১৬ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ৬:১৫:২৯ অপরাহ্ন


জুতার মালা শিক্ষকের গলায় নয় জাতির গলায়
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৭-২০২২
জুতার মালা শিক্ষকের গলায় নয় জাতির গলায়


বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের ওপর হামলা, গলায় জুতার মালা এবং হত্যার প্রতিবাদে গত ৩ জুলাই বিকেলে জ্যাহসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়। উদীচী যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহ-সভাপতি কাশেম আলীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলীম উদ্দিনের পরিচালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, এই গলার মালা শিক্ষকের গলায় নয়, এই গলার মালা পুরো জাতির গলায়।

যারা দেশ পরিচালনা করছেন তাদের গলায়। তারা বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, এই দেশের জন্য নয়। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সরকার বলে কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই সরকার হচ্ছে মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করা সরকার। কোনো কোনো বক্তা বলেন, শেখ হাসিনা আপনার সময় ফুরিয়ে এসেছে। মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে আপনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।

আপনি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, এ কথা ভুলে যাবেন না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা বলতে পারি আপনার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারা আরো বলেন, আমরা ’৭২ সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না গেলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিঃশেষ হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র উদীচী, প্রোগ্রেসিভ ফোরাম এবং মহিলা পরিষদ আয়োজিত এই বিক্ষোভ সমাবেশে তারা আরো বলেন, আমরা অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে লক্ষ করছি ধর্ম অবমাননার অজুহাত তুলে ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ, হত্যা-নির্যাতন এবং নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে। মাস দুয়েক আগে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মদনপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ওপর মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে অপমান করে জেলে ঢোকানো হয়। আক্রমণের আগ থেকে তার বাড়িতে গিয়ে হুমকি, গালাগাল করা হতো। অভিযোগ করেও কোনোও প্রতিকার পাননি। তার ওপর অন্যায়ের প্রতিবাদে সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিবাদ ওঠায় এক পর্যায় সরকার বাধ্য হয়ে তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে। একাত্তর টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, আজো পুলিশ তার ওপর থেকে মিথ্যা মামলার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়নি। অভিযুক্তদেরও কোনো শাস্তি কিংবা বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় সপ্তাহ দুই আগে যশোহর নড়াইল কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ^াসকে অহেতুক ধর্মীয় অভিযোগে গলায় জুতার মালা পরিয়ে থানায় নেওয়া হয়। লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয় পুলিশের উপস্থিতিতে তার গলায় জুতার মালা পরানো হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর অনুসারে তখন কলেজ কম্পাসে বিক্ষুব্ধ শপাঁচেক পাবলিক থাকলেও কলেজ ঘিরে একশতের ওপর পুলিশ, পুলিশের এসপি, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, স্থানীয় এমপিসহ সর্বস্তরের প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন। তাই অভিযোগ উঠেছে পুলিশ, প্রশাসন, এমপিসহ স্থানীয প্রশাসনের ভ‚মিকা নিয়ে। আরো অভিযোগ ঘটনার পর সপ্তাহ দিন অতিবাহিত হলেও কোনো ভ‚মিকা না নেয়া নিয়ে। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যম এবং কিছুসংখ্যক পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ঘটনা তুলে ধরলে তখন প্রশাসন সক্রিয় হতে দেখা যায়। আরো লক্ষণীয় বিষয় প্রতিটি ঘটনার পেছনে মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভ‚মিকার সাথে স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার দলীয় ও প্রশাসনের যোগসূত্র রয়েছে। ঘটনার পর কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও প্রশাসন ও সরকার দলীয়রা অধরা থেকে যান। 

