০৪ মে ২০১২, শনিবার, ১০:৫৫:৪৮ পূর্বাহ্ন


স্বাগতম হে মাহে রমজান
আহবাব চৌধুরী খোকন
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৪-২০২২
স্বাগতম হে মাহে রমজান


বছর ঘুরে আবারো ফিরে এসেছে রহমত, বরকত ও নাজাতের পুণ্যময় মাস মাহে রমজান। মুসলমান মাত্র প্রত্যেকের জীবনে এই মাসের গুরুত্ব অনেক বেশি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই মাসে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকেন। মুসলিম দেশগুলোতে রমজান মাস নিয়ে আসে ভিন্ন এক পরিবেশ। অনেকটা উত্সব আমেজে ধনী -গরিব নির্বেশেষে সকল মানুষ উদযাপন করে এই মাসটি।

আমি ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, তাতে আমার নিকট মনে হয় রমজান মাস মানে উত্সব। ছোটবেলায় দেখতাম, মাসজুড়ে বাড়িতে থাকতো মায়ের হাতে তৈরি সুস্বাদু খানাপিনার আয়োজন। যখন গ্রামে ছিলাম, তখন সাহরির সময় ঘুম ভাঙতো শিঙ্গার আওয়াজ শুনে। গ্রামে দেখতাম, একদল মানুষ সারারাত না ঘুমিয়ে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতো আর সাহরির সময় শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে রোজাদার মানুষকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করতো। শিঙ্গা মহিষের শিং দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ জিনিস। এটিতে মুখ দিয়ে ফুঁ দিলে প্রচণ্ড শব্দ হয়। আবার ঢাকায় থাকতে দেখেছি, অনেক এলাকায় রমজান মাসে সাহরির সময় লোকজন দলবেঁধে রাস্তায় হ্যাজাক লাইট নিয়ে নেমে পড়ে এবং জোরে জোরে কোরাস গান গেয়ে মোমিন মুসলমানদের ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করে। এভাবে উত্সাহী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তত্পরতায় রমজান মাস আমাদের দেশে উত্সবের মাসে পরিণত হয়। রমজান মাসে এভাবে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এই প্রবাস জীবনে রমজানকে ঘিরে আমার সেই অভ্যাসে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। রমজান মাস এলে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে থাকি। রাতে ব্রঙ্কসে পার্কচেষ্টার মসজিদে তারাবির নামাজে দেখা হয় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সাথে। প্রতিদিন থাকে কমিউনিটির কোনো না কোনো সংগঠনের ইফতার পার্টি। এই সকল ইফতার পার্টিতে উপস্থিত হলে সারাদিনের কান্তি ও অবসন্নতা দূর হয়ে যায়। রমজান মাসে মসজিদগুলো নতুন সাজে সজ্জিত হয় এবং হাজারো মুসল্লির উপস্থিতিতে ভরপুর হয়ে ওঠে। এভাবে তারাবির নামাজে ব্যাপক মুসল্লির সরব উপস্থিতি এবং ইফতারের সময় মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার ও রেস্টুরেন্টে আয়োজিত ইফতার পার্টি আমাদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ়তর করে। রমজান মাসে রোজা রাখার উপকারিতার কথা চিকিত্সাবিজ্ঞানও অনুমোদন করেছে। তাছাড়া এই রোজা পালনের মাধ্যমে কেউ চাইলে অনেক বদঅভ্যাস ত্যাগ করতে পারে। 

