২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৪:৪৬ অপরাহ্ন


বিভাগীয় সমাবেশ থেকে যে অর্জন বিএনপির
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১২-২০২২
বিভাগীয় সমাবেশ থেকে যে অর্জন বিএনপির বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণমমাবেশ


বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার মহাসমাবেশের পর সর্বত্র বিশ্লেষণ চলছে। কী করলো বিএনপি? যে আন্দোলন তারা শুরু করেছে তাতে তারা কতটুকু সফল কতটা ব্যর্থ। বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরাও এ ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দ্বে! গোলাপবাগের সমাবেশে সভাপতিত্ব করা শীর্ষনেতা আমানউল্লাহ আমান বলেছেন, সমাবেশ শেষে আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যান। ওই ঘোষণার মাধ্যমে সরকার পক্ষের কেউ কেউ হাফ ছেড়ে বাঁচেন। যারা ধারণা করেছিলেন, বিএনপি ঢাকার সমাবেশ শেষে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত বসে পড়বেন। তেমনটা হয়নি। 

তবে বিএনপি এ সমাবেশের মাধ্যমে যে বার্তা দিতে চেয়েছে সেটাতে তারা সফল বলে রাজনীতিবিদরা মনে করছেন। কারণ এ সমাবেশের মূল দাবি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিএনপির কয়েকজন কর্মী  নিহত ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি। মূলত এগুলো নিয়েই বিএনপি এ বিভাগীয় পর্যায়ের একের পর এক সমাবেশ। ঢাকাতেও সেই একই দাবি। তবে এখানে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা বিএনপি আগেই জানিয়েছিল। ফলে বিএনপি কখনই বলেনি, এ সমাবেশ থেকে সরকার উৎখাত করার আন্দোলন শুরু করবে। ফলে সাধারণভাবেই একটা বিরোধীদলের কর্মসূচি, যা থাকে বিএনপিরও তাই। এখানে বাড়াবাড়ি কিছুই করেনি। অন্যসব বিভাগের মতোই ঢাকায় নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলন সমাবেশ করার কথা বলেছে করেছেও।  

যা অর্জন বিএনপির 

বিএনপি ঢাকার সমাবেশে সফল না ব্যর্থ সে ব্যাখ্যায় বিএনপি সফল। অন্য ৯টি সমাবেশের মতো বিএনপি ঢাকার সমাবেশটাও শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকীয়তা পেরিয়ে করতে পেরেছে। যদিও সরকার পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে আর ছাড় নয়। বিএনপিকে এ সমাবেশ করতেই দেবে না এমন একটা হুংকারও ছিল। যার জন্য বিএনপি সমাবেশের ভেন্যু চেয়েছিল পল্টন দলীয় কার্যালয়ের সম্মুখে। যেখানে তারা সচরাচার সভা করে, সেটাতে বাধ সাধে সরকার। তাদের অনুমোদন দেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বিএনপি রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকীয়তার পর, পল্টনে সংঘর্ষ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ ‘ক্রাইম সিন জোন’ ঘোষণা করে সেখান থেকে বোম সদৃশ ককটেলসহ চাল, ডাল, পানি উদ্ধার করে, অফিস তালা মেরে দেয়। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ একঝাঁক শীর্ষনেতা ও দলীয় কর্মীদের গ্রেফতার করে অবশেষে মিরপুর বাংলা কলেজ বা কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুমোদন দেয়ার আলোচনা হয়। শেষ অবধি বিএনপি গোলাপবাগ মাঠের আবেদন করলে সেটাতে দেয়া হয়। তবে সমাবেশের দিন রাজধানী অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিল অন্যসব বিভাগ থেকে। রাজধানীতেও কঠোর হরতালের পরিবেশ বিরাজ করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ১০ ডিসেম্বর বসে পড়ে। পাহারা দেয়। উদ্দেশ্য বিএনপি যাতে কোনো নৈরাজ্যমূলক কর্মকা- না করে। এতে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করে। রাস্তায় রাস্তায় ও যাত্রীদের তল্লাশি করে পুলিশ। সেখানে ব্যবহার করা মোবাইলও চেক করে সে কোনো দলের কর্মী কিনা তা নিশ্চিতকরণের চেষ্টা করে। এসব কিছুই দেশের মিডিয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কঠোর মনিটরিং হয়। 

তবে সর্বোপরি বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল একটা শান্তিপূর্ণ সম্মেলন। শেষ পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে সেটা তারা করে সফল। তবে ৯ বিভাগীয় সমাবেশে সরকার পক্ষের টেকনিক্যালি কিছু আচরণ এবং নয়াপল্টনের ঘটনা নিয়ে যা ঘটে গেছে, যা গোটা বিশ্ব গভীরভাগে পর্যবেক্ষণ করেছে। এটা সরকারের জন্য কিছুটা হলেও মর্যদাহানি ঘটেছে। কারণ নয়াপল্টনের ঘটনায় ১৫টি উন্নয়ন সহযোগী দেশের বিবৃতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি। হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি ও আহ্বান। সর্বোপরি জাতিসংঘ যেভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে সেটা বিএনপির জন্য প্লাস পয়েন্ট।

