০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭:২৭ পূর্বাহ্ন


সরকার পতনের এক দফার সূচনায় উত্তপ্ত দেশ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৭-২০২৩
সরকার পতনের এক দফার সূচনায় উত্তপ্ত দেশ বিএনপির পদযাত্রা


সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঘোষিত এক দফা দাবি আদায়ের নেয়া কর্মসূচির সূচনায় উতপ্ত হয়ে উঠেছে সারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। গত ১৮ জুলাই মঙ্গলবার ছিল দুইদিনব্যাপী পদযাত্রার প্রথম দিন। এদিন রাজধানীর মিরপুর থেকে নিয়ে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকমীদের সাথে কোথাও তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। আবার কোথাও হয়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও কর্মসূচি পন্ড করে দেয়ার মতো পরিস্থিতি। 

এর আগে বিএনপি ১২ জুলাই নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা করে। এই কর্মসূচির প্রথম ধাপে পরপর এ দুই দিনের পদযাত্রা কর্মসূচি দেয় বিএনপিসহ সমমনাদলগুলি। ঘোষণা করে প্রথম ধাপে পরপর এ দুই দিনের পদযাত্রা কর্মসূচি দেয়। বিএনপির পাশপাশি সমমনা জোটগুলো গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণফোরাম-পিপলস পার্টি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশ, সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ যুগপতভাবে একই কর্মসূচি পালন করছে। অন্যদিকে একই দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে ‘শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামায় রাজনৈতিক মাঠ বলা যায় বেশ উত্তপ্ত। উভয় দলের এমন কর্মসূচি মঙ্গলবার এবং বুধবার ঢাকাসহ জেলা পর্যায়ে এ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। 

‘শুধু পদযাত্রা নয়, জয়যাত্রা’

সরকার পদত্যাগের ‘পদযাত্রা’র কর্মসূচিকে ‘শুধু পদযাত্রা নয়, জয়যাত্রা’ বলে অভিহিত করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১৮ জুলাই মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মহানগরীতে পদযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু পদযাত্রা নয়, এটা জয়যাত্রা। মানুষের অধিকার আদায়ের পথে বিজয়ের জয়যাত্রা। বাংলাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে। আজকে সারা বাংলাদেশের শুধু পদযাত্রা নয়,এর আগে সভা হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছি, আমরা দাবি জানাচ্ছি যে, অবিলম্বে পদত্যাগ করবেন। এক দফা এক দাবি, দাবিটা কি?’

নেতা-কর্মীরা এ সময়ে উচ্চস্বরে ‘শেখ হাসিনা এখন যাবি’ বলে শ্লোগান দিতে থাকে। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘পদত্যাগ করো, ওই পার্লামেন্ট যেটা বানাইছো সেটা বিলুপ্ত করো এবং একটা নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দাও। আমরা ১২ তারিখে নয়া পল্টন থেকে যে দাবি দিয়েছি সারা দেশের মানুষের কাছে শুধু আমরা বিএনপি নই, ৩৬টি রাজনৈতিক দল একযোগে ঘোষণা দিয়েছে যে, এই সরকারকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। এদেশের মানুষ আর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।’ তিনি বলেন, আসুন এই পদযাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা নতুন যাত্রা শুরু করি। এটা হচ্ছে বিজয়ের যাত্রা। এই যাত্রার মধ্য দিয়ে ইনশাল্লাহ আমরা আমাদের এক দফা দাবি আদায় করবো এই ভয়াবহ দানবীয় সরকারকে পরাজিত করে জনগণের সরকার, জনগণের পার্লামেন্ট গঠন করবো। এই রৌদ্র, বৃষ্টি, ঝড় সব কিছুকে উপেক্ষা করে শান্তিপূর্ণভাবে আমরা বিজয় হতে হবে আমাদেরকে। আমি সমস্ত রাজনৈতিক দল, সংগঠন, পেশাজীবীসহ সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি এই দেশকে রক্ষা করতে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে আমাদের আজকে একজোট হতে হবে। এজন্য বলেছি সরকারকে পদত্যাগ করেন। নইলে ফয়সালা হবে কোথায়? শ্লোগান তুলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ফয়সালা হবে ‘রাজপথে’।

সকাল ১১ টার দিকে গাবতলী থেকে বিএনপির এই পদযাত্রা শুরু হয়। ১৬ কিলোমিটারের এই পদযাত্রা টেকনিক্যাল মোড়, মিরপুর-১, মিরপুর-১০ গোল চত্বর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁওয়ের তালতলা, বিজয় স্মরণী, কাওরান বাজার, এফডিসি, মগবাজার, কাকরাইল, নয়া পল্টন, ফকিরাপুল, মতিঝিল, ইত্তফাক মোড়, দয়া গঞ্জ হয়ে রায়েসাহেব বাজার মোড়ে গিয়ে বিকাল ৪টায় শেষ হয়। 

যাত্রাপথ: 

