০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ০৮:৪০:১৮ পূর্বাহ্ন


গায়েবি মামলায় রাজনৈতিক গ্রেফতার বাড়ছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-১২-২০২২
গায়েবি মামলায় রাজনৈতিক গ্রেফতার বাড়ছে


দেশে গত নভেম্বরে মিথ্যা মামলা-গায়েবি মামলা, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও পুলিশি বলপ্রয়োগের ঘটনা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা কথিত বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের ঘটনা বন্ধ হয়নি। পুলিশ বা কারা হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও হয়রানি অনেকাংশে বেড়েছে।  

এসব তথ্য উঠে এসেছে মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এবছরের নভেম্বর  মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে এটি তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা কিছুটা নিম্নগামী হলেও তা এখনও  উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। এছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বলে এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অপরদিকে গণপিটুনির মতো আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। একইসাথে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা জানায় এমএসএফ।  

গায়েবি মামলা ও সমাবেশে যোগদানে বাধা 

এমএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয় নভেম্বরে মাসে বিরোধীদল বিএনপির বিভাগীয় শহর বরিশাল, ফরিদপুর ও সিলেটের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানাবিধ কর্মকা- পরিচালনা করেছে যাতে করে বিরোধীদলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সভাস্থলে যেতে বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে পরিবহন খাতকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করে তথাকথিত মালিক ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট নেতারা তাঁদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে ধর্মঘটের নামে সড়ক ও নৌপথে  যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে নিজেদের পরিবহন ব্যবহার করে বিভিন্নস্থান থেকে সমাবেশে যোগদানের আসার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সরকারদলীয় কর্মীরা নানাভাবে বাধা প্রদান করে। যা ছিল চরমভাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন। পাশাপাশি সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন দেশের সাধারণ মানুষ। সমাবেশের প্রচারণায় বাধা প্রদান করা ছাড়াও গায়েবি মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় কর্মীদের এহেন বলপ্রয়োগ নাগরিক জীবনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করছে। পুলিশ বাহিনী সরকারদলীয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে কি না তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

সংবাদমাধ্যমে পাওয়া এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে মাসে শুধুমাত্র বিএনপির রাজশাহীর বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৪০টি কথিত গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে যার আসামি করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশি। এসময় ৫৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্রদল নেতা নিহত হওয়াসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ৭ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সহিংসতার শিকার হয়েছেন মোট ৫২৭ জন। যাদের মধ্যে ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহতাবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন, ৫১৭ জন আহত হয়েছেন। 

অপরদিকে ১৯ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে সিলেটের সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীরা লিফলেট বিতরণ শেষে একটি মিছিল বের করেন। সেই সময় পুলিশের গুলিতে রফিকুল ইসলাম ওরফে নয়ন মিয়া (১৮) নামের এক ছাত্রদল নেতা নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিএনপির দাবি ওসির সাথে বাগবিত-াকালে পুলিশের একজন কনস্টেবল সরাসরি নয়নকে গুলি করে।

৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ছাত্রদলের মশাল মিছিলের পর মিছিলকারীদের ওপর যুবলীগের হামলায় পালাতে গিয়ে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মো. অমিত হাসান (১৮) নামে এক ছাত্রদল নেতার মৃত্যু হয়।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড 

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা কথিত বন্দুকযুদ্ধের ৫টি ঘটনা ঘটেছে। কথিত গোলাগুলির দুটি ঘটনায় একজন যুবক ও একজন নারী নিহত হয়েছেন। দুটি ঘটনায় একজন রোহিঙ্গা নারী ও অপর তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। অপর একটি ঘটনায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) এক কর্মকর্তা নিহত এবং র‌্যাবের এক কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার চারটি অভিযোগের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। এ ধরনের ঘটনায় আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।

পুলিশের অপতৎপরতার অভিযোগ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর ২০২২ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ৩ জন, গ্রেফতার এড়াতে পালানোর চেষ্টায় পানিতে ঝাপ দিয়ে ১ জন, পালানোর চেষ্টায় ছাদ থেকে পড়ে ১ জন ও পালানোর চেষ্টায় গাছের সাথে ধাক্কায় ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া পুলিশের কিছু সদস্যের অনৈতিক কাজের পাশাপাশি তাদের অশোভন আচরণ, নির্যাতন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির বেশ কয়েকটি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

কারা হেফাজতে মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর ২০২২ মাসে কারা হেফাজতে একজন নারীসহ মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গত মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩ জন। কারা হেফাজতে মৃতদের মধ্যে ৪ জন কয়েদি ও একজন নারী বন্দিসহ আরো ৩ জন হাজতি রয়েছে। কারাগারে অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে অসুস্থ অধিকাংশ বন্দিকে কারাগারের বাইরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এমএসএফ মনে করে, কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দিরা মানসিক ও শারীরিক সমস্যা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ফলে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার-অপব্যবহার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও এ আইনে মামলার নামে হয়রানি অব্যাহত রয়েছে ও এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিষয়টি ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত মাসের মতোই ৬টি মামলা করা হয়েছে  এবং গ্রেফতার হয়েছেন ৪ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি নিয়ে কথিত মানহানিকর কটূক্তি করার জন্য এ মাসে ২টি মামলা, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২টি মামলা, ১টি ধর্ষণের ও ১টি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা করেন। এ ছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে পূর্ব মামলায় তিন যুবককে ২, ৫ ও ৭ বৎসর করে সশ্রম কারাদ- প্রদান করেছেন আদালত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পূর্বে করা মামলায় ১ জন নারী ও ১ জন যুবক গ্রেফতার হয়েছেন।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে হামলা ও মামলা

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় অন্তত ১৩টি ঘটনায় সাংবাদিকদের নানাভাবে অপমান, নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব  করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়ে আহত হয়েছেন। প্রকাশিত সংবাদের জেরে ৪ জন সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়ে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া, মারপিট করে হত্যার চেষ্টা, লাঞ্ছিত করা ও একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।  এছাড়া  হয়রানি ও অপমানের শিকার হয়েছেন ৩ জন সাংবাদিক। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাক্সিক্ষতই নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার শামিল। তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় অপমান, নিপীড়ন, হত্যার হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ক্ষমতাসীন সরকারদলের নেতাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও দুষ্কৃতকারীর পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীরাও এর সাথে জড়িত  রয়েছে। এভাবে বাধার সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে।

সংখ্যালঘু নির্যাতন

গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ মাসে ৪টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ২টি ঘটনা উপাসনালয়ের মূর্তি ভাঙচুর ও মন্দিরের দানবাক্স লুট করার ঘটনা। অপরদিকে যশোর শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে ৫ জনকে চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।

শেয়ার করুন