এই ঘটনার দিন দুই পরেই ঘটলো আশুলিয়ায় আরেকটি বেদনাদায়ক ঘটনা। কলেজের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত শিক্ষক উৎপল সরকারকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকবৃন্দ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে খেলার মাঠে কলেজেরই শিক্ষার্থী জিতু তাকে খেলার ব্যাট দিয়ে আঘাত করে। এবং হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পর জিতুকে ধরে রাখলেও পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কারণ কলেজের সভাপতি তার দাদা, মামা গভর্নিং বডির সদস্য। তাদের প্রভাবে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। একইভাবে নড়াইলের ঘটনায় দেখা গেছে স্বপন কুমার বিশ^াসের সাথে তারই সহকর্মী শিক্ষক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আক্তার হোসেন ঘটনার সাথে জড়িত। আক্তার হোসেন জুনিওর থাকায় অধ্যক্ষ হতে পারেননি। সেই ক্ষোভ থেকে মৌলবাদীদের সাথে সম্পর্ক করে ধর্মের মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। অথচ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ^াসের ঘটনার সাথে কোনোও যোগসূত্র ছিল না। একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে পুলিশের পাহারায় থানায় নেওয়া হলো, পুলিশ, প্রশাসন কিছুই করলো না। সমগ্র শিক্ষক সমাজ, সমগ্র জাতি এবং সরকারের মুখে চুনকালি লেপ্টে দেয়া হলো। এর চেয়ে লজ্জার, ঘৃণার আর কি হতে পারে। একইভাবে এই ঘটনার পর পর বাগেরহাটে শিক্ষক কৃষ্ণপদ বসাকের ওপর আক্রমণ হয়েছে।

বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ওপর আক্রমণের সময় ঢাকার ফার্মগেটে কপালে তিলক পরায় অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ কর্মকর্তা দ্বারা এক অধ্যাপিকা নিগৃতীত হয়েছেন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক অনুণ কুমার বসাককে তার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আদালতের রায় পক্ষে থাকা সত্বে দীর্ঘদিন থেকে প্রভাবশালী সরকার দলীয়দের কারণে নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ জীবনযাপন করছেন। এখানেই ঘটনার শেষ নয়, ঘটনাগুলো অনেক আগে থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় সরকার দলীয় এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা পেছনে লিপ্ত। নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক শ্যামল ভক্তের বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্মীয় অভিযোগ তুলে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান তাকে কান ধরে উঠবস করান। সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, কারণ সেলিম এমপি’র বড় ভাই শামীম ওসমান সরকার দলীয় প্রভাবশালী এমপি। চট্টগ্রাম হাটহাজারীর উত্তম বড়–য়া এখনো ধর্ম অবমাননার অভিযোগ মাথায় নিয়ে পালিয়ে আছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজও একই অভিযোগ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেননি। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার নিরীহ ঝুমন দাসের মাথার ওপর এখনও পুলিশি খড়্গ ঝুলে আছে। অথচ ৫৬ জন অভিযুক্ত সরকার দলীয় হওয়ায় তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। 

এই বিচারহীনতা ও উদ্দেশ্যমূলক বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থের খপ্পড়ে পড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষকরা মৌলবাদী গোষ্ঠী তার সঙ্গে সরকারদলীয় একটি শ্রেণি ও প্রসাসনের যোগসাজশে সংখ্যালঘু শিক্ষকরা হত্যা-নির্যাতন ও নিগৃহীত হওয়ার শিকারে পরিণত। অন্যদিকে দেশের বুদ্ধিজীবী মহল, শিক্ষক সংগঠনগুলো প্রতিটি ঘটনায় নির্লিপ্ত ও নিষ্ক্রিয় থাকার ঘটনার বিস্তৃতি ঘটে চলেছে। আমরা ঘটনাপ্রবাহের অবসান চাই। একইসাথে প্রতিটি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও বিচার নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি। 

প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- শরাফ সরকার, বাবুল আচার্য, অধ্যাপক সৈয়দ মুুজিবুর রহমান, অ্যাডভোকেট শেখ আক্তারুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা অভিনাস আচার্য, সুলেখা পাল, রথীন্দ্রনাথ রায়, শহীদ হাসান, রীনা সাহা, খোরশেদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, ওবায়দুল্লাহ মামুন, হাফিজুল হক, সুব্রত বিশ্বাস, কাশেম আলী প্রমুখ।



শেয়ার করুন