২৮ নভেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:১৯:৫৩ পূর্বাহ্ন


টোকিও ডিজনিল্যান্ড
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১১-২০২৫
টোকিও ডিজনিল্যান্ড


যুক্তরাষ্ট্রের দুপ্রান্তে রয়েছে দুটি ডিজনি পার্ক। একটি ক্যালিফোর্নিয়ায়-নাম ‘ডিজনিল্যান্ড’। আর ফ্লোরিডার অরলান্ডোতে রয়েছে অপরটি-‘ডিজনিওয়ার্ল্ড’। একটির অবস্থান প্যাসিফিক মহাসাগরের উপকূলে, অন্যটি আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে। দুটো ডিজনিই আমার ঘুরে দেখা হয়েছে। দেখেছি ফ্রান্সের প্যারিস ডিজনিও। এবার যখন জাপান ভ্রমণে এলাম, ভাবলাম টোকিও ডিজনিটা বাদ দিই কেন?

গাইড নিকিতাকে বলতেই সে টোকিও ডিজনিকে ভ্রমন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে নিলো। টোকিও শহরের ভিড় আর কোলাহল পেছনে ফেলে আমি আর নিকিতা টোকিও স্টেশন থেকে রওনা দিলাম ডিজনি ল‍্যান্ডের উদ্দেশ‍্য। ভোরের সূর্য ধীরে ধীরে শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ছিল।

ট্রেনের জানালার বাইরে চোখে পড়ছিল কংক্রিটের সেতু, ছোট ছোট পার্ক, আবাসিক বাড়ি, ব্যবসায়িক অফিস ইত‍্যাদি। ডিজনিল্যান্ড টোকিওর শহর থেকে ট্রেনে মাত্র আধঘণ্টার পথ। ট্রেন এসে থামলো মাইহামা স্টেশনে। এটি টোকিও ডিজনিল্যান্ডের প্রবেশদ্বার। স্টেশনে নামার আগেই ট্রেনের জানালা দিয়ে চোখে পড়ল বিশাল গেট, দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ডিজনির দুর্গ, যেন শৈশবের কার্টুন থেকে হঠাৎ বাস্তবে এসে গেছে।

স্টেশন থেকে বের হতেই দেখা মিলল রঙিন বেলুন, শিশুরা দৌড়াচ্ছে এবং দূরে সিন্ডারেলা ক্যাসেল আকাশছোঁয়া উঁচুতে দাঁড়িয়ে। মনে হলো, আমি প্রবেশ করছি এক স্বপ্নের রাজ্যে। গেট পার হতেই মনে হলো আমি আর টোকিওতে নেই, বরং রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করেছি। চারপাশে শিশুদের হাসি, রঙিন পোশাক, মিকি-মিনি চরিত্রদের হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানো। বাতাসে মিষ্টি তুলার গন্ধ, পপকর্নের সুবাস আর সঙ্গে বাজছে ডিজনির সুর।

ফ্যান্টাসি ল্যান্ড ঘুরতে গিয়ে যেন শৈশব ফিরে গেলাম। সিন্ডারেলার দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, ছোটবেলায় দেখা পরীর গল্পগুলো সত্যিই আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দুর্গের ভেতরে আলো আর কাচের সাজে তৈরি প্রতিটি কোণ যেন স্বপ্নের ক্যানভাস। তারপর গেলাম অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ডে। পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান রাইডে চড়ে মনে হলো সত্যিই যেন জনি ডেপের দস্যুদের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়েছি। অন্ধকার গুহা, জলের ধ্বনি আর দস্যুদের গান-সব মিলিয়ে যেন সিনেমার ভেতরে প্রবেশ করেছি।

