০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৫:২৯:৩৭ পূর্বাহ্ন


অজানা আতঙ্ক ভিসানীতিতে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৭-২০২৩
অজানা আতঙ্ক ভিসানীতিতে


ভিসানীতিতে আক্রান্তদের টু-শব্দটুকুও নেই, আছে এখন অজানা আতঙ্ক, যা প্রতিনিয়ত কুড়ে খাচ্ছে। অমানবিক মানুষিক নির্যাতনে ছটফট করছেন। বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। মার্কিনিরা অনেক গবেষণা করেই বাংলাদেশিদের জন্য এ ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। ফলে এটা খুবই কার্যকর এক পদক্ষেপ (তাদের ভাষায়) সেটা আর না বললেও চলে। যে কারণে এই ভিসানীতি, সেটা তারা পাচ্ছে কী না কে জানে! বাংলাদেশের বিভিন্নস্তরে সেটা কিছুটা হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে বৈকি! আমেরিকা ওই ঘোষণা পর্যন্তই। এর পরের আপডেট জানাচ্ছে না কিছুই,  যে অমুককে ভিসা দেইনি, অমুকের ভিসা বাতিল করা হয়েছে, বা অমুকের ফ্যামিলির সবার ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তবু বাতাসে বিভিন্ন খবর ভাসছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক খবর চাউর। কিন্তু তার সত্যতা খোঁজার কোনো উৎস পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো এটা বলার কিছু নেই। যে ক্ষতিগ্রস্ত কেবল সে-ই বুঝবেন ওই ভিসানীতির অ্যাফেক্ট কতটা ভয়াবহ।

মার্কিনিরা সম্ভবত বিশ্বের কোনো দেশের জন্য এমন নীতিগ্রহণ করেছে অনেক গবেষণা করেই। যা বাংলাদেশিদের জন্য খুবই অপমানজনকও। বাংলাদেশিদের কিই-বা করার আছে। এটা যে আমজনতা সবার জন্য নয়, তা উল্লেখ করে দিয়েছেন। যে সেক্টরের কর্মকর্তাদের উল্লেখ করেছেন, তারা সমাজের অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রক। প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের। তার অর্থ এর আওতায় সমাজের উচ্চপদস্থরা। তাছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপে বসত গড়েন কারা? সেটা আর লিখে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। 

ভিসানীতির অ্যাফেক্টিভ কারা সর্বসাধারণের মধ্যে এ সংক্রান্তে জানার আগ্রহ প্রবল। অবৈধ সম্পদ লুণ্ঠনকারীরা কী স্বস্তিতে আছেন? যারা দেশের কথা সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা না করে তাদের দেয়া ট্যাক্স, কর থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ চুরি করে বিদেশে গিয়ে সন্তান-সন্তানাদি নিয়ে সুখে দিন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছেন বা দেখছেন। এদের পরিণতি দেখতে তারা এখন চোখ কান খোলা রাখছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো টু শব্দ নেই- কে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বা হয়েছেন। যেমনটা জানাচ্ছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস তেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা তাদের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।  

অ্যাফেক্টিভ যারা- এমন একটা ঘোষণা প্রকাশ্যে এলে হয়তো আরো বেশি সতর্ক হতেন অনেকেই। কে ভিসা চাইতে গিয়ে প্রত্যাখাত হয়েছেন। কাকে চিঠি দিয়ে বা ডেকে বলেছে, যে তোমার ভিসা বাতিল। বা কে আমেরিকার উদ্দেশ্যে ফ্লাই করতে যেয়ে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পার হলেও মাঝের কোনো ট্রানজিটে আটকে গেছেন। মার্কিনিরা গ্রহণ না করায় সংশ্লিষ্ট বিমান তাকে ফেলে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বা কার কার ভিসা বাতিল বা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলো বা আটক হয়েছেন বা সেখান থেকে বের হয়ে এসেছেন। এরকম শত প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। তবে এটা ঠিক, এগুলো প্রকাশ করার কিছু নেই। যারা ওই নীতির আওতায় পরেছেন, তারা যে দুর্বিষহ, দাবানলের অনলে পুড়ে ছাড়খার হচ্ছেন, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের ভিসা রয়েছে, কিন্তু টিকেট কেটে যেতে পারবে কি না এটা নিয়েও রয়েছে অনেকের দ্বিধা দ্বন্দ্ব। দুশ্চিন্তার কালো মেঘ তাদের ললাটে! 