গাবতলী টেকনিক্যাল মোড় মিরপুর-১, মিরপুর-১০ গোল চত্বর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, তালতলা (আগারগাঁও), বিজয় সরণি-কাওরান বাজার, এফডিসি, মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, নয়াপল্টন (বিএনপি অফিস), ফকিরাপুল, মতিঝিল (শাপলা চত্বর), ইত্তেফাক মোড়-দয়াগঞ্জ, রায় সাহেব বাজার মোড়। এই পদযাত্রাকে ঘিরে মহানগরীরের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে হাজার হাজার নেতা-কর্মী সমবেত হয় বিভিন্ন স্পটে। ফলে পদযাত্রার বহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের হাতে রয়েছে দলীয় ও জাতীয় পতাকা এবং সরকার পদত্যাগের দাবি সম্বলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। লাল-সবুজ-হলুদ-বেগুনি প্রভৃতি রঙের ক্যাপ পড়ে কর্মীরা বিভিন্ন শ্লোগানের মাধ্যমে ঢাকাবাসীকে আন্দোলনের দাবিগুলো জানান দিচ্ছে।

উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম বক্তব্য রাখেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ঢাকার এই মার্চের মধ্য দিয়ে এই জনগন এই বার্তা দিচ্ছে যে, সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। গণমাধ্যমে তিনি জানান, ঢাকা মহানগর ছাড়াও সারাদেশের সবগুলো মহানগর ও জেলা সদরে এই পদযাত্রার কর্মসূচি হচ্ছে। 

একদফার ঘোষণায় রয়েছে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, বিদ্যমান অবৈধ সংসদ বিলুপ্ত, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধিনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েসি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগনের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠা। বিএনপির এই পথযাত্রাকে ঘিরে ১৪ কিলো মিটার সড়ক পথের বিভিন্ন পথে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে।

সারাদেশে সংঘর্ষের খণ্ডচিত্র

লক্ষ্মীপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কৃষক দলের এক কর্মী নিহত হয়েছেন। ১৮ জুলাই মঙ্গলবার দুপুরে এ ঘটনায় পুলিশের ৩০ সদস্যসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তির নাম মো. সজীব। তিনি জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার কৃষক দলের সদস্য ছিলেন বলে জানা গেছে। জার্মান বাংলা রেডিও জানায় ২ জন মারা গিয়েছে। বিএনপির দাবি ২ হাজার আহত এবং এক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।   

এদিকে রাজধানী ঢাকায় পূর্বঘোষিত বিএনপির সরকার হটানোর ‘এক দফা’ আন্দোলনের পদযাত্রায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে এ হামলা চালানো হয়। বেলা ১১টার দিকে গাবতলী থেকে পদযাত্রা শুরু করে বিএনপি। পদযাত্রাটি এক পর্যায়ে মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে আসলে কলেজের ভেতর থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইট পাটকেল ছোঁড়াছুড়ি করে। এসময় বিএনপির নেতাকর্মীরা পাল্টা ধাওয়া করেন। অভিযোগ উঠেছে পদযাত্রার একটি অংশের ওপর সরকারি বাঙলা কলেজের ভেতর থেকে ইটপাটকেল ছোঁড়া হয়। তখন পদযাত্রা থেকে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীরা কলেজ গেটে ভাঙচুর করে এবং সেখানে থাকা একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে এ ঘটনার পরও পদযাত্রাটি থামেনি, সামনে এগিয়ে যায়। এদিকে পদযাত্রা সর্বশেষ খবর পাওয়ার পর্যন্ত রিপোর্টে বলা হয় কিশোরগঞ্জে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধসহ আহত শতাধিক। মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে শহরের রথখলা এলাকায় এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। সকাল থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে কিশোরগঞ্জের গুরু দয়াল সরকারি কলেজ মাঠে যান জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা। পরে দুপুর ১২টায় গুরুদয়াল কলেজ মাঠ থেকে জেলা বিএনপির ব্যানারে শান্তিপূর্ণভাবে পদযাত্রা বের হয়। শহরের আখড়া বাজার হয়ে ঈশা খাঁ রোডের রথখলা এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ বিএনপির পদযাত্রায় বাধা দেয়। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশও পাল্টা টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পরে ধাপে ধাপে প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলে। জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক তারিকুজ্জামান পার্ণেল গণমাধ্যমে জানান, তিনিসহ ৮-১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ সুমন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলী মোস্তফা তাজবির, পল্লী ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার মুসা তানহা, নিকলী উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক আব্দুল মান্নান রয়েছেন। তারা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

এদিকে বগুড়ায় বিএনপির পদযাত্রায় বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিএনপির সাতজন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয় মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শহরের ইয়াকুবিয়ার মোড় ও জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পৃথক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে বিএনপির দাবি, এ ঘটনায় তাদের ৭ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। অপর দিকে সংঘর্ষে তাদের ১০ সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।

খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহরের শাপলা চত্ত্বরে সংঘর্ষ চলছে। এতে পুলিশসহ কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন।

শেয়ার করুন