টুমরোল্যান্ডে ঢুকে হঠাৎ ভবিষ্যতের শহরে এসে পড়লাম। স্পেস মাউন্টেন রোলার কোস্টার চড়ার সময় গা শিরশিরে এক রোমাঞ্চ। চোখের সামনে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে দৌড়ে চলেছে আর আমি যেন মহাকাশযাত্রায় ছুটে চলেছি। ডিজনিল্যান্ড শুধু শিশুদের জন্য নয়, প্রাপ্তবয়স্কদেরও জন্য সমান আনন্দের। প্রতিটি প্যারেড, প্রতিটি চরিত্র যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ বড় হলেও স্বপ্নের বয়স কখনো বাড়ে না। বিকালে যখন রঙিন পোশাকে মিকি-মিনি আর তাদের বন্ধুরা রাস্তা জুড়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে এলো, আমি নিজেও হাত নেড়ে শিশুর মতো উল্লাস প্রকাশ করলাম।

দিনের শেষে রাতের আতশবাজি শো— ‘ডিজনির ফায়ারওয়ার্কস’-হলো ভ্রমণের আসল পরিণতি। সিন্ডারেলার দুর্গের ওপর আকাশ ভরে উঠলো রঙিন আলোতে। প্রতিটি বিস্ফোরণ যেন মনে করিয়ে দিলো, রূপকথা আসলে কেবল বইয়ের পাতায় নয়, আমাদের চারপাশেও আছে। টোকিও ডিজনিল্যান্ড ঘুরে মনে হলো, আমি যেন একদিনের জন্য বাস্তব ভুলে গেলাম। এটা কেবল একটি পার্ক নয়, বরং এক অমলিন অভিজ্ঞতা, যেখানে মানুষ বয়স ভুলে আবারও নিজের শৈশবে ফিরে যায়।

কালো দুর্গের শহর মাতসুমোতো

টোকিওর ব্যস্ত ছন্দ থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য যদি কেউ নীরবতা, ইতিহাস আর পাহাড়ের কাছে আশ্রয় নিতে চায়, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে কাছের আদর্শ শহর হবে মাতসুমোতো। জাপানের নাগানো প্রি-ফ্যাকচারের এই ছোট শহরটি যেন শিল্প, প্রকৃতি আর সামুরাই-ইতিহাসের এক অনন্য সংমিশ্রণ। আর এই শহরের প্রাণকেন্দ্রেই দাঁড়িয়ে আছে কালোরঙা মহিমায় মোড়া মাতসুমোতো ক‍্যাসেল, যা জাপানি স্থাপত্যের অন্যতম সেরা সংরক্ষিত নিদর্শন।

সেদিনের সকালে টোকিও জেগে উঠেছিল হালকা রোদে। পাতাল রেলের শব্দ, ব্যস্ত রাস্তা, আর মানুষের আনাগোনায় শহরটি যেন নিজের ছন্দে নাচছিল। সেই ভোরের শান্ত আলোয় আমি আর গাইড নিকিতা শিনজুকু স্টেশনের দিকে হাঁটছিলাম। আমাদের গন্তব্য মাতসুমোতো জাপানের পাহাড়ঘেরা এক শিল্প-সংস্কৃতির শহর।

শিনজুকু স্টেশনে পৌঁছানোর পর নিকিতা টিকেট কাউন্টারের দিকে ইশারা করে বল্লো, আজ আমরা জেআর আজুসা এক্সপ্রেস ধরবো। এ ট্রেনটি টোকিও থেকে আমাদের সরাসরি মাতসুমোতো নিয়ে যাবে। ট্রেন যখন স্টেশন ছাড়লো, নিকিতা বললো, আজ যাত্রাপথে তোমাকে জাপানের আলপস দেখাবো। শহর ছাড়লেই তোমার চোখে পড়বে সবুজের ঢেউ। ঠিক তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই জানালার চেহারা বদলে গেল উঁচু দালানের বদলে দেখা দিলো উপত্যকা, স্রোতধারা, ছোট গ্রাম আর দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়। ক্রমেই বদলে যেতে লাগলো নগরচিত্র। উঁচু বিল্ডিংয়ের ভিড় মিলিয়ে সবুজে মাখামাখি উপত্যকা দেখা দিলো। নিকিতা জানালার বাইরে তাকিয়ে বললো, নাগানো প্রি-ফ্যাকচারের পাহাড়গুলোকে বলে জাপানিজ আলপস। আজ ওগুলো তোমার সঙ্গেই থাকবে পুরো রাস্তা। ট্রেনটা নদীর তীরঘেঁষে ধারে ধীরে পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছিল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম, কাঠের ঘর, ধানক্ষেত-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পুরো ভ্রমণটাই যেন একটা চলমান পোস্টকার্ড। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ট্রেন গার্ডের ঘোষণা এলো পরবর্তী স্টেশন মাতসুমোতো।

