২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৬:০৪ পূর্বাহ্ন


রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৫-২০২২
রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সাধারন মানুষের রোষানলে মন্ত্রী এমপিদের বাড়ী-ঘর/ফাইল ছবি


শ্রীলঙ্কায় লঙ্কাকাণ্ড সম্ভবত অন্য কোথাওর জন্য শোভনীয় নয়, ওটা ওখানেই মানায়। সাবেক মন্ত্রীদের প্যান্ট খুলে রাস্তায় মেরে যেভাবে ঘুরাচ্ছে জনগণ, এদের অধীনস্তদের কী অবস্থা ওটা শুধু আন্দাজ করেই নিতে হয়। এটা তো ফিজিক্যাল অ্যাটাক। মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি যেভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে, তাতে অধীনস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়িঘর সহায় সম্পদের যে কী হয়েছে সেটা গনিমতের মালের মতোই হওয়ার কথা। যারা দেশ ছেড়ে গেছেন তারা দিনে হাজারবার শুকরিয়া জানাচ্ছেন সৃষ্টিকর্তাকে। যারা যাননি তাদের ওই দুর্গতি। জনগণ ক্ষেপলে তো আর গর্তে লুকিয়ে থাকা যায়না, ঠিকই বের করে আনবেন, আনছেনও। সব তো আর খবর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হয়না। 

কেন শ্রীলঙ্কার এ দুরবস্থা 

শিল্প-প্রতিষ্ঠানেরসহ ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি হওয়ার ঘটনা নিত্যবিষয়। কম-বেশি সব দেশেই আছে, শ্রীলঙ্কায় তেমনটা নয়। তবে তার চেয়েও ভয়াবহ, সেটা হলো রাষ্ট্রের ঋণখেলাপি হওয়া। ২০০৬ সালের পর দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ শ্রীলঙ্কা এখন রাষ্ট্রীয়ভাবেঋণখেলাপি। তাহলে এ দায়টা কার ওপর গিয়ে পড়বে। সরাসরি জনগণের মাথায়। কারণ রাষ্ট্রের দায় তো জনগণের ওপরই পড়বে। মন্ত্রী-এমপিরা তো সেটা নিতে পারেন না। এ রাষ্ট্রীয় ঋণখেলাপির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাওয়া এবং এ সুবাদে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে মালামাল বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, যেমন- জীবন রক্ষাকারী মেডিসিন, তেল,গ্যাসসহ অনেক কিছু। সব তো সব দেশে হয় না। শ্রীলঙ্কাতেও তাই। অনেক কিছু আমদানি করতেই হবে। কিন্তু কোষাগার শূন্য হওয়ায় ওই আমদানি চলে গেছে অনেকটাই শূন্যের কোঠায়।

মানুষের জীবনযাপন বা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম,জীবনরক্ষা চলে কীভাবে? বিদ্যুতে লোডশেডিং ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা। সংসার, অফিস-আদালত কীভাবে চলে? সাথে খাদ্যসংকট তো আছেই।


শ্রীলঙ্কায় এ সংকটের বাজারের একটা চিত্র 

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এ বছর চালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মুরগির দাম বেড়েছে দেড়গুণ, কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়েছে। গরুর মাংসের দাম দেড়গুণ হয়েছে। নারকেলের দাম বেড়েছে ৮১ শতাংশ। পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। 

২০২১ সালে শ্রীলঙ্কায় পেট্রলের দাম ছিল ১৩৭ শ্রীলঙ্কান রুপি। ২০২২-এ এসে তার দাম হয়েছে ২৫৪ রুপি আর এক বছরের ব্যবধানে ডিজেলের দাম ১০৪ রুপি থেকে ১৭৬ রুপি। ২০২১ সালে সংসারকার্যে ব্যবহৃত সাড়ে ১২ কেজি এলপিজি গ্যাসের দাম ছিল ১ হাজার ৪৯৩ শ্রীলঙ্কান রুপি, যা ’২২-এ এসে তা হয়েছে ২ হাজার ৭৫০ রুপি। শুধু কী তাই। টাকা থাকলেও পণ্য পাওয়া যাচ্ছেনা। কারণ আমদানিই তো বন্ধবা সীমিত। 

বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সমস্যার শুরু ২০১৯ সালে। ওই বছর কলম্বোয় তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দেশি-বিদেশি মারা যায় প্রায় আড়াইশো মানুষ। ইস্টার সানডেতে ওই হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে ধস নামে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতে। আয় কমে যায় দেশটির। এরপর কোভিডের আক্রমণ তো আছেই। 

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসার বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তও ছিল। যাতে করে তিলে তিলে শ্রীলঙ্কা আজকের এ অবস্থানে। 

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ 

বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই রাজনীতির মাঠে চলছে কথার লড়াই। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করারও প্রাণান্তর চেষ্টা। মূলত সামনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেটাকে ঘিরেই মানুষের মনে আস্থা পেতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দেশের বর্তমান অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবিএনপির মধ্যেই ওই লড়াই। 