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রমজান বা রোজা অন্যতম। আল্লাহপাক রমজান মাসকে সিয়াম পালনের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সিয়াম আরবি শব্দ ‘সওম’ থেকে আবিষ্কৃত। ‘সওম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পাপাচার ও পানাহার থেকে বিরত থাকা হচ্ছে সিয়াম। সিয়ামকে ফরাসি ভাষায় রোজা বলা হয়। রমজান মাসের কদরের রাত হাজার রাত অপো উত্তম একটি রাত। এই রাতে মানব জাতির মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন আল্লাহপাক মানব জাতির জন্য নাজিল করেছিলেন। রমজান শেষে আসে ঈদুল ফিতর। এই ঈদুল ফিতরের পূর্বে অবস্থাসম্পন্ন ধনী লোকদের জন্য আল্লাহপাক সদকা ও ফিতরা ফরজ করেছেন। ইসলামের একটি মহত ও কল্যাণকর ব্যবস্থা হচ্ছে এই সদকা ও ফিতরা ব্যবস্থা। আল্লাহপাক এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে অবস্থাসম্পন্ন সচ্ছল ব্যক্তিদের সম্পদের ওপর গরিব মানুষের হক প্রতিষ্ঠা করেছেন। আল্লাহপাক ধনী সম্প্রদায়ের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব মানুষের জন্য সদকা হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ধনী-গরিব সবাই যাতে একসাথে ঈদ আনন্দে শরিক হতে পারে, সে জন্য আল্লাহপাক এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে, তাদের ওপর ফিতরা এবং সেই সাথে সদকা ফরজ করা হয়েছ। আল্লাহর এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির কথা আল্লাহপাক নিজে ঘোষণা করেছেন। সদকা ও ফিতরা দুটি পৃথক জিনিস। এটা গরিব মানুষের প্রতি ধনী মানুষের করুণা নয়, বরং আল্লাহ প্রদত্ত একটা সুষম ব্যবস্থা। তাই শুধু রমজান মাসে রোজা রাখলেই হবে না, সময়মতো সম্পদের জাকাত ও ঈদের পূর্বেই ফিতরা দিতে হবে। এ বছর একটি কঠিন সময়ে পুণ্যময়ময় মাস রমজান এসেছে আমাদের জন্য। একদিকে প্রকৃতি সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি করোনার দখল, অন্যদিকে ইউক্রেন ও রাশিয়া সৃষ্ট যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক গতি দুর্বিষহ করে তুলবে জনজীবন। দেশে এই সময়ে অনেকেই অনাহারে ও অর্ধাহারে দিনানিপাত করছে। আমরা যদি এই সকল ভাগ্যাহত মানুষের কান্না ও আর্তনাদ না শুনি, তাহলে আমাদের সিয়াম পালন হবে না। তাই এই সময়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের উচিত। আমাদের যাদের ওপর জাকাত ফরজ রয়েছে, তাদের উচিত এই চরম খারাপ সময়ে আদায় করা।

আবার রমজান মাসে দেখা যায়, কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিম্নআয়ের মানুষকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে নিপতিত করে। কেউ সুলভ মূল্য প্রবর্তনের নামে দোকানের পচা ও মেয়াদোত্তীর্ণ মাল চালিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালান। অথচ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও অবৈধ মজুদদারিকে ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। রমজান মাসে বিশেষ করে ইফতার ও সাহরিতে ব্যবহৃত খাদ্যসামগ্রীতে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ল করা যায়। অনেক মুসলিম দেশগুলোতে যেখানে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়মতার মধ্যে নিয়ে আসে, সেখানে আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা রমজান মাস এলে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ খোঁজে। আমাদের দেশে কিছু ব্যবসায়ী সারাবছর রমজান মাসের জন্য অপো করে এবং বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট তৈরি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে। অসত ব্যবসায়ীদের এমন কর্মকান্ডের ফলে রমজান মাস এলে শুধু মুসলমান রোজাদাররাই নন, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মহল বিশেষের এমন তত্পরতায় রমজানের প্রকৃত শিা ব্যাহত হয়। আসুন, এবারের রমজান মাসে সকল পাপ ও অপকর্ম থেকে আমরা নিজেদের বিরত রাখি যে শিা রমজান মাস আমাদের দিয়েছে। সকলকে রমজানুল মোবারকের শুভেচ্ছা। স্বাগতম হে মাহে রমজান। 

লেখক: কলাম লেখক ও কমিউনিটি নেতা, নিউইয়র্ক

শেয়ার করুন