স্টেশন থেকে বের হয়েই চোখে পড়লো শহরের শান্ত সৌন্দর্য। বড় শহরের মতো ভিড় নেই, কিন্তু আছে নিজের মতো একটা শৈল্পিক গাম্ভীর্য। নিকিতা বলল, আমরা প্রথমেই যাবো মাতসুমোতো ক‍্যাসেল দেখতে। হাঁটার সময় চোখে পড়লো রাস্তার দু’ধারে ছোট ক্যাফে, আর্ট শপ, পুরোনো কাঠের বাড়ি। ক্যাসলের সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো আমি যেন ১৬০০ শতাব্দীতে এসে পড়েছি। কালো কাঠের দেওয়াল, তীক্ষ্ণ ছাদ, আর চারপাশের পানির খাল। নিকিতা বললো, এটা জাপানের সবচেয়ে সুন্দর ব্ল্যাক ক‍্যাসেল। এখানকার মূল টাওয়ারটা ৫০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। সামুরাই যুগের যুদ্ধের জন্যই এটি তৈরি করা হয়েছিলো। যুদ্ধের জন্য তৈরি সিঁড়ি, পর্যবেক্ষণ জানালা-সব এখনো আগের মতো।

কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে যখন আমরা টাওয়ারের ওপর উঠলাম, পুরো শহর আর জাপানি আলপসের সারি একসঙ্গে দেখা দিলো দৃশ্যটা যেন চিত্রকরের আঁকা। নিকিতা পাশে দাঁড়িয়ে বললো, এই দৃশ্যই মাতসুমোতোর আসল সৌন্দর্য। বাইরে এসে নিকিতা ক‍্যাসেলটাকে পেছনে রেখে আমার অনেকগুলো ছবি তুলে দিলো।

এরপর আমরা হাঁটলাম নাকামাচি স্ট্রিটে। সাদা-কালো দেওয়ালের পুরোনো গুদামঘরগুলো এখন ক্যাফে, হস্তশিল্প দোকান আর ছোট আর্ট গ্যালারিতে পরিণত হয়েছে। এক দোকানে ঢুকতেই কাঠের সুঘ্রাণ আর পুরোনো জাপানি খেলনাগুলো নজর কাড়ল। নিকিতা বললো, এগুলো স্থানীয় শিল্পীদের হাতের কাজ। মাতসুমোতো শিল্প-সংস্কৃতির শহর বলেই পরিচিত। আমরা রাস্তার ধারে বসে স্থানীয় সোবা নুডুলস খেলাম। নিকিতা বললো, পরিষ্কার পানির শহর হওয়ায় এখানকার সোবা নুডুলস খুবই সুস্বাদু। বিকালে আমরা একটি ছোট ট্রেনে চেপে গেলাম ডাইয়ো ওয়াসাবি ফার্মে, যা মাতসুমোতো শহরের সবচেয়ে ফটোজেনিক জায়গাগুলোর একটি।

স্বচ্ছ জল, কালো কাঠের মিল, বিশাল সবুজ ক্ষেত আমার নজর কাড়ছিল। নিকিতার কাছে জানতে চাইলাম, এখানকার জলের রঙ এতো পরিষ্কার কেন? সে হেসে উত্তর দিলো, এগুলো আলপসের বরফগলা পানি। আমাকে নিয়ে একটা আইসক্রিমের দোকানে ঢুকলো নিকিতা। তাজা ওয়াসাবি দিয়ে তৈরি আইসক্রিমের অর্ডার দিলো সে। অদ্ভুত চমৎকার জিভে লাগে থাকার মতো স্বাদ। সূর্য যখন পাহাড়ের আড়ালে ঢলে পড়ছিল, আমরা স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। ট্রেনের জানালার বাইরে অন্ধকার নামছিল, আর দূরের পাহাড়গুলো ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছিল কালো ছায়ায়।

