২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৬:১৭:৫০ অপরাহ্ন


নিউইয়র্কে সুরের মূর্ছনার অন্যরকম রাত
ইমন শুধু গাইলেন না মূল্যবোধের কথাও বললেন
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-১০-২০২২
ইমন শুধু গাইলেন না মূল্যবোধের কথাও বললেন ইমন চক্রবর্তীকে ক্রেস্ট প্রদান করছেন আলমগীর খান আলম


নিউইয়র্কের প্রকৃতিতে শীতের আগমনী ধ্বনি শুনতে গিয়ে প্রবাসীরা যখন গ্রীষ্মকালের বিদায় প্রস্ততি নিচ্ছিলো, ঠিক তখুনি সুরের অপার্থিব উষ্ণতা যেন ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্ম নেয়া এবং বর্তমানে কলকাতা নিবাসী ধ্রæপদী কণ্ঠশিল্পী ইমন চক্রবর্তী। গত ৯ অক্টোবর রাতে এই বাণিজ্যিক শহরের উডসাইডস্থ কুইন্স প্যালেস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইমন চক্রবর্তীর একক সংগীতানুষ্ঠান। এই সংগীতানুষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সমাজের জন্য সুস্থ এবং শুদ্ধ সংগীতের ‘মাইলফলক’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সংগীত যে শুধু আনন্দের বিষয় নয় বরং উপলব্ধির বিষয় এবং মানবিক বোধের স্তর কার কতটুকু আছে বা নেই- এটাও যেন আত্মজিজ্ঞাসায় জেনে নেয়া। গানের সুর, কণ্ঠ, গায়কী, গানের কথা, গানের বিষয় এবং কেন এমন গান ইত্যাদি প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা নিজেরাই হই কি? অনুষ্ঠানে ইমন চক্রবর্তী এই প্রশ্নগুলো কথার মায়াজালে পাখির পালকের মতো স্পর্শ করে গেছেন সমবেত দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে। তিনি অসাধারণ এবং অতুলনীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুধু ‘অমিত সুধা’ই ঢেলে দেননি, দর্শক-শ্রোতার অনুভবের অতলে একরাশ আবিষ্টতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি গানে গানে অন্যরকম এক রাত উপহার দিয়েছেন এবং সংগীতের আলাপচারিতায় মানুষের মনুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধের কথাও বলেছেন নির্মোহভাবে। এ কারণে সংগীতপ্রিয়দের কাছে অনবদ্য সন্ধ্যায় পরিণত হয় এদিনের সন্ধ্যা। অনুষ্ঠানে সমবেত দর্শক-শ্রোতাদের সংখ্যা আরো বেশি হলে ভাল হতো, কিন্তু এই শহরের বাঙালি সমাজে সংগীতের সমঝদার লোকের সংখ্যা কত-তা অনুমেয়। ‘লারে লাপ্পা, বা চাকবুম চাকবুম’ গান বা নাচের প্রতিনিয়ত প্রদর্শন এবং চর্চা এই শহরে চলে আসছে। যখন প্রবাসীরা এমন নিম্নমানের অনুষ্ঠান দেখে অভ্যস্ত হতে বাধ্য, সেখানে পরিশীলিত বা শৈলিতাপূর্ণ সংগীত আসরে, উপস্থিতির কম-বেশি নিয়ে কারো আফসোস থাকে না। এমন একটি চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন শো-টাইম মিউজিক অ্যান্ড প্লে’র কর্ণধার আলমগীর খান আলম। এমন অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার জন্য তাকে সমবেতরা বিশেষ সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য অনুষ্ঠানের খরচ উঠে না আসার ‘ঝিনুক নীরবে সহো’র মতো হাসি উপহার দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানে ইমন চক্রতর্বী রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে তাঁর সুরের পেন্ডারা খোলেন। এরপর নানা বিষয় বৈচিত্র্যের গান তিনি পরিবেশন করেন। লালন, বাউল, আধুনিক গান, সিনেমার গান, গজল, পাহাড়ি গান এবং দুয়েক ছত্র হিন্দি গানও পরিবেশন করেন। গানে ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা, কিছু গানের অন্তর্নিহিত অর্থের কথা এবং গানের কী মহিমা-তা তুলে ধরেন।

তিনি জানান তাঁর পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের কুমিল্লার এবং তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের শুরু হয়েছে ঢাকায়। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর টানের কথা বলেন। এক পর্যায়ে নিজেকে বাংলাদেশি বলেও অভিহিত করেন। তিনি বাংলাদেশে শুঁটকি মাছের প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা বলেন এবং কলকাতায় তাদের যে ‘বাঙাল’ বলে- এটা রসিকতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের লোক ও বাউল গান শচীন দেব বর্মণ যে, ভারতের সংগীতে তুলে অন্যরূপ দিয়েছেন, গানে গানে ও কথাও বলেন ইমন চক্রবর্তী। মিসিসিপি নদীকে নিয়ে গাওয়া পল হারপারের গাওয়া গানও ওল্ডম্যান এবং পরবর্তীতে ড. ভ‚পেন হাজারিকার গাওয়া ‘বিস্তীর্ণ দু’পাড়ের অসংখ্য মানুষের হাহাকার নিয়ে’ গানটির মর্মকথা বলেন। এই গান সমসাময়িক ঘটনার জন্যও বিশেষ, তা উল্লেখ করে বাংলা, ইংরেজি হিন্দি ভাষায় পরিবেশন করেন তিনি। গানটি পরিবেশনের সময়কালে সমবেত দর্শক-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধই থাকেননি, তারা কণ্ঠও মেলান শিল্পীর সঙ্গে। গানটি পরিবেশন শেষে ইমন বলেন, এই গানটি শুনলে আমি নিজের মধ্যে শক্তি ফিরে পাই। তিনি বলেন, আমরা আজকাল একে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে চাই না। আমরা নদীকে কুলষিত করছি, মানুষকে পদার্থ ভাবছি। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কোনোদিকে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, গান শুধু আনন্দ আর ফুর্তির বিষয় নয়। টানা দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠানে তাঁর শেষ গান ছিল প্রাক্তর ছবি গান ‘তুমি যাকে ভালোবাসো’। এই গানটি শেষ করার পর ইমন চক্রবর্তী সমবেতদের উদ্দেশ্যে বলেন, যে কোনো সম্পর্কে চিড় ধরলে, জোরেশোরেই তা বলে দেবেন। নতুন করে আবার স্টার্ট করবেন। তবে আমি চাই, কাউকে যেন এমন কথা বলতে না হয়। 

অনুষ্ঠানে ইমন চক্রবর্তীর সঙ্গে গিটার বাজিয়েছেন সৌমেন মুখার্জী ও বিভাস চক্রবর্তী, তবলায় সঙ্গত করেন রামকৃষ্ণ দাস, ড্রাম বাজিয়েছেন রক্তিম চক্রবর্তী এবং কিবোর্ডে ছিলেন অয়ন মুখার্জী। 

অনুষ্ঠানে ইমন চক্রবর্তীকে ‘শো-টাইম মিউজিক অ্যান্ড প্লে’র পক্ষ থেকে ক্রেস্ট উপহার দেন আলমগীর খান আলম, উৎসব ডটকমের প্রেসিডেন্ট রায়হান জামান এবং রাহাত মোস্তাদির।

শেয়ার করুন