২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০১:০৭:৪২ অপরাহ্ন


ট্রিগারও চেপেছে, কিন্তু আল্লাহর রহমতে গুলি বের হয়নি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২২
ট্রিগারও চেপেছে, কিন্তু আল্লাহর রহমতে গুলি বের হয়নি হাবিবুর রহমান হাবিব


স্মৃতিচারণে হাবিবুর রহমান হাবিব

হাবিবুর রহমান হাবিব। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য  তিনি সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যন্ত সপরিবার মোহাম্মদপুরে একটি ভাদা বাসায় থাকেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন। '৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অগ্রনায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব। শহীদ জেহাদের লাশ কাঁধে নিয়ে ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে আরেক পর্যন্ত মিছিল করেছেন। ছাত্রদের দাবি আদায়ে কারও রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি তিনি। '৯৬ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। বিএনপি চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়ার স্নেহধন্য হাবিবুর রহমান হাবিব তারই (খালেদা জিয়া) অনুরোধেই বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। সম্প্রদি তার স্মৃতিচারণটি নিয়েছেন দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি । 

আমরা রাজনৈতিক জীবনটা আসলে ঘটনা বহুল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথা। এমন কারো জীবনে ঘটেছে কি-না আমার জানা নাই। কিন্তু ঘটনাটা হল আমি কিভাবে আহত হলাম, কিভাবে প্রাণে বেচে গেলাম।  এটাতো অবশ্যই আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। 

আমার সুবিধা ছিল তখনকার ঐ এলাকার অনেক পুলিশ কর্মকর্তা আমার পূর্ব পরিচিত ছিল। কারা একসময়ে ছাত্রলীগ করত। এজন্য আমার নির্বাচনী এলাকায় কোনো ঘটনার ঘটার ব্যাপারে আগাম তথ্য পেয়ে যেতাম। ঘটনা টা হলো ২০১৮ সালের ২৪ কি ২৫ ডিসেম্বর হবে। ঐ সময়ে একজন ছাত্রলীগ নেতা এসে আমাকে বলেন, আপনিতো নির্বাচন করতে পারবেন না। আমি জানতে চাইলাম কেনো? আমাকে জানাল তারা পাবনার উধ্বতন পুলিশ প্রশাসন আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। এতে বলা হয় ২৪ থেকে ২৫ কেন্দ্রের ভোট আগের দিন রাতে কেটে ফেলতে হবে। এমন নির্দেশ দিয়ে গেছে তারা। নির্দেশ মত আটঘড়িয়ায় প্রায় চল্লিশ ভাগ ভোটের আগের রাতেই কেটে রাখতে হবে। এব্যাপারে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যদিকে নির্দেশ দেয়া হয় ইশ^রদি দুই উপজেলার ৩৫টা ভোট কেন্দ্রের একটি বড়ো অংশের ভোট কেটে রাখবে ভোটের আগের রাতেই। সেখানেও চল্লিশ ভাগ ভোট আগেই কেটে রাখতে হবে। এসব খরব ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে জানিয়ে দিয়েই সর্তক করে দেয়। যেহেতু একসময়ে ছ্রাত্রলীগ করতাম সে হিসাবে তারা হয়ত আমাকে বলে গেছে। আমি ওদের পাল্টা জানিয়ে দিলাম ঠিক আছে চল্লিশ ভাগের বেশিতো কাটবে না? ষাটের বেশি আসনের তো ভোট আগের রাতে কাটবে না?  যাও আমি তোমাদের ভোট কাটাকাটি মেনে নিলাম। তোমাদের এই কর্মের পক্ষেই রায় দিলাম। আমি ভেবে দেখলাম ১২৯ কেন্দ্রে আগের দিন ৪০ভাগ ভোট কেটে রাখলেও আমি জিতে যাবো। আমি একটা হিসাব করে দেখলাম বাকি ষাট ভাগ কেন্দ্রের ভোটেই আমি জিতে যাবো। কিন্তু দেখা গেলো এরা রাতে চল্লিশভাগ ভোট না ইচ্ছামত ভোট কেটে ফেলেছে। দুই চারটা বাধে সব কেন্দ্রের ভোটই কেটে ফেলা হয়েছে। আমার বাড়ির আসে পাশে কয়েকটা কেন্দ্র বাকি রেখেছে ।  আমি তখন সেই উধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন দিলাম। বললাম ভাই আমি এখন অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে (পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী) আসনের বিএনপির প্রার্থী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা) । তাকে বললাম কথাতো ছিল ষাটটি কেন্দ্রের ভোট কাটা হবে। বাকিগুলিতে জনগণ ভোট দিবে বলেই জানতাম। আর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এখন। প্রথমে সেই পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করে ন যে ভোট ডাকাতি হচ্ছে। পরে বারবার ফোন করার পর বললো ভাই এখানেই না সারা বাংলাদেশেই এমনভাবেই ভোট হচ্ছে। এইচ টি ইমামের নির্দেশেই এমনটা করা হচ্ছে বলে জানায় সে পুলিশ কর্মকর্তা। এই সে এইচ টি ইমাম যিনি পনের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বঙ্গভবনে শপথ পরিচালনা করেছিলেন। আর ২০১৮ সালে যিনি সরকারে উপদেস্টা ছিলেন তিনিই এবুদ্ধি সরকারকে দিয়েছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন। তারই বুদ্ধি যে প্রশাসনকে দিয়ে ভোট কাটাতে হবে। একাজে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জড়িত করেন তিনি। তখন প্রশাসন একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে এনির্দেশ পালনে। আর এমন ঘোষনার কথাও শোনা গেলো ১০০শতভাগ ভোট কে কাস্ট করতে পেরেছে তাকেও নাকি পুরস্কৃত করা হবে। সে হিসাবে তাদের দায়িত্ব পরে গেলো পাবনার পাচটা আসনই সরকারি দলকে জিতিয়ে দিতে হবে। আমার এলাকায় একটা আশঙ্কা ছিল প্রশাসনের যে এখানে কারচুপি করে হারিযে দেযা হলে এলাকার জনগণ মানবে না। কিন্তু ্ওই পুলিশ কর্মকর্তা সাফ জানিয়ে দিল যে তার আর করার কিছুই নাই। এটা সারা বাংলাদেশেই হচ্ছে। 