ফুজির ছায়ায় গোতোমবা

টোকিওর সকালের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। হাতে কফির কাপ, ব্যাগে ক্যামেরা-পাশে প্রিয় গাইড নিকিতা। আজ আমাদের গন্তব্য গোতোমবা-ফুজি পর্বতের কোলে লুকানো এক ছোট শহর। শিনজুকু স্টেশন থেকে ট্রেনে রওনা হলাম। শহরের কংক্রিটের দেয়ালগুলো দ্রুত হারিয়ে যেতে লাগলে। জায়গা নিচ্ছিল সবুজ পাহাড় আর নরম কুয়াশা। নিকিতা জানালো, গোতোমবা মানে শুধু ফুজির দৃশ্য নয়, এখানে কেনাকাটা আর অনসেন-দুইই একসঙ্গে পাবে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম গোতোমবা স্টেশনে। স্টেশন থেকে নামতেই দূরে দেখা গেল তুষারে মোড়া মাউন্ট ফুজি একেবারে আকাশ ছুঁয়ে থাকা পাহাড়, যেন ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

নিকিতা বললো-চলো, আগে ফুজির সামনে তোমার একটা একটু ছবি তুলে দিই। ফটোসেশনের পর আমরা হাঁটতে লাগলামগোতেমবা পিস পার্কের দিকে। সাদা প্যাগোডার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালাম, গোতোমবা শহর ছড়িয়ে আছে, আর তার ওপরে রাজসিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে ফুজি পাহাড়। বাতাস ঠান্ডা, কিন্তু হালকা ফুলের গন্ধে ভরা। এরপর গেলাম গোতোমবা প্রিমিয়াম আউটলেটে। গোতোমবা ফুজির পাদদেশে বানানো বিশাল শপিং কমপ্লেক্স। আকাশে ঝুলে থাকা ফুজি, আর নিচে সারি সারি দোকান- যেন বিলাসিতা আর প্রকৃতি পাশাপাশি বসে আছে। নিকিতা জানায়, ফুজি পর্বতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল আউটলেটটি জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সুন্দর শপিং স্পটগুলোর একটি। এখান থেকে আকাশ ছুঁয়ে থাকা মাউন্ট ফুজির দৃশ্য দেখা যায় একেবারে সামনাসামনি। এখানে আছে ২০০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দোকান-গুচি, প্রাডা, নাইক, এডিডাস, রাসফ লরেন, মাইকেল কোরস, বারবেরি, কোচ ইত্যাদি। দাম সাধারণ দোকানের তুলনায় ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কম। পুরো আউটলেটটি এমনভাবে সাজানো, যেন পর্যটকরা শপিং করতে করতে আকাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুজি পর্বতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। পরিষ্কার দিনে ফুজি পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি দোকানের কাচে পড়তে দেখা যায়, সে যেন ছবির মতো এক দৃশ্য।

এছাড়াও এখানে আছে অনেকগুলো জাপানি আন্তর্জাতিক রেস্টুরেন্ট। রামেন, সুসি, স্টারবাকস, গোডিবা ক্যাফে ইত্যাদি। যেখানে পর্যটকরা চাইলে ফুজির দৃশ্যের সামনে বসে কফি হাতে বিশ্রাম নিতে পারেন। নিকিতা জানায়, গোতোমবা প্রিমিয়াম আউটলেট শুধু শপিং স্পট নয়, এটি এক রোমান্টিক অভিজ্ঞতা-যেখানে বিলাসিতা আর প্রকৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। ফুজি পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষের সঙ্গে কেনাকাটা-এ যেন জাপানের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর একটি হয়ে থাকে।

ফুজির দৃশ্যের সঙ্গে কেনাকাটার এমন আনন্দ আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিকালের দিকে গেলাম একটা অনসেনে। উষ্ণ পানির ভেতর বসে জানালা দিয়ে দেখা ফুজি পাহাড় দেখা একটা অন‍্যরকম অনুভূতি। ফেরার পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরে মাউন্ট ফুজি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল সন্ধ্যার আলোয়। গোতোমবা টোকিও থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ, কিন্তু সেখানে পৌঁছে মনে হয়েছিলো যেন একেবারে অন্য এক জগত পরিভ্রমণ করে এসেছি।