শুধুই যে মার্কিন ভিসানীতি সেটাও কিন্তু না। মার্কিনিরা যেটা করে- সেটা অক্ষরে অক্ষরে ঘোষণা না দিয়ে ফলো করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রমুখ দেশ। 

বাংলাদেশের কিছু কথিত এলিট ক্লাসের লোকজন যেমন বিপুল অর্থ খরচা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসতি গড়েছেন, তেমনি বড় একটি অংশ আছেন কানাডাতেও। সম্প্রতি সেই কানাডার এক খবরে নতুন দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। সেটা হলো কানাডা বলেছে, মানবতা লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের ভিসা দেবে না সে দেশ। এটা অবশ্য তাদের নতুন কোনো ঘটনা নয়, এরপরও বিষয়টা সামনে নিয়ে আসার কারণ মার্কিন ভিসানীতি।   

কানাডার ভিসার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা নীতি রয়েছে। যেমনটা নিজ দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কাউকে ভিসা দেয় না কানাডা। কেউ কানাডার ভিসার জন্য আবেদন করলে তাকে বিস্তারিত তথ্য দিতে হয় আবেদনের সঙ্গে। সেই আবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই করেই ভিসা দিয়ে থাকে দেশটি। দেশটি যদি মনে করে, তাদের দেশের নাগরিকত্ব নেই এমন কেউ কানাডা গিয়ে থেকে যাবে বা কেউ জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে থাকে দেশটি।

মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশ নিয়ে কানাডার অবস্থান প্রসঙ্গে ঢাকার হাইকমিশনের একজন বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে জানায়, আমাদের অবস্থান হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের আমরা ভিসা দিই না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিষয়গুলো আমরা ঘোষণা দিয়ে করি না। কাদের কাদের কানাডা ভিসা দেবে না? এ প্রসঙ্গে কানাডা দূতাবাসের ওই মুখপাত্র বলেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসআইএসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আমরা ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। বিষয়টি আমরা ঘোষণা দিইনি। ঠিক সেভাবেই সংশ্লিষ্টরা যখন ভিসা পাবেন না, আর সেই সংখ্যা যখন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকবে, তারা তখন নিজেরাই টের পাবে কেন ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সূত্র জানায়, বাংলাদেশি কেউ কানাডার ভিসা আবেদন করলে তার বিস্তারিত তথ্য হাইকমিশন থেকে চাওয়া হয়। বিশেষ করে কেউ যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করে থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়। এ সময় কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি আবেদন খতিয়ে দেখা হয়, সেই ব্যক্তি কোনো রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা। এর পরই ভিসা দেওয়া হয়। কানাডা আগে থেকেই একটি অবস্থান নিয়ে রেখেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত এবং চিহ্নিত অপরাধীদের ভিসা দেবে না।

হাইকমিশনের আরেক সূত্রের বরাত দিয়ে ওই মাধ্যম জানায়, কেউ যদি চিহ্নিত অপরাধী হয়, সে বিষয়ে যদি পর্যাপ্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকে যে কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত, তাহলে তাকে কেন ভিসা দেওয়া হবে সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সূত্র জানায়, কানাডার ভিসানীতির আওতায় পড়ে এরই মধ্যে অনেকেই ভিসা পাননি দেশটির। এ নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে ঢাকার কানাডা হাইকমিশনকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, তারা এবং তাদের পরিবারকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকার কানাডা হাইকমিশন। বৈঠক করে তাদের ভিসার প্রক্রিয়াগুলো বুঝিয়ে বলা হয়। বিশ্বের দেশগুলোর ভিসা নিয়ে যা জানানো হয়, তা হলো কীভাবে ভিসা পাওয়া যাবে। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটেও ঠিক এমনটিই দেওয়া রয়েছে, কারা কানাডার সীমানার ভেতর কী শর্তে প্রবেশ করতে পারবেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বা কারা কারা ভিসা পাবেন না, তা বিশ্বের কোনো দেশই সহজে প্রকাশ করে না। বিষয়গুলো গোপনীয়।

