১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, বুধবার, ১১:৩১:০৪ অপরাহ্ন


দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
টোকিওর ইমপেরিয়াল প্যালেস
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-১২-২০২৫
টোকিওর ইমপেরিয়াল প্যালেস ইমপেরিয়াল প্যালেসের বাগানে কুসুনোকি মানাসিগের মূর্তি এবং সাগানা ব্যাম্বো ফরেস্টে লেখক


আমি হাঁটছি টোকিওর ইমপেরিয়াল প্যালেসের বিস্তৃত বাগানের ভেতর। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরই যেন লুকিয়ে আছে শতাব্দীর ইতিহাস। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো এক বিশাল অশ্বারোহী মূর্তি। সবুজ তামার রঙে ভাস্কর্যটি সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। তলোয়ার হাতে, বর্ম পরিহিত, ঘোড়ার পিঠে বীরোচিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে মূর্তিটি।

গাইড নিকিতা পরিচয় করিয়ে দিলো মূর্তিটির সঙ্গে। নাম-কুসুনোকি মাসাশিগে। ইমপেরিয়াল প্যালেসের সবুজ বাগান, পাথরের দেওয়াল আর ঝলমলে খালের ভেতরে লুকিয়ে আছে জাপানের ইতিহাসের এক অবিনশ্বর কাহিনি। আর সেই কাহিনির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই সামুরাই যোদ্ধা-কুসুনোকি মাসাশিগে। নিকিতার কাছে শুনছিলাম কুসুনোকি মাসাসিগের বীরত্বের কাহিনি। জাপানের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য সামুরাই যোদ্ধা, যিনি বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ ও সম্রাটপ্রেমের প্রতীকখ্যাত। তাকে জাপানি সংস্কৃতিতে আজও এক মহৎ নায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়।

চিহায়া দুর্গের যুদ্ধের কথা। সনটা ছিল ১৩৩৩। কাওয়াচি প্রদেশের উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল চিহায়া দুর্গ। বাইরে থেকে সাধারণ কাঠের কেল্লা মনে হলেও ভেতরে লুকিয়ে ছিল কুসুনোকি মাসাশিগের অসাধারণ বুদ্ধি। শোগুনেটের বিশাল বাহিনী তার দুর্গ ঘিরে ফেলে-সংখ্যায় প্রায় ১ লাখ সেনা আর মাসাশিগের হাতে ছিল মাত্র কয়েক হাজার! কিন্তু তিনি ভয় পাননি। তিনি দুর্গের বাইরে কাঠের পুতুল সাজিয়ে রাখেন, যাতে শত্রুরা ভেবে বসে দুর্গ সৈন্যে ভরা। পাহাড়ি পথগুলোতে লুকিয়ে রাখা হয় পাথর আর গরম তেলের ফাঁদ। শত্রুরা আক্রমণ করলেই ঝরে পড়ে বজ্রের মতো। মাসাশিগে তার যোদ্ধাদের দিয়ে আকস্মিক রাতের হামলা চালাতে থাকেন, যেন শত্রুরা দিনরাত অস্থির থাকে। এভাবে কয়েক মাস টানা প্রতিরোধ চলে। অবশেষে শোগুনেট বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পিছিয়ে যায়। এ যুদ্ধ মাসাশিগেকে ‘কৌশলের জাদুকর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

তারপর শুরু হলো মিনাতোগাওয়া যুদ্ধ (১৩৩৬)

সম্রাট গো-দাইগো তখন আবারও বিপদে। আশিকাগা তাকাউজি বিশাল সেনা নিয়ে রাজধানীর দিকে ধেয়ে আসছেন। সম্রাট তাকে থামানোর আদেশ দেন মাসাশিগেকে। মাসাশিগে তখনই বুঝেছিলেন এ যুদ্ধ হবে আত্মঘাতী। বিজয়ের আশা নেই। তবুও তিনি সম্রাটের নির্দেশ পালন করাকে নিজের শেষ কর্তব্য মনে করেন। কোবে বন্দরের কাছে মিনাতোগাওয়া নদীর তীরে, তার কয়েক হাজার সেনা দাঁড়িয়ে যায় তাকাউজির কয়েকগুণ শক্তিশালী বাহিনীর সামনে। যুদ্ধ শুরু হয়, মাসাশিগের ঘোড় সওয়াররা বজ্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। নদীর তীরে তলোয়ারের ঝলক, বর্শার সংঘর্ষ, ঢাল ভাঙার শব্দে আকাশ কেঁপে ওঠে। কিন্তু সংখ্যার বিশাল ফারাক ধীরে ধীরে তাদের গ্রাস করে। শেষ মুহূর্তে মাসাশিগে তার ভাই ও বিশ্বস্ত সৈন্যদের নিয়ে আত্মোৎসর্গ করেন। সম্রাটের পতাকা যেন না ম্লান হয়-এ বিশ্বাস নিয়েই তিনি প্রাণ দেন। তার মৃত্যুর পর জাপানিরা তাকে ডাকতে শুরু করে-‘চূড়ান্ত বিশ্বস্ততার প্রতীক’-(চুগি নো শি)।