টোকিওর গেইশা শো 

টোকিওতে আমার ট্যুর গাইড নিকিতার সঙ্গে কথা ছিলো সে আমাকে আজ গেইশা শো দেখাতে নিয়ে যাবে। শো শুরু হবে সন্ধা ৮টায়। ৭টায় তাকে আসতে বলেছি শো দেখার আগে গেইশাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তার কাছ থেকে জানবো বলে। দুজনে কফির কাপ হাতে মুখোমুখি বসেছি। নিকিতা বলছিলো গেইশাদের ইতিহাস। গেইশা শব্দের অর্থ হলো ‘কলা ব্যক্তিত্ব’ বা ‘শিল্পী’। জাপানে তাদের ইতিহাস কয়েকশো বছর আগে শুরু হয়। প্রথম গেইশারা মূলত নারী যিনি বিনোদন প্রদানে পারদর্শী-নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, চা অনুষ্ঠান এবং কথোপকথন।

গেইশা হওয়া সহজ নয়। সাধারণত ছোট বয়সে (১২-১৫ বছর) মেয়েরা ওকেয়া অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে শুরু করেন। এই পর্যায়ে তাদের বলা হয় মায়কো। মায়কোদের জীবন কঠোর শৃঙ্খলায় গঠিত, দিনের একটি বড় অংশ কাটে নৃত্য, গান, সামিশি বাজানো, কিমোনো পড়ার ভঙ্গি, অতিথি সেবা এবং সাংস্কৃতিক শিক্ষায়। প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এগোয়- শুরুতে তারা শুধু পেছনের নৃত্য বা সহায়তা করে, পরে পারফরম্যান্সে নিজে মঞ্চে উঠে। পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক বছর লাগে, এবং শৃঙ্খলা খুব কড়াকড়ি। গেইশারা শোতে কেবল নৃত্য নয়, সংগীত, নাট্যকৌশল, কথোপকথন-সবই উপস্থাপন করেন। তাদের লক্ষ্য থাকে অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ, মার্জিত এবং মনোমুগ্ধকর ব‍্যবহার করা।

নিকিতা জানায়, গেইশাদের জীবন সাধারণ নারীর জীবনের চেয়ে ভিন্ন। তারা হানমাচি এলাকায় থাকে, যেখানে গেইশাদের জন্য আলাদা আবাস ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি গেইশা নিজের নাম, রূপ ও দক্ষতা নিয়ে পরিচিত। শোতে বসা দর্শকরা শুধু বিনোদন নয়, শত বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পের সঙ্গে পরিচিত হয়। আজকের দিনে, গেইশারা নারীদের জন্য একটি গৌরবময় পেশা। শো দেখলে বোঝা যায়, প্রতিটি নাচ, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি সুর-সবই বহু বছরের শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশিক্ষণ ও সংস্কৃতির ফল। নিকিতার কাছে জানতে চাইলাম অনেকে গেইশাদের পতিতার সঙ্গে তুলনা করে এব‍্যাপারে তার মন্তব‍্য কি।

নিকিতা খুব দৃঢ় ভাবে বলে-না, গেইশারা পতিতা নয়। এটি অনেকেই ভুলভাবে ধরে নেন। গেইশা হলো জাপানের ঐতিহ্যবাহী একজন সাংস্কৃতিক পারফর্মার। তারা সাধারণত নারী, যারা নৃত্য, সংগীত (যেমন-শামিসেন বাজানো), গান এবং চমৎকার আলোচনার দক্ষতা অর্জন করে। গেইশারা সামাজিক অনুষ্ঠান, চা আসর বা পার্টিতে অতিথিদের বিনোদন দিয়ে থাকেন। পতিতা বা যৌনকর্মী হলো যে ব্যক্তি যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু গেইশারা এই কাজ করে না। গেইশাদের মূল উদ্দেশ্য হলো শিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বিনোদন দেওয়া। সাধারণত গেইশাদের ছবি বা মিডিয়ায় দেখানো হয় ভিন্নভাবে, তাই মানুষ মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়। গেইশা শো শুরু হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছিল। আমরা একটা ট‍্যাক্সি নিয়ে শো স্থলে পৌঁছলাম।