ফলে এমনি মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার লঙ্কাকাণ্ডে অনেকেই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলাদেশে টেনে আনার চেষ্টা করছেন। এক পক্ষ বলছে শ্রীলঙ্কান সরকার যেমন একের পর এক উচ্চাভিলাষী লোক দেখানো প্রজেক্ট নিয়েছিল সেগুলোর মতো বাংলাদেশেও বেশকিছু মেগাপ্রজেক্ট নেয়া হয়েছে। যাতে দেশের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে। বর্তমান বাজারদর পর্যবেক্ষণ করে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করছে। এছাড়াও  বিদেশি ঋণে মেগা প্রজেক্টগুলোতেও মেগা দুর্নীতির অভিযোগও তুলছে। এবং প্রমাণ স্বরূপ প্রতিটা প্রজেক্টে বারবার খরচবৃদ্ধির ও অপ্রয়োজনীয় ও লোক দেখানো কিছু প্রজেক্টের উদাহরণও টানা হচ্ছে। ফলে এসবের দায়ভার একসময় শ্রীলঙ্কার মতো দেশের জনগণের ওপরই বর্তাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। ক্ষমতাসীনরা এর চরমভাবে বিরোধিতা করছেন।


ওবায়দুল কাদের,সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ 

শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গে বিরোধীদলসমূহের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কিছু কিছু চিহ্নিত গণমাধ্যম ও বিদেশি সাহায্যপুষ্ট কতিপয় তথাকথিত গবেষণা সংস্থা তাদের মনগড়া ও বাস্তবতা বিবর্জিত আষাঢ়ে গল্প পরিবেশন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। যতদিন আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হবে, তত দিন দেশের জনগণের জীবন সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশ কখনোশ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান হবে না।’

এর আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত ইউনিট কমিটির পরিচিতি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন ‘বাংলাদেশ নাকি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে। যারা এসব বলছেন তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচারে নেমেছেন। শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী কিন্তু বাংলাদেশে অনেক নিয়ন্ত্রণে।

শেখ হাসিনা আজ সারাবিশ্বের বিস্ময় উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে, নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ হচ্ছে। পদ্মা সেতু আজ দিনের আলোর মতো সত্য। অপপ্রচার করে পদ্মা সেতু, কর্তফুলী টানেল, মেট্রোরেল বন্ধ করা যাবে না। এগুলো এখন স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু বিদেশিদের ঋণে নয়, নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। উই ক্যান, ইয়েস উই ক্যান। আমরা পারি। আমরা শুধু স্বপ্ন দেখাই না, দেখাতেও জানি। যারা অপপ্রচার করছেন আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন। অপপ্রচার করে শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করা যাবে না।’ 


মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব,বিএনপি 

বিএনপি মহাসচিব সরকারের কড়া সমালোচনা করে বলেন,‘সরকারের প্রছন্ন মদদে ও তাদের পূর্ণ সহযোগিতায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের নিজেদের সিন্ডিকেটরাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে একটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করছে। তাদের সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টাকা-পয়সা লুট, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়ার কারণে কালবিলম্ব না করে অচিরেই পতদ্যাগ করা উচিত। এতে দেশের মঙ্গল হবে, জনগণও স্বস্তি পাবে।’

গত শুক্রবার বিকালে ঠাকুরগাঁও এ সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল জোর দিয়ে বলেন, ‘শুধু আভাস নয়, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে বাধ্য। কারণ হচ্ছে, একইভাবে এখানকার অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়েছে, এখানে ঋণ এতো বেশি গ্রহণ করা হয়েছে যে, ইতোমধ্যে ঋণের বোঝা জনপ্রতি ৪৭২ ডলার করে পড়েছে। ওখানকার মতো পরিস্থিতি এখানেও দেখা দেবে। মুদ্রাস্ফীতি এত বাড়বে যে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’


রেজা কিবরিয়া, আহ্বায়ক গণঅধিকার পরিষদ 

ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট এখন রাজনৈতিক সংকটেও রূপ নিয়েছে। যেটি পরবর্তীতে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ, দুর্নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে আসায় তাদের এই দুর্গতি। বাংলাদেশ বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হবে কি না।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। তাদের একটাই প্রশ্ন বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হতে পারে কি না। আমার উত্তর হলো হ্যাঁ, হতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে না আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। দেশের একজন অর্থনীতিবিদ বলেছে দুই-তিন বছর পর হতে পারে। আমি মনে করি পাঁচ-ছয় বছর পর হতে পারে, আমরা যে পথে আছি সেটা হওয়া সম্ভব। তখন এটা থেকে বের হয়ে আসতে আমাদের ১২ থেকে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে। এই সমস্যাগুলো একদিনে হয় না। শ্রীলঙ্কা সরকারের অদক্ষতা তাদের দুর্নীতি তাদের স্বৈরাচারী শাসনের জন্য এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।’ 

চীনের অর্থায়নে হওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর সফলতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বড় অনেক প্রজেক্টের আমরা কোনো বেনিফিট পাবো না অনেক বছর পর্যন্ত। কক্সবাজারে একটা রেলওয়ে ট্রাক হচ্ছে, এটাতেও কোনো লাভ নেই। চট্টগ্রামে একটা টানেলের করেছে, এটা তো তেমন কোনো অর্থনৈতিক লাভ নেই। পায়রা সফলতার সম্ভাবনা অলমোস্ট জিরো। এতোগুলো প্রকল্প তারা কেন নিয়েছে? কারণ মেগাপ্রকল্প একটা দুর্নীতিবাজ সরকারের খুব পছন্দ পছন্দের জিনিস কারণ মেগাপ্রকল্প মেগা কমিশন পাওয়া যায়। সমস্যা হলো তারা যে টাকা খরচ করেও যে টাকা চুরি করে সে টাকা মানুষের ঋণের বোঝা হয়ে ওঠে এবং জনগণকে সেই টাকা পরিশোধ করতে হয়।’


শেয়ার করুন