২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৯:১০:৪৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে ঢাকা মহানগরী
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৬-২০২৩
বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে ঢাকা মহানগরী


প্রতি বছর কিছু ইনডেক্স বিবেচনায় বসবাসের জন্য বিশ্বের অবস্থান নির্ধারণ করে প্রকাশ করা হয়। আমার চেনা কিছু শহর মেলবোর্ন, সিডনি, ভেনিস, ভ্যাংকুবারসহ কিছু শহর তালিকায় ওপরের দিকে থাকে। কিন্তু আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা প্রতিবারই নিজের দিকে অবস্থান করে। এবারও ১৭৩ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২ম। প্রায় দেখি বলা হয়, ঢাকা বায়ুদূষণের সেরা শহর। যানজট, জলজট, পানিদূষণ, শব্দদূষণের ঢাকা আড়াই কোটি মানুষের চাপে বসবাসের জন্য যোগ্যতা হারাচ্ছে দ্রুত। সীমিত জায়গা নিয়ে এতো বিপুল জনসংখ্যার নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জগুলো সহজেই অনুমেয়। আমার সুযোগ হয়েছে মেলবোর্ন শহরে ১৬ বছর থাকার। ঢাকায় থেকেছি ১৯৭২ থেকে ২০০৫। পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় থাকার সুযোগ হয়েছে। সহজেই ব্যবধানগুলো অনুভব করতে পারি। আমাদের সামনেই তিলোত্তমা ঢাকা কংক্রিটের বস্তি হয়ে গেল। মাটির নিচে জালের মতো জড়ানো প্রাণঘাতী গ্যাস বিতরণ পাইপলাইন, ওপরে উন্মুক্ত বিদ্যুৎলাইন, শহরজুড়ে বিচ্ছিন্ন এবং অসমন্বিতভাবে চলছে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ। নানা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। বায়ুদূষণের কারণে নানা রোগবালাই লেগেই আছে। সরকার মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়েসহ নানা প্রকল্প করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্রমাগত সাধ্যের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটিতে সীমিত করা সম্ভব না হলে কোনোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। 

ঢাকায় রয়েছে দুই জন নগর পিতা, অনেক সংস্থা। কিছু কোনো এক বিশেষ কর্তৃপক্ষের কাছে সমন্বয়ের দায়িত্ব নেই। যে যার মতো কাজ করছে। ঢাকার মাটির নিচের কোনো নির্ভরযোগ্য ম্যাপ নেই। তাই স্থাপনা পরিকল্পনায় বারবার পরিবর্তন আনতে হয়। খরচ বাড়ে। বাড়ে বাস্তবায়ন সময়। নাগরিক সচেতনতার অভাব। অকুপেশন, হেলথ, সেফটি মানা হয় না। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়ে অনেক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা হয়, প্রায় নিয়মিত গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটে। দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয় না। 

ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড উপেক্ষা করে হাজার হাজার বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে ঢাকায়। অগ্নিনিরাপদ-ব্যবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল। জনসংখা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। ঢাকায় মুক্ত বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত। এবার গ্রীষ্মকালের দাবদাহের সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা অসহনীয় ছিল। তদুপরি বিদ্যুৎ ছিল না।  অথচ ঢাকার চারপাশে চারটি নদী, একসময় নগরজুড়ে অনেক খাল ছিল। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে অনেক খাল হারিয়ে গেছে, নদীগুলো মৃত প্রায়। একসময়ের ঢাকা বৃক্ষরাজি সুশোভিত সবুজ নগরী ছিল। এখন বৃক্ষ নিধন করে ঢাকায় মরুভূমির উষ্ণতা আমদানি করা হয়েছে।

কষ্ট লাগে নিজেদের শহর। ঢাকাকে বসবাসের জন্য অন্যতম নিকৃষ্ট শহরের অপবাদ থেকে রক্ষা করতে হলে অচিরে সবার সমন্বিত প্রয়াসে কিছু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া ১৮ ওয়ার্ডে দুর্গতির আর অন্ত নেই। বিশেষ করে উত্তরা লাগোয়া উত্তরখান, দক্ষিণখান ভাসছে ড্রেনের পানিতে। পয়ঃনিষ্কাশন-ব্যবস্থা পুরাপুরি ভেঙে পড়েছে। বসতবাড়ি-সংলগ্ন বেশির ভাগ রাস্তা ডুবে আছে পয়ঃনিষ্কাশন, দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে। মানুষ চলাচল ও বসবাস করতে চরমভাবে অতিষ্ঠ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে পরিমাণ বসতবাড়ি হচ্ছে বা হয়েছে সে তুলনায় নগর পরিকল্পনা নেই। এছাড়া এ এলাকায় প্রচুর গার্মেন্টস, ওয়াশিং প্ল্যান্ট প্রশাসনের নাকের ডগায়। বিশেষ করে ওয়াশিং প্ল্যান্টে যে রীতিনীতি মানার কথা। ওয়াশের কেমিক্যালযুক্ত পানি রিফাইন করার কথা। তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ফলে ওইসব পানে যেমন রাস্তার অবশিষ্ট যেটুকু রয়েছে, সেটা ধ্বংস হচ্ছে। তেমনি বিষাক্ত পানিতে এলাকার পরিবেশ মারাত্মভাবে দূষিত হচ্ছে। অথচ সরকারের কঠোর নির্দেশনা এসব গার্মেন্টস ও ওয়াশিং প্ল্যান্ট লোকালয় ছেড়ে, তাদের জন্য নির্ধারিত ইপিজেডে চলে যাওয়ার। ওই নির্দেশনা শুধু কাগজ-কলমেই। ফলে ওইসব গার্মেন্টসের পণ্যবহনে যেসব কাভার্ডভ্যান লরি প্রবেশ করে এসব দুর্বল কাঠামোর রাস্তায় তখন অবশিষ্ট রাস্তাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কারণ হেভি পরিবহন চলাচল করার উপযোগী রাস্তা তো ওই তিনটি নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন মাঝেমধ্যে যান পরিদর্শনে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তাদের কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। বাস্তবে কোনো কিছুই আর দেখা যায় না। যেমনটা আগে ছিল বর্তমানেও তেমনই। 