এমন একটি দুটি সমাবেশে একটা সরকারের পতন হয়ে যায় না। কিন্তু যে বিষয়টা এখানে পরিষ্কার হলো যে এ সরকার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটা যেভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন দ্বারা অনুষ্ঠিত করার অভিলাষ রেখেছে এবং সেখানে যে কমিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে যে, একটা নিরপেক্ষ আচরণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে বর্তমান প্রশাসন সেটা এ নয়াপল্টনের ঘটনায় কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত। দেশ ও বিদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো কিছুটা হলেও ধারণা নিয়েছে, একটি বিরোধী মতের একটা সমাবেশ অনুষ্ঠান করতে যেয়ে যে পরিস্থিতির অবতারণা ঘটলো এবং বিএনপির মতো শীর্ষ একটা দলের মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে সমাবেশের আগে, ফলে এটা নির্বাচনকালীন সময়েও এমন একটা প্রভাব পড়তে পারে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে এটাই বলে আসছে বিরোধীদলসমূহ বিভিন্ন সময়ে। 

কারণ উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহ বারবার বলে আসছে আগামী নির্বাচন হতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিএনপিতো দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল। তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাতেই অস্বস্তি যেখানে তাহলে তাদের সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠান সম্ভব এ প্রশাসন দিয়ে। কারণ ঢাকার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, ১৫টি উন্নয়ন সহযোগী দেশ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে বিবৃতি দিয়েছে সেটাও প্রমাণ করে বাংলাদেশের বিরোধীদলের মতপ্রকাশের একটা বিষয় নিয়ে সবাই চিন্তিত।

বিশেষ করে বিএনপির ঢাকায় গণসমাবেশ সামনে রেখে সহিংসতা ও হতাহতের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন এবং ‘খুব ঘনিষ্ঠভাবে’ পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি ঢাকায় রাজনৈতিক সমাবেশের আগে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

কিরবি বলেন, যে কোনো ধরনের ভীতি, হয়রানি বা সহিংসতা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের দলগুলোকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই। কোনো দল বা প্রার্থী একে অন্যের প্রতি হুমকি প্রদর্শন বা সহিংসতায় জড়াবে না এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতিও আহ্বান জানাই। 

হোয়াইট হাউস যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটা বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে আরেকবার দিয়েছে কিনা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে বিএনপিসহ বিরোধীদল সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামলে বিদেশের মিডিয়া ও অবজার্ভেশন আরো কঠোর হবে বলেও ইঙ্গিত মিলছে। 

ঢাকার সমাবেশ কোন কর্মসূচির অংশবিশেষ  

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে  আবারো নিত্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং নেতা-কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে গত ৮ অক্টোবর ২০২২ থেকে দেশের ১০টি বিভাগীয় সদরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দিয়েছিলেন ওই ঘোষণা। মূলত বিএনপি যাতে রাজপথে সোচ্চার থাকে সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে রাজপথে দলীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিত রাখতে এবং সে সময়ের চলমান আন্দোলনের গতি বাড়াতে নতুন ওই ১০ বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি যোগ হয়েছিল। 

এতে ৮ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয়ে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় শেষ হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। সে কর্মসূচিই বিএনপি গোলাপবাগে শেষ করলো। বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী, ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ করে। 

এর আগে গত ২২ আগস্ট থেকে সবকিছুর সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভের আয়োজন করছিল বিএনপি। গত ৩১ জুলাই ভোলা শহরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ‘জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনা’ নিয়ে বিক্ষোভ করার সময় পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন বিএনপি নেতা নিহত হন। সে ধারায় ঢাকায় সমাবেশ করতে যেয়েও বিএনপির একজন কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। 

বিএনপির মূল উদ্দেশ্য অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নেয়া। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিগুলো সহিংসতায় রূপ নেয়ায় তা দেশ-বিদেশে প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে, দলটি কার্যত কোনো শক্ত আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি। ফলে এবার তারা মাঠপর্যায়ে শক্তি বাড়াতে, বিএনপির নেতাকর্মীর সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করে একটি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছে দেশের মানুষকে যে বিএনপি পিছিয়ে নেই। বিএনপির শক্তি অটুট। এবং বিএনপি এখনো ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ্য রাখে। বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী তাদের বক্তব্যে এসব বিষয়ে তুলে ধরেন। এমনকি কেউ কেউ আগামী ২০২৪ সনে বিএনপি সরকার গঠন করবে বলেও আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করে কর্মীদের চাঙ্গা করেন। এসব বিবেচনা সামনে রেখে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারা গণমুখী বিষয়ে বিক্ষোভ করবেন, সমাবেশ করবেন। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে সাপোর্ট নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেবেন। শুধুই বিভাগীয় সমাবেশেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না তারা। ইতিমধ্যে ২৪ ডিসেম্বর দেশের সর্বত্র সমমনা সব দল নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে তারা। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে বিএনপি এভাবেই পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রেখে নির্বাচনমুখী হবে। এছাড়া গোলাপবাগে তো তাদের ১০ দফার একটা দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছে।  সেটা সামনে রেখেই নেতাকর্মীরা এখন এগোবে।

শেয়ার করুন