পিনপতন নীরবতায় গল্প শেষ করে নিকিতা

মূর্তির দিকে তাকালে মনে হয়-তিনি এখনও ঘোড়ার পিঠে চেপে সম্রাটের সুরক্ষায় পাহারা দিচ্ছেন। তলোয়ারের ঝলক, যুদ্ধে বাজানো ঢোল আর বিশ্বস্ততার শপথ যেন এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মনে হয় এ শুধু কোনো ভাস্কর্য নয়। এ যেন ১৩৩৬ সালের মিনাতোগাওয়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উঠে আসা এক আত্মত্যাগী সামুরাই, যিনি এখনো সম্রাটের জন্য পাহারায় আছেন। মূর্তির দিকে তাকিয়ে আমি যেন শুনতে পাচ্ছি তার কণ্ঠস্বর-‘জীবন হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু কর্তব্য ও বিশ্বস্ততা চিরন্তন।’ মূর্তিটির চারপাশে সারা বিশ্বের পর্যটকরা ছবি তুলছে। অনেকেই নীরবে মাথানত করছে। তাদের চোখে মাসাশিগে শুধু ইতিহাসের এক চরিত্র নন, বরং সম্রাটের প্রতি অটল আনুগত্যের প্রতীক।

আমি ইমপেরিয়াল প্যালেসের দেওয়ালের দিকে তাকালাম। ভাবলাম-এ শহরের কোলাহলের মাঝে, আধুনিক টোকিওর অট্টালিকার পাশে, একজন সামুরাইয়ের স্মৃতি আজও অটুট থেকে গেছে। তার এ আত্মত্যাগ যেন প্রতিটি জাপানির মনে বলে দেয় সত্যিকার বীরত্ব হলো কর্তব্যকে জীবনের চেয়েও বড় করে দেখা। সুনোকি মাসাশিগে শুধু একজন সামুরাই নন, বরং বিশ্বস্ততার এমন প্রতীক যিনি নিজের জীবন দিয়েও কর্তব্যকে বড় করে দেখেছিলেন। জাপানি স্কুলে তার কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শেখানো হয়, যেন তারা কর্তব্য ও বিশ্বস্ততার মূল্য বুঝতে পারে। আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছি ইমপেরিয়াল গার্ডেনের সরু পথ ধরে, পেছনে শহরের গর্জন ফেলে আসা এক অদ্ভুত নীরবতার দিকে।

গার্ডেনের ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো-আধুনিক টোকিও যেন হঠাৎ ইতিহাসের সামনে নত হয়ে গেছে। পথের দুপাশে পুরোনো গাছের সারি। পাখিদের কূজন, হালকা বাতাস আর গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা দূরের প্রাসাদের ছাদ-একেবারে যেন কোনো প্রাচীন কাব্যের দৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবছিলাম এ জায়গার ইতিহাস। আজ যেখানে আমি দাঁড়িয়ে, একসময় এখানে দাঁড়িয়ে ছিল এদো কাসল, তোকুগাওয়া শোগুনদের আসন। ১৮৬৮ সালে মেইজি পুনঃস্থাপনের পর যখন জাপান নতুন যুগে পা রাখে, তখনই এই দুর্গ রূপ নেয় ইমপেরিয়াল প্যালেসে-সম্রাটের রাজকীয় নিবাসে। সে রূপান্তর যেন জাপানের আত্মার পুনর্জন্মের মতোই এক মুহূর্ত, যেখানে অতীত ও বর্তমান হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

গার্ডেনের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে সামনে পড়লো সেই বিখ্যাত নিজুবাশি ব্রিজ। খালের জলে তার প্রতিফলন যেন কোনো পুরোনো গল্পের দরজা। আমি থেমে গেলাম, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, ইতিহাস যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মনে হলো, এ পথ দিয়েই হয়তো কোনো এক সময়ে সম্রাট হিরোহিতো রাজকীয় গাড়িতে প্রাসাদে ফিরেছেন, বা কোনো রাজপরিবারের সদস্য হাত নাড়িয়ে অভিবাদন দিয়েছেন জনতাকে। দূরে প্রাসাদের ছাদ সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে-যেন সোনার প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা এক ফিনিক্স ডানামেলা দিচ্ছে আকাশের দিকে। সেই দৃশ্যের মধ্যে এক অদ্ভুত রোমান্স আছে, রাজকীয় অথচ শান্ত, গর্বিত অথচ নম্র। আমি প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাতাস হালকা ঠান্ডা, কিন্তু মন উষ্ণ হয়ে আছে ইতিহাসের আবেগে। চারপাশে সবুজ গাছপালা, নিস্তব্ধতা, আর দূরে প্যালেসের দেওয়াল-সব মিলিয়ে এক গভীর শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার অনুভূতি ছড়িয়ে দিল চারপাশে।

