০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৩:৫২:০০ অপরাহ্ন


হিউম্যান রাইটসের উদ্বেগ
নতুন অভিযোগ ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০২-২০২৩
নতুন অভিযোগ ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা


বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খা বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)-এর উদ্বেগ। এবার র‌্যাব নয়, এবার অভিযোগের তীর ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে। 

র‌্যাবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে বারবার সতর্ক করার পর কার্যকরি পদক্ষেপ না নেয়ার পর এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদন আমলে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও তার সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শ্যাঙ্কশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয়। এরপর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-সহ খুন-গুমের মতো কার্যক্রমগুলো আশাতীতভাবে কমে যায় বলে গত ১২ জানুয়ারি এক রিপোর্টে এইচআরডব্লিউ উল্লেখ করে আবারও প্রতিবেদন দেয়। এরপর পর বাংলাদেশ সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু র‌্যাবের কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করে গেছেন। ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় এসেছিলেন লু। ওই ঘটনার পরপরই মোটামুটি নীরব নিস্তব্ধই ছিল। তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিল কেউ কেউ যে, নতুন কোনো শ্যঠঙ্কশন আর আসছে না বাংলাদেশে। কিন্তু আবারও গত শুক্রবার ডিবির বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগের তীর। এ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে সেটা সঠিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি সরকারের কাছে। 

৩ জানুয়ারি শুক্রবার 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ‘গুম’ ও ‘ধরে নিয়ে নির্যাতনের’ যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। গত শুক্রবার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানানো হয়। যাতে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যদের হাতে ‘নির্যাতনের’ বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৯ জানুয়ারি গাজীপুরে ৩৮ বছর বয়সি দোকানি মোহাম্মদ রবিউল পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ার পর এলাকায় সহিংস বিক্ষোভ হয়। অভিযোগ উঠেছে, নির্যাতনের শিকার হয়ে রবিউল মারা গেছেন। তবে পুলিশের দাবি, ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার মৃত্যু হয়েছে। 

গত ২৯ জানুয়ারি আবু হোসেন রাজন নামে এক আইনজীবী অভিযোগ করেন, তাকে এক সপ্তাহ ধরে হাতিরঝিল থানায় আটকে রাখা হয়। প্রতিদিন তাকে ডিবির প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। তবে পুলিশ রাজনকে গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করেছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সাতক্ষীরায় রঘুনাথ খাঁ নামে এক সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, সেখানকার (সাতক্ষীরার) পুলিশ তাকে গ্রেফতারের পর গত ২৩ জানুয়ারি ডিবি হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। রঘুনাথ সাংবাদিকদের বলেন, ‘থানায় আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তারা আমার দুই কানে যন্ত্র বসিয়ে আধা ঘণ্টা ধরে ধাপে ধাপে বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে। তারা আমার পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে।’ তবে সাতক্ষীরা ডিবির কর্মকর্তারা রঘুনাথ খাঁর করা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের কোনো কিছু ঘটেনি।

স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো আগেও ডিবির বিরুদ্ধে গুম, নির্যাতনসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্যাতনের অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত কিংবা বিচার হওয়ার ঘটনা বিরল। 

২০১৯ সালের জুলাইয়ে একটি পর্যালোচনা শেষে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি বাংলাদেশ পুলিশকে ‘রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়েছিল। কমিটি তখন বলেছিল, পুলিশ ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা দায়মুক্তি নিয়ে কার্যক্রম চালাতে পারে। তাদের মোটেও জবাবদিহি করতে হয় না। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এক দশক আগে বাংলাদেশে পাস হওয়া নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের আওতায় এখন পর্যন্ত নির্যাতনের একটি মাত্র ঘটনার বিচার হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির সুপারিশগুলো অনুসরণের জন্য কমিটির পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও বাংলাদেশ সরকার তা উপেক্ষা করেছে। কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সব আটক কেন্দ্রকে স্বাধীন ধারার নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা নির্যাতন ও অন্যায় আচরনের অভিযোগগুলোর তদন্ত করা। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা, অভিযোগ তদন্ত করা এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা।    

স্যাঙ্কশনে র‌্যাবের উন্নতি! 

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা কমাতে র‌্যাবের উদ্যোগের প্রশংসা করেন বাংলাদেশে সফর করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সে সময় সৌহার্দ্য এক পরিবেশে তিনি বলেছেন, স্যাঙ্কশনের (নিষেধাজ্ঞার) পর র‌্যাব সংস্কারে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নেমে এসেছে আশাতীতভাবে। এই অসামান্য উন্নতির বিষয়টি গত সপ্তাহের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা আমরাও স্বীকৃতি দেই। এতে প্রমাণ হয়েছে, র‌্যাব সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও আইনপ্রয়োগের দায়িত্ব মানবাধিকার রক্ষা করেই করতে পারবে। এটা অসাধারণ কাজ।’ 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কী বলেছিল?

গত ১২ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিশাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে অনেক কিছু বললেও একটি স্থানে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ভূয়সী প্রশংসা করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, র‌্যাবের ওপর স্যাঙ্কশনের (মার্কিন নিষেধাজ্ঞা) পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমেছে। 

সংস্থাটি বলছে, এ থেকে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। এইচআরডব্লিউ-এর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও গুম কমলেও বাংলাদেশে সরকারের প্ররোচনায় মানবাধিকারকর্মী ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিচ্ছে ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাঙ্কশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‌্যাবের বিরুদ্ধেও স্যাঙ্কশন (নিষেধাজ্ঞা) জারি করা হয়।

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়েছেন। তাঁদের পরিবারের সদস্যকে গুম করা হয়নি মর্মে জোর করে মিথ্যা বিবৃতিতে সইও করিয়ে নিয়েছেন।

এইচআরডব্লিউ বলছে, বিদেশে বসে যেসব বাংলাদেশি ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কাজ করছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণায় তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বিদেশে অবস্থান করা ভিন্নমতের ওই ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য যাঁরা বাংলাদেশে রয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য করে হয়রানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নজরদারি ও হয়রানি বাড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি ফাঁস হওয়া একটি সরকারি সার্কুলারের বরাতে এইচআরডব্লিউ বলছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে কাজ করা অনেক মানবাধিকার সংস্থার বিদেশ থেকে আসা তহবিলের ওপর নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা কমে এলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের আগের সেই চর্চায় আবার ফিরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এমনকি গত জানুয়ারিতে নিষেধাজ্ঞায় থাকা র‌্যাবের দুই কর্মকর্তাকে পুলিশ মেডেল দিয়ে পুরস্কৃত করেছে সরকার।

এদিকে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সরকারের সমালোচনাকারীদের গ্রেফতার চলছে বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই আইন সংস্কার ও স্থগিতের আহ্বান জানানো হলেও তা আমলে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। এ ছাড়া গত জুলাইয়ে সরকার তথ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনের মাধ্যমে নজরদারি আরো বাড়াতে পারে এবং জনসাধারণের প্রাইভিসির অধিকার লঙ্ঘন হতে পারে বলে এইচআরডব্লিউ মনে করে।

শেয়ার করুন