২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৮:৫০:৪৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের অতি আগ্রহ কেন?
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৪-২০২৩
নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের অতি আগ্রহ কেন?


বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশি মহল এখন সোচ্চার। পশ্চিমা দেশগুলো, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য অংশগ্রহণমূলক বিশেষত অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছে। নির্বাচন নিয়ে বিদেশি মিশনগুলো কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়েও সরকারসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। কিছু দিন আগে সরকারি দলের কিছু নেতা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে কূটনীতিকদের সঙ্গে সভা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করেছে। বিরোধী দল নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। প্রশ্ন হলো ঘরের সংকট বাইরের শক্তির সঙ্গে আলাপের চেয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পথ কেন খুলছে না? 

বাংলাদেশে এ বছরের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হবে। ক্ষমতাসীন দল ক্রমাগত তিন টার্মের শেষ বছর পার করছে। সাফল্য ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রতিবেশী নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি ভারত থেকেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। সার্ক অঞ্চলে কোনো দেশেই নিখাদ গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের প্রশ্ন সার্বিক অবস্থা ২০০৯ থেকে অনেক পাল্টে গেছে। অর্থনীতি বিশাল হয়েছে, দেশজুড়ে সড়ক, রেল যোগাযোগব্যবস্থা বহুমাত্রায় বিস্তৃত, বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। রাজনীতিতে অর্থ, পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। একশ্রেণির মিডিয়া সরকারের লেজুড় বৃত্তি, অন্য শ্রেণি উদ্দেশ্যেমূলক তথ্য প্রকাশ করছে। করোনা পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো সামাল দেওয়ার পর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও মূল্য বেড়ে সীমিত আয়ের মানুষদের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা। ভুল পরিকল্পনায়, জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হওয়ায় শিল্প কারখানাসমূহ উৎপাদন এবং রপ্তানি সংকটে পড়েছে। ডলার সংকটে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমতে থাকায় সরকার পুনরায় আইএফসি, বিশ্বব্যাংকের দুয়ারে ঋণ প্রদানে অগ্রসর হয়েছে। ঋণের শর্ত হিসেবে জ্বালানি বিদ্যুৎ মূল্য প্রচলিত প্রথা এড়িয়ে কয়েক দফায় বাড়িয়েছে, দেশ থেকে একশ্রেণির সরকার ঘনিষ্ঠ মহল বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করায় বিদেশি মিডিয়ায় অনেক তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদন আসছে।

এসব বিষয় নিয়ে সরকার এবং বিরোধী দল রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে। উভয় দল ঘরের সংকট বিদেশি শক্তিগুলোর কাছে নিয়ে গেছে। এটি দেশের ভাবমূর্তির জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য সেটি নিয়ে কেউ ভাবছে না। রাজপথে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। অন্তত বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন কোনভাবেই স্বচ্ছ, নির্বাচন হয়নি। সরকারের কিছু বেপরোয়া অংশ সুবিধাবাদী আমলা এবং পুলিশ প্রশাসনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে প্রহসনমূলক নির্বাচন করায় বিপুল উন্নয়ন করেও সরকার দেশি-বিদেশি মহলের আস্থা অর্জন কতটুকু করেছে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। আরো বড় সমস্যা হলো আঞ্চলিক এবং বৈষয়িক রাজনীতির অশুভ প্রভাব। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রধান বিদেশি শক্তিগুলোর কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষত বঙ্গপোসারে জ্বালানি অনুসন্ধানে নিজ দেশের কোম্পানি নিয়োজিত করে অবস্থান নিতে চাইছে একটি পরাশক্তি। চীন বিরোধী একটি জোটে বাংলাদেশকে যোগদানের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে কিন্তু চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপান, কোরিয়া নানা কাজে জড়িত আছে। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া বা পশ্চিম ইউরোপের বিনিয়োগ অনেক কম। বিগত সময়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকলেও এখন কিন্তু সরকারের অবস্থান চাপের মুখে।

কেউ স্বীকার করুক বা নাই করুক কিছু মেগা প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন কিন্তু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে দিয়েছে। ভাবুন পদ্মা বহুমুখী সেতুর কথা, দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে গোটা দেশের মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ হয়ে গেছে, রেলের পরীক্ষামূলক ট্রেন চললো। এবার অপেক্ষা যাত্রী বহনের। সম্ভবত সেপ্টেম্বরে রেল যোগাযোগ শুরু হবে। পায়রা এবং রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় দক্ষিণ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি অনেক উন্নত।

কর্ণফুলী নদী তলদেশের সুড়ঙ্গপথ খুলে গেলে দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দুয়ার খুলে যাবে। ভারত থেকে পাইপ লাইন ডিজেল আসছে। অচিরে গভীর সমুদ্র থেকে বড় জাহাজে আনা জ্বালানি তেল পাইপলাইন দিয়ে সরাসরি আসবে চট্টগ্রাম তেল শোধনাগারে। মেট্রো রেলের এক অংশ চালু হয়েছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে বিমানবন্দর থেকে বনানী অংশ চালু হলে উত্তরাবাসী এবং ঢাকা এয়ারপোর্ট যাতায়াতকারীদের কিছুটা স্বস্তি মিলবে। আশা করি, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট অচিরে চালু হলে অসহনীয় দুর্ভোগ কাটবে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের প্রভাব কতটুকু পরে দেখতে হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দর আধুনিকায়ন, মাতারবাড়ি জ্বালানি বিদ্যুৎ হাব নির্মাণ শেষ হলে শুভ প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে শুভ প্রভাব সৃষ্টি হবে। সরকার আমলা অতিনির্ভর এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সরকার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ থাকতো। বিশেষত জ্বালানি খাত উন্নয়নে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। 

বিদেশি ঋণনির্ভর এসব প্রকল্পের আর্থিক দায়ভার মেটানোর জন্য বাংলাদেশে প্রয়োজন ভালো ভাবমূর্তির জনগণের ভোট নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব মূলক সরকার। সরকার যদি নিজেদের অবস্থান জনগণের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে জনঘনিষ্ঠ মানুষদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত করতে পারে, তাহলে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভীত হবার কারণ নেই। তবে মন্ত্রী সাংসদ অনেকের বিষয়েই জনমনে দ্বিধা সংশয় আছে। সরকার প্রধান নিঃসন্দেহে অবহিত আছেন। ইতিমধ্যেই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিরোধী দলগুলো এক পর্যায়ে নির্বাচনে আসবে। সেটা কীভাবে সে প্রক্রিয়াই এখন মূল সমস্যা। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। সরকারি দল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন করার দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। তবে এটা ঠিক, নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতার পালা বদল হবার সুযোগ নেই এটাই বাস্তব।

শেয়ার করুন