ভ্রমণ শেষে যখন গার্ডেনের ফটকের কাছে এসে দাঁড়ালাম, তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। আকাশের রঙে মিশে আছে সোনালি আলো আর হালকা বিষণ্ণতা। মনে হলো, আমি যেন শুধু একটি স্থান ঘুরে দেখিনি, বরং ইতিহাসের বুকের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছি-যেখানে সময়, সাহস আর ভালোবাসা একসঙ্গে নিঃশব্দে বেঁচে আছে ।

সামুরাইদের হারানো উপত্যকা

জাপানের কিউশু দ্বীপের দক্ষিণে শান্ত আর নরম আলোয় ভেজা একটি উপত্যকা-কুমা ভ্যালি। জাপানের সামুরাই ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বিশেষ করে হিতোয়োশি (Hitoyoshi) অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এখানকার সামুরাই সংস্কৃতি শত শত বছর ধরে টিকে আছে। অতীতের সামুরাই সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি সংরক্ষণ করে রাখা অঞ্চলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। সামুরাই ঐতিহ্যের সেসব চিহ্ন, স্থাপনা ও জীবনযাত্রার নিদর্শন দেখতে গাইড নিকিতাসহ টোকিও থেকে রওয়ানা দিই সেই উপত‍্যকার পথে।

নিকিতা জানায়, কুমা ভ্যালি শুধু একটি উপত্যকা নয়, এটি সাগারা সামুরাই বংশের সাতশ বছরের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ অধ্যায়। এ উপত‍্যকাটি মূলত সোগো (Sagara) সামুরাই বংশের শক্ত ঘাঁটি ছিল। তারা প্রায় ৭০০ বছরেরও বেশি সময় এ অঞ্চলে শাসন করেছে, যা জাপানের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। সাগারা সামুরাই বংশকে দক্ষিণ কিউশুর অভিভাবক বলা হতো। সাগারা বংশ ১২০০ শতকে ক্ষমতায় আসে। তারা কুমা উপত‍্যকাকে দুর্গ, সামুরাই প্রশাসন ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে। আশপাশের এলাকা যখন যুদ্ধে বিধ্বস্ত হচ্ছিল, এ উপত‍্যকা ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল। সামুরাই বংশের দীর্ঘ শাসনের কারণে কুমা উপত‍্যকায় বহু পুরোনো ঐতিহ্য, সামুরাই বাড়ি ও দুর্গ এখনো চোখে পড়ে।

আমরা উঠে বসলাম শিনকানসেন সাকুরা ট্রেনে।

ট্রেন ধীরে ধীরে টোকিও ছাড়তেই জানালার বাইরে বদলে গেল দৃশ্য-উঁচু বিল্ডিং হারিয়ে গিয়ে এল ধানক্ষেত, নদী আর দূরের পর্বত। কুমামতো স্টেশনে নেমে আমরা ধরলাম হিসাতো লাইন। এ রেললাইনকে বলা হয়, জাপানের সবচেয়ে সুন্দর পাহাড়ি ট্রেন রুট। ট্রেন কখনো পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলে, কখনো নিচে গর্জমান কুমা নদী দেখা যায়। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য যাত্রা পথকে আকর্ষণীয় করে তুলে।

হিতোয়োশিতে পৌঁছে সাগারা বংশের দুর্গ

হিতোয়োশি ক্যাসল দেখতে গেলাম। আমরা হাঁটছিলাম দুর্গের পাথরঘেরা প্রাঙ্গণে। নিকিতা বললো, এ দেওয়ালগুলো হাজারো সামুরাইয়ের পদচারণা দেখেছে। যদিও মূল কাঠের দুর্গটি আজ নেই, তবু পাথরের দেওয়াল, প্রশান্ত সিঁড়ি আর নদীমাতৃক পরিবেশ যেন সামুরাই শাসনের সেই কঠোর ও মর্যাদাপূর্ণ সময়কে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। সে জানায়, এই দুর্গটি সাগারা বংশের প্রধান এবং শক্ত ঘাঁটি ছিল। দুর্গের চারপাশে ছিল সামুরাইদের আবাস, প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র এবং প্রশাসনিক ভবন। ১৬০০-১৭০০ শতকের সামুরাই স্থাপত্য এখানকার পাথরের প্রাচীরে এখনো দেখা যায়। দুর্গের স্থানটি এখন হিতোয়োশি ক্যাসল রুইন্স নামে সংরক্ষিত।