এবার আসি মুল ঘটনায়। ২০১৮ সালে পাবনা-৪ আসনে (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী হিসাবে আমি আমার নির্বাচনী প্রচারণায় নামি। আমার নেতৃত্বে ২৬ ডিসেম্বর পূর্বনির্ধারিত গণসংযোগ শুরু করি। সেখানে একটা বড়ো টেক্্রাটাইল মিল ছিল। আলহাজ্জ টেক্্রটাইল মিল। এখানে স্কুলও ছিল। সে মিলের মাঠে আমি আমরা লোকজনকে বললবা তোমরা ওখানে থাক। আমি ঐখানের পুরো এলাকায় গণসংযোগ করবো সারাদিন। খাওয়া দাওয়া হবে নির্বাচনী প্রচারণা পাশাপাশি। কিন্তু আমাকে দু’তিনদিন আগেই সর্তক করা হয। বলা হয় আমাবে মেরে ফেলা হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই সাবধান করে দেয়া হয়। বলা হয় সিদ্ধান্ত ফাইনাল যে আমাকে মেরে ফেলা হবে। তাদের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে অবশ্য কারণ ছিল। তারা নানান ধরণের ক্যালকুলেশন করে দেখেছে পাবনা-৪ আসনে (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে আমাবে কোনোভাইে হারাতে পারবে না। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছি। ঢাকা শহরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ট্রাকের তলায় পিস্ট হয়েছি।  এরশাকে হটিয়েছি, ১৯৯৬সালে জনতার মঞ্চ করেছি। এখন গণতন্ত্র রক্ষায় নির্বাচন করছি। আমি সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভোট চাইতে যাবো না-এটা কি করে হয়? আমি জনগনের কাছে ভোট চাইতে পারবো নাÑ না যা কপালে থাকে থাকুক। কিন্তু এটা ঠিক আমার ওপর একটা আক্রমন হবে এটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু এসমস্ত ছেলেরা আমার ওপর এভাবে আক্রমন করবে তা বুঝি নাই। ধারণা ছিল হয়তো তারা সভা সমাবেশ করতে দেবে না, ভয় দেখাবে,ধাওয়া দেবে। এমন একটা সাধারণ আশঙ্কা ছিল। কিন্তু স্বপ্নেও কল্পনা করিনি যে আমার নিজের ওপর এমনভাবে আক্রমন হবে। যদিও হুমকি দেয়া হয় মেরে ফেলা হবে।তাও আমি গুরুত্ব দেয়নি। যাক এসব গুরুত্ব না দিয়েই আমি সেখানে যাই। যেতেই দলের একজন আমাকে বললেন হাবিব ভাই এদিকে আসেন। আমি গেলাম। কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললো যে হাবিব ভাই চলে যান। আপনাকে মেরে ফেলা হবে। আমি তারপরে বললাম জীবনে ঝুকি নিয়ে স্বৈরাচারকে হটিয়েছি। যা হয় হবে আমি ভোট চাইতে যাবোই। ভয় পেয়ে পিছু হটবো না। আমার তখন গাড়ি ছিলো সাথে। ইচ্ছা করলে ফিরে যেতে পারি বাড়ি। কিন্তু না এমন কাপুরুষ আমি না । না এমন চরিত্র আমার না। কেননা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও গোলাম ফারুক অভিদের সামনে ভয় পায়নি। তাদের ধমক দিয়েছি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তো সেসময়ে গুলি করে মেরে ফেলতো বিচার হয় না। কিন্তু তারপরেওতো কাউকে ভয় পাইনি। পিছু হটিনি। তাই ওদের বললাম যাবোই। কিন্তু কিছুদুর যেতেই দেখি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা এসে আচমকা হামলা চালানোর আগে প্রায় আমাকেও আমার কর্মীদের ঘিরে ফেলে। কারো হাতে রামদা। কারো হাতে বন্দুক পিস্তল। সব নিয়ে প্রচন্ড চিৎকার করে আমার দিকে কে কত  আগে পারে ছুটে আসছে হামলা করতে। আর কাছে এসে যেভাবে পারে অকথ্য ভাষায় তুই তুকারি করে গালি গালাজ করতে থাকে। মানে আমাকে কে আগে এসে আমাকে মারতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। আর