উত্তরখান-দক্ষিণখান থেকে বের হওয়ার যে রাস্তাগুলো তার অন্যতম আটিপাড়া হয়ে আব্দুল্লাহপুর, মাজার চৌরাস্তা হয়ে আজমপুর, দক্ষিণখান বাজার হয়ে কসাইবাড়ি। এ তিন রাস্তার অবস্থাই বেহাল। বিশেষ করে মাজার থেকে আজমপুর রেলগেট পর্যন্ত রাস্তা সারা বছরই নর্দমার পানিতে হাঁটু অবধি ডুবে থাকে। এ ব্যাপারে বহু রিপোর্ট হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায়। অথচ কর্ণপাত করছে না সিটি করপোরেশন। দেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে সেটার সঙ্গে যখন এ রাস্তাগুলোর তুলনা করা হয়, সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। অথচ সামান্য উদ্যোগেই এটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু সেদিকে মেয়র বা সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের খবরই নেই। মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হলেও তারা অজ্ঞাত কারণে নিশ্চুপ। একইভাবে অপর দুই রাস্তারও বেহাল অবস্থা। শোনা গেছে, অত্র এলাকার জন্য বিশাল এক বাজেট অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু অর্থ নেই। এমন বাজেট দিয়ে কী হবে? বাজেটের দোহাই দিয়ে সব দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণ নষ্ট হচ্ছে, বিশেষ করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এয়ারপোর্ট, উত্তর মডেল টাউন লাগোয়া যে এলাকার অবস্থান। তিন রাস্তার যে জায়গা সেটাও বেশির ভাগ দখলমুক্ত নয়। মেয়র বিভিন্ন স্থানে সিটি করপোরেশন তথা, সরকারি জমি উদ্ধারের অপারেশন চালান। কিন্তু ওই এলাকার জন্য ওইকাজগুলো সম্ভবত প্রযোজ্য নয়। বেশির ভাগ সময় ময়লার পানিতে ডুবে থাকায় এলাকার গ্যাসলাইন, সুপেয় পানির লাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা পরবর্তী সময়ে বড় সংকটের কারণ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ঢাকা বা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেরও কোনো স্থান-এমন নর্দমাযুক্ত এলাকা রাস্তাঘাট রয়েছে বলে জানা নেই। অথচ বিশাল জনগোষ্ঠীর এ অঞ্চল তেমনটাই। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সহসাই। এসব কাজের জন্য এ এলাকায় সাধারণ মানুষের ভোট পেতে ক্ষমতাসীনদের কষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা! এতো দুর্ভোগের পর মানুষ ক্ষমতাসীনদের ভোট দিতে ভাববে তেমনটাই মনে হয়। অথচ এ এলাকা পার হয়ে সেক্টরে প্রবেশ করলেই তিলোত্তমা ঢাকার একটা আভাস মেলে। অথচ রেললাইনের ওপার অমন দুর্ভোগ। অনেকটাই বিমাতাসুলভ আচরণের মতো। মানুষ ভীষণ সমালোচনা করছে এ বিষয়ের। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। 

আসলে দুই সিটি করপোরেশনকে সব উন্নয়নের ফোকাল পয়েন্ট বানাতে হবে। মানুষের সুবিধার্থেই। সব সংস্থা কাজের জন্য নগর ভবনে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। 

অচিরে ঢাকার চেক পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে যেমন মতিঝিল, কাওরান বাজার, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, বিজিবি সদরদপ্তর, পুরান ঢাকা, বিমানবন্দর, কেন্দ্রীয় সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার স্থাপনাগুলোর জন্য ঢাকার বাইরে জায়গা সংকুলান করে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর করতে হবে। মাটির নিচে থাকা শতছিন্ন গ্যাস বিতরণ লাইনগুলো বন্ধ করে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। নদীগুলো এবং খালগুলো যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে উদ্ধার করে জলযানে যাতায়াতব্যবস্থা করতে হবে। 

ঢাকার পাশে পূর্বাচলের মতো পদ্মা বহুমুখী সেতুর উভয় পাড়ে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। ঢাকার সঙ্গে আশপাশের শহরগুলোর রেল কমিউটার যোগাযোগ স্থাপন করা হলে বহুমানুষ প্রতিদিন ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় এসে কাজ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জনসচেতনতা সৃষ্টি, ঢাকাকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য। না হলে প্রতি বছর ঢাকাকে এ ধরনের কলঙ্ক তিলক পরতেই হবে।

শেয়ার করুন