তবে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক জোট হয়ে দীর্ঘদিন দেনদরবার করে চলেছে বাংলাদেশে। ফলে ওই একই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিসানীতি দিয়েছে কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যরা যে সে নীতি ফলো করবে, এটাই স্বাভাবিক। এমনিতেও তারা এসব ক্ষেত্রে এক জোটই থাকে। আলাদা পলিসি হলেও বৃহত্তর স্বার্থে তারা এক জোট। সেদিক থেকে মার্কিন নীতি কানাডা ফলো করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

বারবার কানাডা প্রসঙ্গটা চলে আসার কারণও রয়েছে। কেননা কথিত ওই এলিট শ্রেণির অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডাতে বসত গড়েছেন। সেখানে রয়েছেন, তাদের বেগম ও সন্তানরা। কানাডার একটি অঞ্চলই রয়েছে কথিত ‘বেগমপাড়া’ নামে। যে অঞ্চলে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী, আমলাদের বেগমরা অবস্থান করছেন। এদের অনেকেই দেশ থেকে বিভিন্নভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে সেটা পাচার করে নিয়ে গেছেন ওইসব স্থানে এটা সবারই জানা। 

সম্প্রতি বিবিসি একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল যে, সুইস ব্যাংকগুলো থেকে এক বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছেন বাংলাদেশিরা। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কারা ওই টাকা সরিয়েছেন, সে টাকা গেলই বা কোথায়?  

ওই সূত্র বলছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশিরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে জমা করেছেন ৫ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার সুইস ফ্রাঁ। এক বছরে যা প্রায় ৮২ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৯৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ কমে গেছে। 

তবে কানাডা থেকে দ্রুত অর্থ সরানো সম্ভব না। বিপুল পরিমাণ অর্থ যারা যেভাবেই সেখানে নিয়ে গেছেন, সে অর্থ কানাডিয়ান সরকার এদিক সেদিক করতে দেবেন না, কারণ সেখানকার কর বিভাগ খুবই শক্তিশালী। সেখানে অর্থ নেওয়া অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সেখান থেকে সরানোটা প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে কানাডিয়ান গভর্নমেন্ট যদি দুর্নীতিবাজ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় কাউকে বা কারো গোটা ফ্যামিলিকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়, তাহলে তাদের গচ্ছিত অর্থ চুলায় যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বৈধভাবে তো সেখানে অর্থ যায়নি। গেলেও কানাডা অর্থ সেখানে ভোগ করার সুবিধা হয়তো দেবে, কিন্তু বাইরে নিয়ে আসতে দেবে না। একই সঙ্গে একই ফ্যামিলির কেউ কেউ যদি ভিসানীতিতে পড়ে যান, তাহলে ওই পরিবারের অবস্থাও কাহিল হয়ে যাবে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে ফ্যামিলির সঙ্গে। এমনকি দুর্যোগ নেমে আসতে পারে গোটা পরিবারের ওপরও। সব মিলিয়ে পশ্চিমা জোটভুক্ত দেশসমূহে যারা যেখানেই অবৈধ অর্থ নিয়ে যেয়ে পাহাড় গড়েছেন, সবার উপরই নেমে আসতে পারে ভিসানীতির প্রভাব, যা এতোদিন তারা কখনো চিন্তাও করেনি। এতে করে এই কূল ওই কুল দুই কূলও যেতে পারে কারো কারো। 

উল্লেখ্য, গত ২৪ মে বাংলাদেশ নিয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে দেশর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারি, সরকারপন্থী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

শেয়ার করুন