যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ‘ওয়ান বিগ, বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে একটি নতুন আইন গত ৪ জুলাই অনুমোদন করেছেন। আইনটি শুধু একটি বাজেট বিল নয়, বরং এটি আমেরিকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন, করনীতি, শিক্ষাঋত ও আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এই আইনটি বিশেষভাবে ফেডারেল পেলো গ্র্যান্ট নীতিমালার ওপর প্রভাব ফেলবে, যার ওপর নির্ভর করে দীর্ঘদিন ধরে লাখো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভ করে আসছে। নতুন বিধিনিষেধের ফলে সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা কঠোর হয়ে যাবে এবং অনেক শিক্ষার্থী আগের মতো সহজে আর্থিক সহায়তা না-ও পেতে পারেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিবর্তন শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াবে। যদিও প্রশাসনের দাবি আইনটি শিক্ষাখাতে দায়িত্বশীলতা ও ফলাফলভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করার কথা বলছে, সমালোচকরা এটিকে শিক্ষার ব্যয় বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টির একটি মাধ্যম হিসেবে দেখছেন।
এই আইনের আওতায় ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ফেডারেল পেলো গ্র্যান্ট নিয়মকানুন, যোগ্যতা, সহায়তার পরিমাণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক সংস্কার কার্যকর হবে। এতে সরাসরি প্রভাব পড়বে লাখ লাখ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীর ওপর, যারা এতোদিন ফেডারেল পেলো গ্র্যান্টের ওপর নির্ভর করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতেন।
নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষার্থী যদি অন্যান্য উৎস থেকে যেমন স্কলারশিপ, স্টেট গ্র্যান্ট, ৫২৯ সেভিংস অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি থেকে এমন সহায়তা পান যা তার শিক্ষার মোট খরচের সমান বা তার চেয়েও বেশি হয়, তাহলে সে শিক্ষার্থী পেলো গ্র্যান্টের জন্য আর যোগ্য হবেন না। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর মোট আর্থিক সহায়তা যদি ‘কস্ট অব অ্যাটেনডেন্স’-এর সমান হয়ে যায়, তাহলে পেলো বাতিল হয়ে যাবে। এই বিধানটি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন সব পরিবারের জন্য, যারা বিভিন্ন উৎস থেকে সহায়তা জোগাড় করে সন্তানদের কলেজে পাঠিয়ে থাকেন।
পেলো গ্র্যান্টের সর্বোচ্চ পরিমাণ যদিও এখনো ৭ হাজার ৪৯৫ ডলার রয়ে গেছে, তবুও নতুন নিয়ম অনুযায়ী অনেক শিক্ষার্থীর অনুদান আংশিক হারে কেটে নেওয়া হবে। কারণ অন্যান্য সহায়তা বিবেচনায় এনে পেলো নির্ধারণ করতে হবে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ সহায়তা না পেয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে বাধাগ্রস্ত হবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে চাপ বাড়াবে এবং শিক্ষার্থীদের ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াবে।
নতুন আইন অনুযায়ী ‘ডাবল ডিপিং’ বা একই শিক্ষার্থীর জন্য একসঙ্গে পেলো ও ওয়ার্কফোর্স পেলো গ্র্যান্ট নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। অর্থাৎ কেউ যদি একই সঙ্গে কলেজের ডিগ্রি প্রোগ্রাম এবং স্বল্পমেয়াদি কোনো টেকনিক্যাল বা ট্রেড কোর্সে ভর্তি থাকেন, তাহলে তিনি কেবল একটি উৎস থেকেই সরকারি অনুদান নিতে পারবেন। এতে করে দ্বৈত কোর্সে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সীমাবদ্ধতা তৈরি হবে।
তবে এই আইনের একটি ইতিবাচক দিক হলো ওয়ার্কফোর্স পেলো গ্র্যান্টের পরিধি সম্প্রসারণ। আগে যেসব প্রশিক্ষণমূলক কোর্স ১৫ সপ্তাহের কম ছিল না, এখন ৮ সপ্তাহ হলেই সেই কোর্সে পেলো পাওয়া যাবে, যদি সেটি ইন-ডিমান্ড পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলে ট্রেড স্কিল, অ্যাপ্রেন্টিসশিপ বা কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থীরা দ্রুত সহায়তা পেতে পারবেন এবং দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারবেন।
অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর কঠোর মূল্যায়ন চালু করা হচ্ছে। যদি কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের গড় আয় হাই স্কুল পাস না করা কর্মীদের চেয়েও কম হয়, তাহলে সে প্রতিষ্ঠান ফেডারেল সহায়তা হারাবে। এই নিয়মটি দুর্বল ফলাফলের কলেজ, বিশেষ করে ফর প্রফিট কলেজ ও কিছু কমিউনিটি কলেজকে লক্ষ্য করে প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি বছর তাদের গ্র্যাজুয়েটদের আয়-সংক্রান্ত তথ্য হালনাগাদ করে জমা দিতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপ করা হয়েছে আরো কঠোর দায়বদ্ধতার শর্ত। ‘গেইনফুল এমপ্লয়মেন্ট রুল’ এখন কেবল ফর প্রফিট কলেজ নয়, বরং সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি বছর গ্র্যাজুয়েটদের গড় আয়ের তথ্য জমা দিতে হবে।
এই আইনে গ্র্যাজুয়েট প্লাস লোন সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে এবং ফেডারেল শিক্ষাঋণের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার, ডলার যা উচ্চ খরচের পেশাগত কোর্স যেমন মেডিকেল বা আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে। ফলে তারা হয় বেসরকারি ঋণের দিকে ঝুঁকবেন, নয়তো উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নিরুৎসাহিত হবেন।
বর্তমান ইনকাম-ড্রিভেন রিপেমেন্ট পরিকল্পনাগুলো যেমন- সেভ, পে-ই, রি-পে-ই, ধাপে ধাপে বন্ধ করে দিয়ে চালু করা হবে নতুন রিপেমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স প্ল্যান এবং ইনকাম-বেসড রেপেমেন্ট। রিপেমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স প্ল্যানে মাসিক আয় অনুযায়ী ১-১০ শতাংশ হারে ঋত পরিশোধ করতে হবে এবং ৩০ বছর পর ঋত ক্ষমা হবে। ইনকাম-বেসড রেপেমেন্টের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হারে পরিশোধের ভিত্তিতে ২০ বছরে ঋত মাফ হবে। তবে আর্থিক সংকট বা বেকারত্বের ভিত্তিতে আগে মতো ডিফারমেন্ট ও ফরবিয়ারেন্স সুবিধা বাতিল করা হয়েছে; এখন কেবল সীমিত মেয়াদের ‘জেনারেল ফরবিয়ারেন্স’ বিদ্যমান থাকবে।
পাবলিক সার্ভিস লোন ফরগিভনেস প্রোগ্রামেও বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন থেকে কেবল রিপেমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স প্ল্যানের আওতায় করা পেমেন্টগুলোকেই ১২০ মাসের গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ফলে যারা আগে সেভ বা পে-ইতে অংশগ্রহণ করছিলেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে রিপেমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স প্ল্যানে স্থানান্তর করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আর্থিক সচেতনতা বাড়াতে কলেজগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি ট্রেনিং’ দিতে হবে, যাতে বাজেটিং, ঋত ব্যবস্থাপনা, স্ক্যাম প্রতিরোধ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মতো বিষয় শেখানো হয়। একই সঙ্গে, প্রতিটি কোর্স রেজিস্ট্রেশনের সময় কলেজগুলোকে টেক্সটবুক ও শিক্ষাসামগ্রীর খরচ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
একটি বড় উদ্যোগ হিসেবে চালু হচ্ছে, কলেজ ভ্যালু ড্যাশবোর্ড, যেখানে প্রতিটি কলেজের গ্র্যাজুয়েশন রেট, গড় আয়, চাকরির হার ও শিক্ষার্থীদের গড় ঋণের তথ্য ফেডারেল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হলো, নতুন আইনে ফরবিয়ারেন্স এবং ডিফারমেন্ট সুবিধা কার্যত বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে বেকারত্ব, অসুস্থতা বা আর্থিক সংকটের সময় শিক্ষার্থীরা সাময়িকভাবে ঋত পরিশোধ বন্ধ রাখার সুযোগ আর পাবেন না। আগে যেখানে শিক্ষার্থীরা এই পরিস্থিতিতে সাময়িক ছাড় পেতেন, এখন তাদের নির্ধারিত সময়মতো ঋত পরিশোধ করতেই হবে, যা অনেকের জন্য চরম চাপের কারণ হবে।
এসব পরিবর্তনের ফলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, শিক্ষাখাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো বেড়ে যাবে এবং উচ্চশিক্ষা অনেকের জন্য কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা হয় উচ্চশিক্ষা থেকে ছিটকে পড়বে, নয়তো অতিরিক্ত ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াবে। যদিও আইনটির উদ্দেশ্য দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা, বাস্তবে তা কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব হবে-তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। বাস্তবে এই আইনের প্রভাব কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হবে, তা নির্ভর করবে পরবর্তী দুই বছরে নীতিমালা বাস্তবায়নের ধরন, কলেজগুলোর অভিযোজন এবং শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির ওপর।