হিতোয়োশি শহরে এখনো সংরক্ষিত আছে কিছু সামুরাই আবাস। কাঠের ঘর, টাটামি মাদুর, সামনের ছোট বাগান, পাথরের প্রাচীর, ঐতিহ‍্যবাহী জাপানি স্থাপত‍্য সব মিলিয়ে পরিবেশটা শান্ত, পরিপাটি। এগুলো পরিদর্শনে একটা সামুরাই জীবনের ছবি পাওয়া যায়।

নিকিতা বললো, সামুরাইরা শুধু যোদ্ধা ছিল না। তারা শৃঙ্খলা, পরিবার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আর ধ্যানের মধ্য দিয়েও জীবন কাটাতো। কুমা উপত‍্যকা ছিল পাহাড়, নদী, বন ও গিরিখাত দিয়ে ঘেরা, যা সামুরাইদের প্রশিক্ষণের জন্য আদর্শ। এখানে সামুরাইরা কেনজুতসু (তলোয়ার), কিউদো (ধনুক), সো-জুতসু (বর্শা) ঘোড়সওয়ারি প্রশিক্ষণ নিতেন। বিকালে আমরা হাঁটলাম নদীর ধারে। দ্রুত বয়ে চলা নদী আর পাহাড়ের নীল ছায়া-অসাধারণ শান্ত একটা অনুভূতি তৈরি করছিল মনে। নিকিতা বললো, যুদ্ধ শেষে সামুরাইরা এখানে ধ্যান করতো। নদীর শব্দেই তারা ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতো।

জলের গর্জন শুনতে শুনতে মনে হলো

এই নদীও হয়তো শত শত সামুরাইয়ের গল্প শুনেছে। এই কুমা নদী অনেক সামুরাই ইতিহাসের সাক্ষী। প্রবাহমান, শক্তিশালী কুমা নদী একসময় সামুরাইদের যোগাযোগ পথ ছিল। নদীর তীরে বহু যুদ্ধ, সামরিক পদযাত্রা ও কৌশলগত পরিকল্পনার ইতিহাস রয়েছে।

একটি ছোট রেস্তোরাঁয় স্থানীয় খাবার খেলাম: কুমা নদীর গ্রিল করা আয়ু মাছ, ঘন মিসো স্যুপ স্থানীয় সবজি আর চালের পিঠা। দারুণ টেস্টি ছিল সে খাবার। কুমা ভ্যালির সেই সবুজে মোড়া দিনটা যেন দ্রুত শেষ হয়ে গেল। বিকালের মৃদু আলো তখনো পুরোপুরি পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে নিচে নামেনি। উপত্যকার বাতাসে ছিল ভেজা কাঠের গন্ধ, নদীর ওপর ভেসে যাওয়া হালকা কুয়াশা, আর নিস্তব্ধতার মাঝে দূরের একটা পাখির ডাক। ঠিক সেই সময়ই আমি আর নিকিতা টোকিও ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। আজ কুমা ভ্যালির বিকালের আকাশ যেন একটু ধূসর, একটু সোনালি-দুই রঙের মিলেমিশে তৈরি শান্ত এক আবহ। ছোট্ট স্টেশনটির দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর নিকিতা দুজনই থেমে থেমে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম, পাহাড়ের ঢালে জেগে ওঠা কুয়াশা, নদীর ওপর ভেসে থাকা শীতল বাতাস, আর বনভূমির নীরবতা যেন আমাদের থামতে বলছিল।

স্টেশনে পৌঁছানোর একটু পরই কুমা ভ্যালির লোকাল ট্রেনটা দূর থেকে ভাঁজখোলা নীল রেখার মতো এগিয়ে এলো। ছোট্ট ট্রেন, জানালাগুলো বড়-প্রকৃতির ছবি তুলে নেওয়ার জন্য যেনই তৈরি। আমি জানালা খুলে দিলাম, শেষবারের মতো পাহাড়ের গন্ধটা বুকভরে নিতে। গাড়ি যখন ধীরে ধীরে উপত্যকার সরুপথ ধরে ওপরে উঠতে লাগলো, কুমা নদীটা পাশে পাশে কিছুদূর পর্যন্ত আমাদের অনুসরণ করলো। তার স্বচ্ছ জল, পাথরে আছড়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউ-সবকিছু যেন বিদায়ের শেষ হাত নাড়ছিল।