ঘর অন্ধকার। হঠাৎ নরম আলোর ঝলকানি মঞ্চে ছড়িয়ে পড়ল। নিস্তব্ধতার মাঝে হালকা শামিসেনের সুর বাজতে শুরু করলো। আমি নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে আছি। পর্দার আড়াল থেকে একজন গেইশা এগিয়ে এলেন। পরনে সাদা, লাল ও সোনালি ফুলের নকশা করা কিমোনো। পায়ে ছোট ছোট ধীর পদক্ষেপ। মুখে সাদা মেকআপ, ঠোঁটে লাল রঙের রেখা, আর চোখের কোণে কালো টান। তার হাঁটার ভঙিটাই মনে হচ্ছিল যেন এক ধরনের নৃত্য। শামিসেনের সুর গভীর হলো। গেইশা হাত উঁচু করলেন, ধীরে ধীরে পাখার মতো ফ্যান খুললেন। পাখার প্রতিটি নড়াচড়া যেন একেকটা গল্প বলছে। তার হাতের আঙুল, চোখের দৃষ্টি, শরীরের বাঁক-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল তার নাচ যেন এক শব্দহীন কবিতা। 

একটু পর আরেকজন গেইশা মঞ্চে এসে বসলেন। হাতে শামিসেন। তিন তারের সেই বাদ্যযন্ত্র থেকে যখন সুর বের হলো, পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সেই সুরের সঙ্গে প্রথম গেইশা ধীর কণ্ঠে গান ধরলেন। তার কণ্ঠস্বর পাতলা কিন্তু হৃদয়স্পর্শী। নিকিতা জানালো সে এখন জাপানের পুরনো গ্রামাঞ্চলের গল্প শোনাচ্ছে। শোর মাঝপথে তারা অতিথিদের সঙ্গে হালকা আলাপ শুরু করলেন। ছোট কৌতুক, হালকা গল্প-কক্ষের সবাই হাসলো। সেই হাসি কৃত্রিম নয়, বরং স্নিগ্ধ ও প্রাণবন্ত। শো ধীরে ধীরে শেষ হলো। গেইশারা সবাই একসঙ্গে নাচের ভঙিতে নম্রভাবে মাথা নত করে বিদায় জানালেন। আলো নিভে গেল, কিন্তু আমার চোখের সামনে এখনো তাদের হাতের অঙ্গভঙ্গি, পাখার খোলা-বন্ধ, আর শামিসেনের সুর ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমরা দুজন হল ছেড়ে বাইরে বের হলাম। কিন্তু মনে হলো যেন আমি কয়েক ঘণ্টা নয়, কয়েক শতাব্দীর সাংস্কৃতিক ভ্রমণ শেষ করে ফিরছি। 

টোকিও থেকে তাকায়ামা

ভোরের টোকিও তখনো ঘুমে মগ্ন। আমি আর গাইড নিকিতা শিনজুকু স্টেশন থেকে হিদা এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়লাম। ট্রেনটি ধীরে ধীরে নগর জীবনের কোলাহল ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগল। জানালার বাইরে একের পর এক সবুজ উপত্যকা, নদীর ঝিলিক, আর কাঠের বাড়িঘর যেন সময়কে পিছনে নিয়ে গেল বহু শতাব্দী আগে। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ট্রেন পৌঁছলো তাকায়ামা স্টেশনে-এক নিস্তব্ধ, ছোট্ট কিন্তু জাদুকরী শহরে। নাগোয়া থেকে ট্রেন পরিবর্তন করে যখন হিদা এক্সপ্রেস ধরে তাকায়ামার পথে পা বাড়ালাম। চোখে পড়েছিল পাহাড়ের বুক চিরে চলা রেললাইন আর নদীর পাশে গাঢ় সবুজ বনানী।

