২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৬:২৩:০৯ পূর্বাহ্ন


বিএনপিকে মোকাবেলাই আ.লীগের বড় চ্যালেঞ্জ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০১-২০২৩
বিএনপিকে মোকাবেলাই আ.লীগের বড় চ্যালেঞ্জ


বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি’র আন্দোলন কর্মসূচিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করাই এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য দলের পুরনো ত্যাগি নেতাকর্মীদের ওপরই ভরসা করছে আওয়ামী লীগ। এর পাশাপাশি দলটি তাদের ক্ষমতার মূল শরিক বিশেষ করে বাম উদার প্রগতিশীলদের ওপরই ভরসা করছে। তাদেরই কাছে টেনে নিতে চায় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি’কে মোকাবেলায়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। 

প্রশাসনে নির্ভরতায় সমালোচনা বাড়ছে...

বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় এতোদিন প্রশাসনের ওপরই ভরসা করেছে আওয়ামী লীগ। আইন শৃংখলা বাহিনী দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি সভা সমাবেশ ঠেকাতেই দেড় যুগ ধরে কাজ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মামলা-মোক্কাদ্দমায় ব্যস্ত রেখেছে একসময়ে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি’কে। এজন্য অনেক কিছু করতে হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে। রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে মোকবেলা না করায় এখন চড়া মাসুল দিচ্ছে দলটি। 

দেশে-বিদেশে সুনাম ক্ষুণ্ণ...

এভাবে প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরকে কাজে লাগাতেই গিয়ে দেশে বিদেশে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজেদের বির্তকিত করেছে।  দেশে বিদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐতিহ্য এক প্রকার ভুলুন্ঠিত হয়ে গেছে বলে দলের শুভানুধায়ীরা মনে করেন। তাদের মতে, দলের নেত্রীকে অেেনক বুঝিয়েছেন যে বিএনপি’কে পুলিশী ভয়ে তটস্থ রাখতে পারলেই আওয়ামী লীগের আর কিছু করতে হবে। না। বোঝানো হয় বিএনপি মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। তাদের এখন করার কিছুই নেই। বিএনপি আন্দোলনের নামে কিছুই করতে পারবে না। তারা রাস্তায় টিকে থাকতে পারবে না। বিভিন্ন কর্নার থেকে বলা হচ্ছে যে, স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে বিএনপি। এমন কি বিএনপিকে দল নয় সমিতি বলেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন। 

অবস্থা পাল্টে গেছে...

কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জোটের শরিকরাও এখন বুঝতে পারছে আগামী দিনে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটকে মোকাবেলায় পুলিশ দিয়ে বা কোনো ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে রুখে দেয়া সম্ভব না। সরকারের সাথে সম্পৃক্ত একজন নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, বিশেষ করে রাজধানীতে বিএনপি ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের পক্ষ থেকে যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাতেই সরকারের টনক নড়েছে। সরকার বুঝতে পেরেছে যে, বিএনপি’কে প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলার চেয়ে এখন রাজনৈনিতকভাবেই মোকাবেলা করাই শ্রেয়। একারণে ১০ ডিসেম্বরের পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়েছিল টেস্ট কেস হিসাবে। 

এখন অন্য ভয়...খোদ দলকে নিয়ে...

বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র ডাকা সমাবেশকে পন্ড করে দেয়া হয়েছে বলে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা জাহির করলেও জানা গেছে এর বিপরীতে অন্য তথ্য। সরকারের একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছিল যে এতো কড়া ব্যবস্থার মধ্যে কি করে বিএনপি বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা সমাবেশ লাখ লোকের জনসমাগমে পরিণত করেছে। কিভাবে কি করে কোন ফাঁকে এতো লোক ঢাকায় ঢুকে গেছে? যদিও বলা হয়েছিল বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা সমাবেশ ফ্লপ যাবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হচ্ছিল যে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে পুলিশের ‘বিশেষ অভিযান’ চালানো হয়। অপরদিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকেও বলা হয় যে , তালিকা ধরে তাদের মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংগঠকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। 

বলা হয় এর মধ্যে ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলার নেতারা অভিযানের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। অভিযোগ উঠে ঔই সময়ে প্রায় প্রতি রাতে বিভিন্নজনের বাড়িঘরে অভিযান চালানো হয়েছিল। অন্যদিকে ১০ ডিসেম্বরের আগে পল্টনে একটি ঘটনার বিপরীতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আটক করা হয়। আর এর প্রতিক্রিয়ায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু অবশ্য বলেছিলেন যে, তারা যে কোনো মূল্যে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করবেন। বাধা-বিপত্তি, গ্রেফতার ও হামলা-মামলা মোকাবেলা করে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করবে বিএনপি। 