ট্রেন ছেড়ে দিতেই শব্দ হলো-‘চিক চ্যাক.. চিক.. চ্যাক।’ শব্দটা যেমন পুরোনো, তেমনি মায়াবী। জানালার পাশে বসা নিকিতা বললো, এই পথটা জাপানের সবচেয়ে শান্ত ট্র্যাকগুলোর একটি। আমরা ধীরে ধীরে উপত্যকা ছেড়ে উপরে উঠতে লাগলাম। জানালা দিয়ে পাহাড়, সবুজ ধানক্ষেত, ঝরনার সাদা রেখা আর কাঠের পুরোনো ঘরগুলো পেছনে সরে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে টানেল, আবার হঠাৎ আলো-একটা নরম দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছিল অনবরত। লোকাল ট্রেন থেকে নেমে বড় রেলস্টেশনে পৌঁছলাম। একটু পরই এলো সাদা-রুপালি বুলেট ট্রেনটা। শিনকানসেন ছুটে চললো, পাহাড়ের গা-ঘেঁষে, নদী পেরিয়ে, গ্রাম থেকে শহরে। জানালার বাইরের দৃশ্যগুলো যেন সিনেমার ফ্রেমের মতো বদলাতে লাগলো। দূরের ছোট ছোট গ্রামগুলো পেছনে সরে যেতে লাগলো। চারপাশের ধানক্ষেতগুলো যেন সোনালি আলোয় ভেসে উঠেছিল। মাঝে মাঝে ছোট স্টেশন, কাঠের ছাউনি দেওয়া বাড়ি আর রাস্তার ধারে নাকি-ই কুচো দোকান-সব মিলিয়ে এক মনোরম গ্রামীণ জাপানের ছবি। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে বুঝলাম অচেনা পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে, সামনে শহরের অনুভূতি ঘন হচ্ছে। নিকিতা মাঝে মাঝে স্থানীয় ইতিহাস বা শহরের গল্প বলছিল, আর আমি প্রতিটি শব্দের সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম-জাপানের গ্রাম আর শহরের মাঝে কী সূক্ষ¥ অথচ বিস্ময়কর ব্যবধান।

যখন আমরা টোকিওর দিকে ঢুকলাম তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লাল হয়ে যাচ্ছে পশ্চিমাকাশ। ব্যস্ত রাস্তাগুলো, দ্রুত চলমান ট্রেন, অগডুত মানুষের ছুটে চলা-এসব কিছু কুমা ভ্যালির শান্ত নির্জনতার সঙ্গে এক জাদুকরি বৈপরীত্য তৈরি করল। যেন দুই আলাদা জগত। ট্রেন যখন টোকিও স্টেশনে এসে ঢুকলো। আমি ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলাম। কুমা ভ‍্যালির শান্ত নীল সকাল আর টোকিওর উজ্জ্বল সন্ধ্যা মিলে আজকের দিনটা অমলিন স্মৃতি হিসাবে বেঁচে থাকবে আমার জীবনে।

টোকিওর এক রোমান্টিক রাত

টোকিওতে আজকের এই রাতটা যেন অন্য সব দিনের থেকে আলাদা-অদ্ভুত মায়াময়, অদ্ভুত উষ্ণ। নিকিতা আমাকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানালো। গিয়ে বুঝলাম, জাপান ভ্রমণের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া অধ্যায়টা তখনো বাকি ছিল। সেখানে না গেলে আমার জাপান ভ্রমণটা অপূর্ণ থেকে যেতো। গাড়ি থামতেই দেখি বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে নিকিতার পুরো পরিবার-বাবা, মা, ছোট ভাইবোনেরা। অবাক হলাম।স্বল্প সময়ের পরিচয়, কিন্তু তারা যে আমাকে এতো উষ্ণভাবে গ্রহণ করবে তা ভাবিনি। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই উষ্ণ আলো আর ছোট্ট জাপানি ঘরের নিস্তব্ধতা আমাকে ঘিরে ধরলো। 

নিকিতা গলা উঁচু করে বললো, Welcome to my home… tonight, you are my family. আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। টাটামির নরম ঘ্রাণ, কাঠের দেওয়ালে ঝুলে থাকা পরিবারের পুরোনো ছবি আর রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা সুস্বাদু গন্ধ-সব মিলিয়ে পরিবেশটা ছিল এক কথায় অপূর্ব। নিকিতা অ্যাপ্রোন বাঁধা অবস্থায় হেসে বললো, Tonight I cook for you. ট্রেডিশনাল ইমাবাড়ি স্টাইলের খাবার আমি তোমার জন‍্য রান্না করবো। রান্নাঘরে নিকিতা যখন ব্যস্ত, আমি তাকে তাকিয়ে দেখছিলাম। রান্না করতে করতে মাঝে মাঝে চুল ঠিক করা, গাল লাল হয়ে যাওয়া, হঠাৎ আমাকে তাকিয়ে দেখা-সব মিলিয়ে সে যেন অন্য এক রূপে ফুটে উঠছিল।