বিকালের আলো ফুরোতে না ফুরোতেই পৌঁছলাম তাকায়ামায়। ছোট্ট স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতেই গায়ে লাগলো ঠান্ডা পাহাড়ি বাতাস। চারপাশে কাঠের পুরনো বাড়িগুলো, জানালায় কাগজের পর্দা, আর লণ্ঠনের মৃদু আলো-যেন এডো যুগের জাপান এখনো বেঁচে আছে এখানে। সাঁমাচি সুজির সরু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো আমি ইতিহাসের ভিতর দিয়ে হাঁটছি; কোথাও পুরোনো সাকে দোকানের গন্ধ, কোথাও কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে আসা নরম আলোর রেখা।

গাইড নিকিতা জানায়, জাপানের গিফু প্রি-ফ্যাকচারের মাঝখানে, হিদা পর্বতমালা ঘেরা উপত্যকার কোলে বসে আছে এই ছোট্ট শহর তাকায়ামা। শহরটির নামের মানে-‘উঁচু পাহাড়’। আর সত্যিই সতি‍্যই শহরটিকে ঘিরে চারদিকে শুধু পাহাড়, বন আর নীল আকাশের খোলা বিস্তার। এখানকার বাতাস ঠান্ডা, নির্মল। তাকায়ামা একসময় ছিল জাপানের কাঠশিল্প ও স্থাপত্যের কেন্দ্র। এডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) এখানকার কারিগরদের দক্ষতা ছিল অদ্বিতীয়-তারা কিয়োটো ও টোকিওর রাজপ্রাসাদ নির্মাণেও কাজ করেছিল। সেই সময়ের ঐতিহ্য আজও টিকে আছে শহরের পুরনো শহরাঞ্চল সাঁমাচি সুজিতে। এই এলাকায় এখনো আছে ২০০ বছরের পুরোনো কাঠের ঘর, সাকে রাইস ওয়াইন ব্রিউয়ারি, ও হস্তশিল্পের দোকান। সরু গলিতে হাঁটলে শোনা যায় কাঠের দরজার কিচ কিচ শব্দ, আর দেখা যায় ঘরের বারান্দায় ঝোলানো কাঠের নামফলক।

তাকায়ামা বিখ্যাত তার দুটি বৃহৎ উৎসবের জন্য।এর অতটি হচ্ছে বসন্ত উৎসব যা এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। আর অন্যটি হচ্ছে শরৎ উৎসব যা অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এ উৎসবগুলোতে বিশাল ইয়াতাই নামে কারুকাজ করা রথ রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। সোনালি কাঠের কাজ, সিল্কের পর্দা, আর অসংখ্য লণ্ঠনে সজ্জিত সেই রথগুলো রাতে আলোয় ঝলমল করে ওঠে—যেন শহরটা রূপ নেয় এক জীবন্ত লোকচিত্রে।

আমরা গেলাম হিদা ফক ভিলেজে। চোখে পড়ছিল পাহাড়ের কোলে ঘাসের ছাদওয়ালা পুরোনো ঘর, ছোট্ট পুকুরের পাশে কাঠের সেতু, ইত‍্যাদি। দুপুরে স্থানীয় বাজারে খেলাম বিখ্যাত হিদা বিফ, মুখে গলে যাওয়া সেই মাংসের স্বাদ আজও মনে গেথে আছে। নিকিতা জানায়, শীতে যখন এই গ্রামের ছাদে বরফ জমে, তখন দৃশ্যটা এতই মোহনীয় যে অনেক পর্যটক কেবল এই দৃশ্য দেখার জন্যই শীতকালে তাকায়ামায় আসেন। তাছাড়া তাকায়ামা বিখ্যাত তার হিদা বিফের জন্য-এটি ওয়াগিউ গরুর মাংসের একটি প্রিমিয়াম প্রজাতি। মুখে গলে যাওয়া সেই নরম মাংস স্থানীয়দের গর্ব।

এছাড়া এখানকার বিশেষত্ব হালকা সয়াসসের ঝোলের নুডল, গ্রিল করা সবজির সঙ্গে মিসো পেস্ট। এছাড়া এখানকার ঠান্ডা আবহাওয়ায় তৈরি সাকে খুব বিখ্যাত, যেগুলো স্থানীদোকানগুলোতে স্বাদ নেওয়া যায়। নিকিতা জানায়, তাকায়ামার সৌন্দর্য চার ঋতুতেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে ফুটে ওঠে। বসন্তে চেরি ফুলে পাহাড় ঢেকে যায়। গ্রীষ্মে সবুজ বন আর নদীর টলমলে জল। শরতে পাতার লাল-হলুদ রঙে শহর রূপ নেয় চিত্রকর্মে। আর শীতে তুষারে ঢাকা শহর হয়ে ওঠে এক নিস্তব্ধ স্বপ্নরাজ্য।