পরে দেখা যায় মাত্র কয়েকঘন্টা আগেই সরকারের থেকে অনুমতি পেয়েই মুহূর্তে গোলপবাগ মাঠ বিএনপি’র নেতাকর্মীতে ভরে যায়, যা নিয়ে দেশে বিদেশে বেশ আলোচিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপি কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে ঠেকাতে আসলে এতে কোনো ভূমিকা রেখেছে কি-না? অনেকের মতে, বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বর ঠেকাতে আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি তৎপরতা দেখা গেছে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেটা দেখিয়েছে তা ছিল তারা অনেকটা লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় নেমেছেন। ঐতিহ্যবাহি দল হিসাবে যা ছিল বেমানান, যা এখন বেশ আলোচিত হচ্ছে। তাছাড়া অনেকে মনে করেন বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বর ঠেকাতে আসলে দলের হয়ে যারা সেদিন বেশি তৎপরতা দেখিয়েছে তারা ছিল ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে পদ-পদবি ধরে রাখার আশায়। এরাই ১০ডিসেম্বর ঠেকাতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এতে যে কাজ হযনি তা এখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকেই হিসাব নিকাশ হচ্ছে। জানা গেছে, একারণে আওয়ামী লীগ এখন শুধু একা না তাদের অন্যতম শরিক বাম উদার প্রগতিশীলদেরও মাঠে বিএনপি’র বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চায়।  সেভাবেই এখন শরিকদের কাছে টানা হচ্ছে। সামনে যে উপ-নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে তাতে শরিকদেরও  রাখা হয়েছে। 

শেষ কথা...কেনো এমন প্রশাসন বিমুখ...

২০২৪ সালের শুরুতেই দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে- এমনটাই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনও হয়ে গেছে। এতে দলের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই তা একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল সবাই। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে কিছুটা কৌতুহল কাজ করেছিল। কিন্তু রদবদল হয় কি না তা নিয়ে কিছুটা কৌতূহল থাকলেও ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্যে সম্মেলেনের আগেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়েগিয়েছিল যে সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের হ্যাটট্রিক করবেন। 

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে দশম বারের মতো সভাপতি ও ওবায়দুল কাদেরকে তৃতীয় বারের মতো সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বাকি বিভিন্ন পদ-পদবি নিয়ে যা-তে খুব একটা হেরফের হয়নি। পুরনোতেই এভাবে আস্থা রেখে দলটি সামনের দিকে এগুবে এটা কেউ ভাবেনি। ভাবেনি দলের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক পানিশমেন্ট হবে। প্রশ্ন দেখা গিয়ে পুরনোদের দিয়ে নতুন কমিটি কি আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে? বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি ও অনুমোদন সমর্থন রয়েছে ঘোষিত নতুন কমিটির ব্যাপারে। বলা হচ্ছে হয়তবা শেখ হাসিনা এমন কমিটিকেই তার চোখে আগামী দিনের জন্য ভালো মনে করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে তাই এটিকে তেমন নাড়াচাড়া করতে চাননি। সমস্যা দেখা দিয়েছে, তবে নতুন করে যারা পদপ্রত্যাশী ছিলেন কিংবা যাদের পদোন্নতির আশা ছিল তাদের কি হবে? তাদের বিরাট একটি অংশ হতাশ হয়েছেন-তা এখন বেশ স্পষ্ট। ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে যারা বিভিন্ন সময়ে দলকে আগলে রেখেছিলেন তারা হতাশ হয়েছেন এমন কমিটির কারণে। 

এর আগের কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ব্যাপারে দলে নানান ধরনের অভিযোগ ছিল। অভিযোগ রয়েছে এরা দলকে শহর বন্দী করে রেখেছে। দলে হাই ব্রিড তৈরি করেছে। জেলায় জেলায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে প্রায় চার বছর পর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি পেয়েছে ছাত্রলীগ। কিন্তু এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে টানা সমালোচনা ঘোচেনি এখনো। সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেও বেপরোয়া কর্মকা- ছাড়েনি তৃণমূলের ছাত্রলীগ। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানান ধরনের আপত্তিকর অভিযোগ উঠছে।  সারাদেশে সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলায় শিক্ষকসহ ২২ জন আহত হওয়ার মতো ঘটনা হজম করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকেই। তাই এমন ধরনের পুরানো নেতৃত্বকে দিয়ে মাঠের বিএনপি’কে কতটা মোকাবেলা করা সম্ভব তা নিয়ে সাধারনে উৎকন্ঠা আছে। 

 কেননা অতীতে প্রশাসনকে যেন তেন ভাবে ব্যবহার করে সরকার বেশ খেসারত দিয়েছে। প্রশাসনের অতি উৎসাহ ও বাড়াবাড়িতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে গেছে দেশে। এমন অভিযোগে গত ২০২১ সালের শেষ দিকে ঔই সময়ের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ছিলেন। তিনি তখন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায়ও পড়েছেন তিনি। ফলে এমন পরিস্থিতিতে সরকার আর সামনের দিকে খুব একটা প্রশাসনিক তৎপরতা দেখিয়ে বিএনপি’র বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না বলেই মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। আর সেজন্যই প্রশাসনের চেয়ে তাদের ঐতিহ্যবাহি দল আওয়ামী লীগ এখন বিএনপিকে  রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে তৎপর হয়েছে। কিন্তু কমিটির পুরানোদের নিয়েই আওয়ামী লীগের এমন নেতৃত্বে সামনের দিকে কতটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে তা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, এর ওপর বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এর পাশাপাশি সে নির্বাচন অংশহণমূলক ও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ কতটা সামাল দেয়া হবে রাজনৈতিকভাবে তা সময় বলে দেবে।

শেয়ার করুন