খাবার সাজানো হলো নিচু কাঠের টেবিলে

শোয়ু রামেন, তেরিয়াকি চিকেন, ঘরে তৈরি গিয়োজা, আর তার হাতে বানানো ম্যাচা ডেজার্ট। নিকিতার বাবা মা ভাইবোন সবাই এসে টেবিলে বসলেন। খাবারের স্বাদের চেয়েও বেশি আমাকে ছুঁয়ে গেল নিকিতা ও তার পরিবারের যত্ন, তাদের মমতা আর তাদের নিখাদ ভালোবাসা। খেতে খেতে নিকিতা তার পরিবারের দিকে তাকিয়ে বললো, You travelled almost whole Japan… But tonight, you see my Japan… my small world. আমি হাসলাম। নিকিতার পরিবার আমাকে যে উষ্ণতায় গ্রহণ করলো, তা এতোটাই নিখাঁদ, এতোটাই আন্তরিক, যেন আমি তাদের পরিবারের পুরোনো কোনো আত্মীয়। তার মা চা বানিয়ে আনলেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, জাপানের কোন অংশ আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। ছোট ভাইবোনেরা আমার কাছে নিউইয়র্কের গল্প শুনতে চাইলো। এই ছোট্ট মুহূর্তগুলোতেই বুঝলাম, ভালোবাসা সব সময় রোমান্টিক হতে হয় না। নিকিতার বাবা-মা ছোট ভাইবোনেরা এসে আমাদের সঙ্গে বসলো। তাদের চোখে, হাসিতে, ছোট ছোট আচরণে যে উষ্ণতা-তা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মন ছুঁয়ে গেল। বাবা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, তুমি আজ আমাদের অতিথি, কিন্তু মনে রাখবে-তুমি আমাদের পরিবারেরই অংশ।

নিকিতার মা চায়ের কাপ হাতে দিয়ে বললেন, জাপান এমন জায়গা, যেখানে মানুষ অল্পদিনের পরিচয়েও হৃদয়ের দরজা খুলতে জানে। আমি অভিভূত হলাম। বুঝলাম, এ ছোট্ট মুহূর্তেই আমি পেয়েছি অপরিচিত মানুষের নিখাঁদ ভালোবাসা, যা সময় বা দূরত্বের বাঁধা মানে না। খাবার টেবিলে বসে নিকিতার বাবা মার সঙ্গে অনেক গল্প গুজব করছিলাম। হঠাৎ করেই নিকিতার বাবা টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটি ছোট কাঠের বাক্স বের করে আনলেন। বাক্সটা আমার হাতে তুলে দিয়ে তিনি মৃদু হাসলেন, সেই হাসিতে ছিল জাপানের পুরোনো প্রথা, পরিবারের সৌজন্য আর অচেনা একজন ভ্রমণকারীর প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা।

আমি বাক্সটা খুলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অভ্যন্তরে ছিল এক সূক্ষ্ম জাপানি শিল্পকর্ম, হাতে তৈরি এক ক্ষুদ্র কোকেশি পুতুল, পাশে লেখা ছোট্ট বার্তা-For the traveler who became family. আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম। এই মানুষগুলো, যাদের আমি চিনি মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারা এমন এক আন্তরিকতা দিয়ে আমাকে ঘিরে রাখলো, যা পৃথিবীর কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অচেনা শহর, অচেনা পরিবার, তাদের ঘরের উষ্ণ আলোতে আমি যেন এক আশ্চর্য সত্য অনুভব করলাম আর তাহলো ভালোবাসা সময় চায় না, সম্পর্ক দীর্ঘ পরিচয় চায় না। কখনো কখনো অপরিচিত মানুষই হয়ে ওঠে সবচেয়ে আপন, জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়।

