-ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেওয়া শিশুকে নাগরিকত্ব দেওয়া হতে পারে, কিন্তু টেক্সাসে জন্ম নেওয়া আরেক শিশুকে সেই স্বীকৃতি না-ও দেওয়া হতে পারে।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো শিশুর বাবা-মা বৈধ অভিবাসন অবস্থানে না থাকেন, তবে সেই শিশু জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হবে না। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর সরাসরি বিরোধী। ১৪তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করে বা প্রাকৃতিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিক হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিচারিক ক্ষমতার আওতাভুক্ত, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। রায়ের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় একে সংবিধান, ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং আইনের শাসনের জন্য এক বিশাল জয় হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই রায় তার প্রশাসনের অভিবাসন ও নাগরিকত্ব নীতিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তনের পথে আরো গতি দেবে।
রায় অনুযায়ী, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ কার্যকর হওয়ার জন্য ৩০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ে মূল মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টে চলবে। তবে এই রায়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে জন্ম নেওয়া শিশুদের নাগরিকত্বের আইনি অবস্থান ভিন্ন হতে পারে। এই পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানিক কাঠামোর জন্য এক বিপজ্জনক অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের সূচনা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্রেনান সেন্টার ফর জাস্টিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আইনজ্ঞ ওয়েন্ডি ওয়েইজার বলেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের যে কোনো প্রচেষ্টা গতকাল যেমন অসাংবিধানিক ছিল, আজও তেমনি। সুপ্রিম কোর্টের রায় কেবল আদালতের ক্ষমতা সীমিত করেছে, কিন্তু সংবিধানিক সুরক্ষা এখনো অক্ষত আছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব, অভিবাসন নীতি এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা নিয়ে নতুন দ্বিধা ও আইনি অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে এখন একটি নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। ফলে আইনি সংজ্ঞা নয়, বরং বাসস্থানের ভৌগোলিক অবস্থান হয়ে উঠতে পারে নাগরিক হওয়ার মানদণ্ড। এই রায় একদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাহী ক্ষমতার পরিধি বাড়ানোর পথ খুলে দিলেও অন্যদিকে ১৪তম সংশোধনীর সর্বজনীন প্রয়োগ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। দেশের বিভিন্ন অংশে জন্ম নেওয়া শিশুদের নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা এখন এই আইনি লড়াই আরো জোরালোভাবে চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।