২৭ জুলাই ২০১২, শনিবার, ১০:৩৭:০৪ পূর্বাহ্ন


১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকের নেপথ্যে...
অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সঙ্কটে আ.লীগ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৫-২০২৪
অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সঙ্কটে আ.লীগ


প্রধানমন্ত্রীর সাথে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সাথে গণভবনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠক খোদ আওয়ামী লীগে নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ৭ জানুয়ারির পর আচমকা এমন বৈঠকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কানা-ঘুষার শেষ নেই। কি কারণে, কি উদ্দেশ্যে শরিকদের সাথে আওয়ামী লীগের সভাপতি বৈঠকটি করলেন তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা যেমন আছে আছে তাদের মধ্যে নানান ধরনের শঙ্কা। 

কি আলোচনা হলো?

২৩ মে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যা ৭টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বৈঠকের মূলত প্রধান ভূমিকা রাখেন, জানিয়েছেন তাদের ক্ষোভ আক্ষেপের কথা । বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, গণতন্ত্রী পার্টির (একাংশ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. শহিদুল্লাহ সিকদারও তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

বক্তব্যের কিছু চুম্বক অংশ

প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে উপস্থিতদের বক্তব্যের কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসার পাশাপাশি সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন যা বললেন তা ছিল- তিনি ১৪ দলের জোটের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন, আবার জানতে জান, ‘জোট আছে কি না? জোটের গতিবিধি কোন পথে? আপনি যেভাবে বলবেন, সেভাবেই হবে। আপনার মুখ থেকে আমরা শুনতে চাই। অন্যদিকে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, জোটের প্রার্থী করে লাভ কী হলো? সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা প্রার্থী হয়ে গেলেন। আমাকে নৌকার লোকের বিরুদ্ধে ভোট করতে হলো। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বললেন, জোট নেই। এখন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা বলেন, জোট নেই, তখন তো প্রশ্ন থেকেই যায়, জোটের গতি কোন পথে? এখন আপনার কাছেই সমাধান চাই।

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা-মন্ত্রীরা বলেন, বাম দলের ভোট নেই। আমাদের নিজস্ব কোনো ভোট নেই। আমাদের যদি ভোট না থাকে, তাহলে কল্যাণ পার্টির জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কি ভোট আছে? সে ইবরাহিম কীভাবে কক্সবাজার থেকে এমপি হয়ে আসে? তার কত ভোট? আমাদেরকে বলেন, শক্তি বাড়াতে? কীভাবে শক্তি বাড়াব? অপরদিকে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী তুলে ধরেন তার জীবন ঝুঁকির বিভিন্ন দিন। জামায়াতে ইসলামীকে চাপে রাখতে কীভাবে মামলা করেছেন এবং অতীতে তাঁর দলের অবদান তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এই অবদান ভুলে গেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী যা বললেন

এদিকে বৈঠকে ১৪ দলের এই নেতাদের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জোটের প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই আপনাদের ডেকেছি। জোট থাকবে না কেন? ছিল, আছে, থাকবে, আশ্বাস দেন তিনি। এর পাশাপাশি তিনি অকপটে কিছু তথ্যও দেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন নিয়ে তো নানামুখী ষড়যন্ত্র ছিল। নির্বাচন বানচাল করার বড় চক্রান্ত ছিল। শুধু কি তাই? নির্বাচন ঠেকানোই নয়, আমার বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র ছিল। আমাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত ছিল। আমি এসব পরোয়া করি না। আমি দেশের জনগণের জন্য কাজ করে যাব। জোটের কার্যকারিতা আছে। আপনারাই ছিলেন, আপনারাই থাকবেন। একসঙ্গেই আমরা থাকব।

বৈঠকের নেপথ্যে কি ছিল?

চারিদিকে বলা হচ্ছে দেশের অবস্থা ভালো না। গণমাধ্যমের খবরেও বলা হচ্ছে অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক আরও খারাপ হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিকভাবেও সঙ্কটের কথা ক্ষমতাসীনদের শীর্ষমহল থেকেই আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী দেশ ঘাঁটি বানাতে চায়। এটা হতে দিচ্ছেন না বলেই কিছু সমস্যা হচ্ছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, মূলত আর এসব কারণেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম শরিক বামদলগুলির ডাক পড়েছে। কারো মতে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার বিশ্বস্ত শরিকদেরই কাছে ডেকেছে। এমন খবর মিলেছে রাজনৈতিক মাঠের বিভিন্ন সূত্র থেকে। অন্যদিকে আরো কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে শরিকদের মধ্যে একটা চরম অস্থিরতা আর লাগামহীন বক্তব্য দেওয়া নিয়েও। সম্প্রতি ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ের সামনে ‘মুক্তিযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু কিছু আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। বলেন, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কিছু ত্রুটি ঘাটতিসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি দেশ চালাচ্ছে। সেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে যে কোনো মূল্যে উৎখাতের জন্য রাজাকার পক্ষ জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বামপন্থিরা কীভাবে ভূমিকা রাখবে-সেটি যদি নিষ্পত্তি করতে না পারি, তাহলে একদিন সা¤্রাজ্যবাদের লেজুড় রাজাকার পক্ষকে ক্ষমতায় দেখতে হবে। অন্যদিকে ২৩ দফার ভিত্তিতে গঠিত ১৪ দলীয় জোটে ২৩ দফার বিন্দুমাত্র নেই উল্লেখ করে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হবে। বিএনপি-জামায়াত লুটপাট করতে যে ভুলগুলো করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায় এলে তা থেকে আমরা মুক্তি পাব। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু আজ আমাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। ১৫ বছর আগে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে যে স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলাম, সেই আন্দোলন নিষ্ফল হয়ে গেছে। আজ ১৪ দলীয় জোটের ২৩ দফার বিন্দুমাত্র নেই। কারো কারো মতে, শরিকদের এসব ক্ষোভ মেটাতেই মূলত প্রধানমন্ত্রী বৈঠকটি করেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন ধরেই নিয়েছে যে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক যা-ই হোক না কেনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পিছু ছাড়ছে না। এমন সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এসব বাম প্রগতিশীলের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিই সরকারের অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী বলে তারা মনে করে।

অন্যদিকের মার্কিনীদের বিরুদ্ধেও এদের কন্ঠস্বর রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ ভূমিকা রাখে বা রাখতে পারে বলেই আওয়ামী লীগ মনে করে। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মুখে এমন কথাও শোনা গিয়েছিল যে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ায় বিএনপির মাথা আরও খারাপ হয়ে গেছে। কারণ, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এমন সময়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সোয়া তিন বছর আগে ওঠা অভিযোগের সূত্র ধরে সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা এক নতুন বিব্রতকর অবস্থার তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তা না হলে যেই আওয়ামী লীগ নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে শরিকদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ এনে দিয়েছিল। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ একাদশ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের মন্ত্রিসভায় এসব শরিক দলের কাউকে রাখা হয়নি। অন্যদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিকদেরকে ১৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা কমিয়ে সাতটি করা হয় আওয়ামী লীগের তরফ থেকে। আবার এই সাত আসনেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় শরিক দলের দুই শীর্ষ নেতা নির্বাচনে পরাজিত হন। প্রশ্ন দেখা দিলো কেনো এমনই ভূমিকা থেকে হঠাৎ নমনীয় হয়ে গেলো আওয়ামী লীগ? কেনো ডেকে বৈঠক করলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এসব শরিকদের সাথে? কারো কারো মতে, বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে এসব শরিকদের মূল্য বেড়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে। মোটকথা, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে এসব বিশ্বস্ত শরিকদের ডাক পড়েছে- এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

শেয়ার করুন