নিকিতার বাবা-মায়ের চোখে আমি দেখেছিলাম অশেষ শুভ কামনা, তার ভাইবোনদের হাসিতে ছিল নির্ভেজাল আনন্দ। আর সেই উপহারের ভেতর লুকিয়ে ছিল, তাদের পরিবারের অমূল্য স্নেহ আর একধরনের নিঃশব্দ আশীর্বাদ। আমি বাক্সটা বুকে চেপে ধরলাম। মনে হচ্ছিল এ উপহার শুধু কাঠের পুতুল নয়, এ যেন জাপানের মাটির উপহার, নিকিতার পরিবারের হৃদয়ের অংশ, যা কোনোদিন ভুলে থাকার নয়। স্বল্প সময়ের পরিচয়ে এতোটা ভালোবাসা-এটা শুধু মহানুভবতা নয়, বরং সেই অদৃশ্য মানবিক বন্ধন, যা পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমার বিদায়ের সময় হলো। বাইরে নীরব টোকিও, জানালায় ঝুলে থাকা শহরের আলো। আমি নিকিতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, গত তিনটি সপ্তাহ তোমার সঙ্গে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কাটালাম। আমি নরম স্বরে উত্তর দিলাম, তোমার পরিবার, তোমার ঘর.. আর তুমি-সবই আমাকে এমন এক অনুভূতি দিল, যা আমি কোনোদিন ভুলবো না। সেদিন রাতের সেই উষ্ম ভালোবাসার নিমন্ত্রণ, খাবারের গন্ধ, নিকিতার লাজুক হাসি, জানালার আলো-সব মিলিয়ে যে ভালোবাসা আমাকে ঘিরে ধরেছিল, তা ছিল নিখাঁদ, গভীর আর অবিস্মরণীয়। জাপান আমাকে ইতিহাস দেখিয়েছে, প্রকৃতি দেখিয়েছে, শহর দেখিয়েছে, কিন্তু নিকিতা আমাকে দেখিয়েছে মানুষের হৃদয়। তার পরিবার আমাকে দেখিয়েছে ভালোবাসার উষ্ণতা, যা কোনোদিন ভোলার নয়।

সাগানো ব্যাম্বো ফরেস্ট

পৃথিবীতে এমন কিছু রাস্তা রয়েছে, যা কল্পনার জগতকেও হার মানায়। প্রকৃতির তৈরি সেসব নিবিড় ছায়াঘেরা পথে প্রিয়জনকে নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর মুহূর্তটাই জীবনের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োটো শহরের উপকণ্ঠে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট আরাশিয়ামা। আরাশিয়ামা বসন্তে চেরি ফুলের বিস্তৃতি আর শরৎকালে রঙের ছোঁয়ায় অপরূপ সাজ নেয়। এ এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে জাপানের বিখ্যাত সাগানো বাঁশবাগান বা সাগানো ব্যাম্বো ফরেস্ট (Sagano Bamboo Forest)। একে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে বাঁশঝাড়ের মাঝখানে তৈরি হয়েছে পায়ে চলা পথ। বাঁশবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ পথের দূরত্ব ৫০০ মিটার। তেনরিউজি টেম্পল থেকে নোনোমিয়া শ্রাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে আছে লেক এবং ডজন ডজন রেস্টুরেন্ট যেগুলোতে পাওয়া যায় চমৎকার সব জাপানি খাবার। পর্যটদের আকর্ষণের মূলে থাকে এখানকার বাঁশের ঝোপ ঘেরা পায়ে চলা পথ। এ এলাকায় যে প্রজাতির বাঁশ জন্মায় তা পথটিকে ঘিরে তৈরি করেছে টানেল। এ বনটি তার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, সূর্যের আলো ও ছায়ার খেলা এবং বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া হাঁটার পথের জন্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাঁশ নিয়ে জাপানিদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কথিত আছে, বাঁশগাছের সঙ্গে মানুষের সবল ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার একটা সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবে নানা আকৃতির বাঁশব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বাঁশের তৈরি আইসক্রিম বাটি, ঘরবাড়ি, ঘেরা হরহামেশাই চোখে পড়ে। এ বনের বাঁশের তৈরি কাপ, বাক্স, ঝুড়ি, পাটির কদরও রয়েছে এই এলাকায়। কিন্তু এই এলাকায় গড়ে ওঠা প্রকৃতির এমন নান্দনিক সৌন্দর্য আর কোথাও দেখা যায় না। দেখে মনে হবে, চারপাশে ঘন বাঁশবনের প্রতিটি গাছ যেন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

বাঁশবনের এই পথের শুরু তেনরিউজি টেম্পলের প্রবেশপথ থেকে। এখানেই প্রথম বাঁশঝাড়ের গোড়াপত্তন হয়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘন বাঁশবনে রূপান্তর ঘটে। বাঁশঝাড়ে সূর্য কিরণের আলোকচ্ছটার বিচ্ছুরণ এবং পথজুড়ে হালকা ছায়ার আনাগোনা উপভোগ করতে বাইক ভাড়া নেওয়া যায়। মৃদু পায়ে হেঁটেও এগোনো যায় সে পথ ধরে। চলতে চলতে বাঁশের পাতায় বাতাস দোল খেয়ে যাওয়ার দৃশ্যও আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে। মন চাইলে কোনো তরুণ জাপানি রিকশাচালককে নিয়েও এ পথে ঘুরে আসা যায়। এজন্য ভাড়া গুনতে হতে পারে ৫ থেকে ৭ হাজার ইয়েন। এটা নির্ভর করবে গন্তব্যের ওপর।