সকালে তাকায়ামা থেকে রওয়ানা দিলাম শিরাকাওয়া-গোর পথে। ভোরের তাকায়ামা শহর তখন কুয়াশার আবরণে ঘুমিয়ে। আমি আর নিকিতা উঠলাম বাসে। রাস্তা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক বেয়ে। জানালার বাইরে সাদা মেঘে ঢাকা উপত্যকা, গাছের মাথায় বরফের আস্তরণ, আর নদীর ধারে ছোট ছোট কাঠের ঘর যেন এক জীবন্ত জাপানি চিত্রপট। প্রায় এক ঘণ্টা পর বাস থামল একটি ছোট্ট গ্রামীণ জনপদ শিরাকাওয়া চত্বরে। নিকিতা জানায়, শিরাকাওয়া-গো- এক নিস্তব্ধ, তুষারে ঢাকা গ্রাম, যেটি ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি ঘরই একেকটি ইতিহাসের দলিল। খড়ের ছাদওয়ালা কাঠের ঘরগুলোকে বলে গেশো জুকুরি, যার মানে ‘প্রার্থনায় যুক্ত হাত’। খাড়া ছাদগুলো তৈরি করা হয়েছে ভারী তুষার টিকিয়ে রাখার জন্য।

এরপর আমরা গেলাম গিমাচি ভিউ পয়েন্টে। পাহাড়ের ঢালে উঠে দাঁড়াতেই নিচে দেখা গেল পুরো গ্রামটি তুষারে মোড়া সাদা ঘর, ধোঁয়া ওঠা চিমনি, আর তার মাঝে ছোট নদীর ফিসফাস। দূরে শিশুরা তুষারে খেলছে, আর পর্যটকেরা ধীরে ধীরে হাঁটছে কাঠের সেতুর ওপর দিয়ে। তীব্র ঠান্ডায় জমে আসা শরীরে একটু উষ্ণতা নিতে আমি আর নিকিতা ঢুকলাম এক ছোট্ট কাঠের ক‍্যাফেতে। জানালার পাশে বসে খেলাম গই মোচি-মিষ্টি চালের কেক আর সঙ্গে এক কাপ গরম স্যাক।

শিরাকাওয়া-গো শুধু প্রকৃতির নয়, সংস্কৃতিরও ভান্ডার। পুরোনো ঘরগুলো এখন মিউজিয়ামে রূপ নিয়েছে, ভেতরে দেখা যায় কাঠের চুলা, কৃষিজ সামগ্রী, পুরোনো কাপড়, আর প্রজন্মের পর প্রজন্মের জীবনচিহ্ন। স্থানীয়রা এখনো কাঠের হস্তশিল্প তৈরি করেন, কেউ কেউ ছোট দোকানে হাতে বোনা স্কার্ফ বিক্রি করেন।

শিরাকাওয়া-গো ছেড়ে যখন ফেরার বাসে উঠলাম, মনটা তখনো থেকে গেল সেই গ্রামে, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষ একসঙ্গে লিখেছে নিঃশব্দ সৌন্দর্যের ইতিহাস। সন্ধ্যায় শহরের লণ্ঠন জ্বলে উঠলে রাস্তায় ভেসে আসে উৎসবের ঢোলের শব্দ। তাকায়ামা তখন রঙ, আলো আর ঐতিহ্যের এক মায়াময় শহর হিসাবে ধরা দেয় পর্যটকদের কাছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে হলো, তাকায়ামা শুধু একটি শহর নয়- এ যেন জাপানের অন্তরাত্মা, যেখানে প্রতিটি কাঠের দরজা আর প্রতিটি লণ্ঠনের আলো একেকটি ইতিহাসের গল্প বলে।

শেয়ার করুন