গোলাগুলি তো শুরুই করে দিয়েছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমার আশে পাশে যারা ছিল তারাতো থাকতে পারলো না। গোলাগুরির কাছে কি কেউ টিকতে পারে? যে যেমনে পারলো এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগলো। এসময় আমি দৌড়ে পালালাম না। বরং তাদের মুখোমুখি হলাম। হাত উচিয়ে বললাম,এই কি করছো তোমরা। থামো। গুলি করছো কেনো? তখন তাদের কেউ কেই এই তুই নির্বাচন করতে পারবি না। ভাগ এখান থেকে। কেই বললো আপনি চলে যান। না হলে জ্যান্ত মেরে ফেলা হবে। এমস সময় দেখলাম আমার কপালে একজন পিস্তল ধরেছে। ট্রিগারও চেপেছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে গুলি বের হয়নি। আসলে আল্লাহর হুকুম ছ্ড়াাতো গুলিও বের হয় না। কারো মৃত্যুও হয় না। একসময় লক্ষ্য করলাম আমার মাথার দু’দিকেই পিস্তল ঠেকানো। এমন সময় দেখলাম রুটি শাহিন বলে ডাকে তাকে যা আমি পরে শুনেছি সে ছেলেটা ভবঘুরে টাইপের। সেই রুটি শাহিন একটা তলোয়ার বের করে একের পর এক কোপ মারতে লাগলো আমার দিকে। আমার গায়ে একটা জ্যাকেট ছিল । আর সে জ্যাকেটে নতলোয়ারের কোপটা বারবার পিছলে যাচ্ছিল। ছেলেটার উচ্চতায় আবাব আমার চেয়ে কম। তাই ও আমার মাথায় কোপটা দিতে পারছিলো না। তো এজন্য মাথায় ও জ্যাকেটের কারণে পিঠে কোপ লাগছিলো না। কোপ গুলি এসে পরে পায়ের দিকে পিছনে। আর সে কোপ এমন ভাবে পিছনে বিধছিলো প্রায় ছয় ইন্জি বিধে যাচ্ছিল। আমার তো বেচেই থাকার কথা না। আমার তখন রক্তে প্যান্ট ভিজে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি দাড়িয়েই আছি। দৌড়ও দিচ্ছি না। আল্লাহ আল্লাহ করছি যেনো পরে না যাই। এরপর দেখি আমার সামনে সাইডে ওরা ঘিরে আছে। পেছনে দেয়াল। তো একপর্যায়ে ওদেরকে পাশ কেটে পাশে একটা ক্ষেতের মতো আছে সেখানে একটা বাড়ি ছিল পেছনের দিকে না তাকিয়ে সেখানে যাই। আর দেখি সারা শরীর বেয়ে রক্ত পড়ছে। জায়গায় জায়গায় তা জমাট ও বেধে যাচ্ছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এরপর ওসি সাহেব আসে। আসলে স্থানীয় থানার সাথে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। আমরা যেখানে গণসংযোগ করবো বলে সিদ্ধান্ত নেই সেখান থেকে স্পটটা একটু দুরে ছিল। আসলে ঐ স্পটটা যে বদল হয়ে গেছে তা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে জানানো হয়নি। যাক ওসি সাহেব আসলেন ঘটনাস্থলে । তাদের গাড়ি করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানের কর্তব্যরত ডাক্তাররা আমার অবস্থা দেখে ভীত¯œÍ্রস্থ  হয়ে পড়েন। তারা আমাকে পাবনা সদর হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেয় একটা জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসার দেয়ার পর। যাক আমাকে পাবনায় সদর হাসপাতালে নেয়ার পর আমি আমার ছোট ভাই যে পরে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছিল তাকে ফোন করি। বলি আমি যেভাবে আহত হয়েছি তার চিকিৎসায় হেলিকপপ্টারের ব্যবস্থা কর।  আমি পাবনা বা রাজশাহীতে চিকিৎসার জন্য যাবো না । ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। তারপরেতো হেলিকপ্টার আসলো। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। তো দেখেন একজন প্রার্র্থীকে এভাবে মেরে ফেলার জন্য আক্রমনে ঘটনা পুথিবীর কোথাও হয়েছে?

শেয়ার করুন