সাগানো অঞ্চলের বাঁশবন কেবল পর্যটনকেন্দ্র নয়, বরং এটি কিয়োটোর প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ। হেইয়ান যুগে (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) জাপানি অভিজাতরা এই এলাকায় প্রাসাদ ও ভিলা নির্মাণ করেছিলেন। বাঁশবনকে তখন সৌন্দর্য, পবিত্রতা এবং সুরক্ষার প্রতীক মনে করা হতো। জাপানি মন্দির, শিন্তো শ্রাইন ও উদ্যান সাজানোর জন্য এখানকার বাঁশব্যবহৃত হতো। এমনকি বিশ্বাস করা হতো, বাঁশের বন খারাপ আত্মা দূরে রাখে। আজও ফরেস্টের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তেনরিউ-জি মন্দির, যা ১৪০০ শতকে নির্মিত এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত। তাই এই বনের প্রতিটি কান্ডে মিশে আছে কিয়োটোর প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া।

আমি যখন এই বনের সরু পথে পা রাখলাম, মনে হলো এক অদৃশ্য দরজা পেরিয়ে অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছি। উঁচু উঁচু বাঁশ মাথা উঁচু করে আকাশ ছুঁয়েছে, সূর্যের আলো ফিল্টার হয়ে পাতার ফাঁক দিয়ে নিচে নেমে আসছে, আর চারপাশে শুধু বাতাসের সুর। চলার পথে মনে হচ্ছিল, প্রতিটি বাঁশ যেন সময়ের সাক্ষী। হয়তো একসময় সম্রাটের দূতেরা এই পথ ধরে গেছে, কোনো কবি ধ্যানের খোঁজে এখানে বসেছে, অথবা কোনো সন্ন্যাসী নীরবে এই বনের ভেতরে প্রার্থনা করেছে। আমি থেমে গেলাম এক জায়গায়। বাতাস বইতে শুরু করলো, আর বাঁশগুলো একসঙ্গে দুলে উঠলো-সেই মুহূর্তে আমি যেন শুনতে পেলাম প্রকৃতির এক গোপন সিম্ফনি। শহরের শব্দ, আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা সব যেন মিলিয়ে গেল। 

আজ যখন ফিরে ভাবি, বুঝতে পারি সাগানো ব্যাম্বো ফরেস্ট কেবল একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা। ইতিহাসের ভার, প্রকৃতির শান্তি আর কবিতার সুর-সব মিলে এ বনকে করে তুলেছে কিয়োটোর প্রাণ।

হিরোশিমা থেকে কিউশু 

হিরোশিমা থেকে যাচ্ছি শহরটির পশ্চিমে কিউশু দ্বীপে। যেখানে আছে আগ্নেয় পাহাড়, উষ্ম প্রস্রবন আর নীরব প্রকৃতি। শিনকানসেনের জানালার পাশে বসে সকালের হিরোশিমাকে দেখছিলাম। ট্রেন ছুটে চললো সমুদ্রের ধারে ধারে। পাহাড়, নদী, আর দিগন্তজোড়া সবুজে আমি যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হিরোশিমা থেকে ফুকুওকা পৌঁছাতে সময় লাগল মাত্র এক ঘণ্টা। ফুকুওকাকে বলা হয় কিউশু দ্বীপের প্রবেশদ্বার।

নিকিতা জানায়, ফুকুওকা কিউশুর সবচেয়ে বড় শহর। এটি আধুনিক আর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির এক চমৎকার মিশ্রণ। ফুকুওকা সমুদ্রের ধারে অবস্থিত বিধায় সারা শহরজুড়েউ বাতাসে সমুদ্রের ঘ্রাণ। ফুকুওকা তার হাকাতা রেমেন এর জন্য বিখ্যাত। ছোট ছোট রেমেন এর স্টলগুলো শহরের প্রাণকে জীবন্ত রাখে। স্থানীয় চা, সামুদ্রিক খাবার ও আতিথ্য শহরটিকে বিশেষত্ব। নিকিতা আমাকে নিয়ে গেলো হাকাতা রেমেন খেতে। সুতি, লম্বা ও সরু নুডলস যা ছিল খুবই সুস্বাদু। গার্নিশ হিসেবে ছিল সবুজ পেঁয়াজ এবং সিদ্ধ ডিম। তারপর ট্রেন বদল করে গেলাম ইউফুইন (Yufuin) শহরে। নিকিতা বললো, বলতে পার এ শহরটা প্রকৃতির আঁচলে গড়া। চোখে পড়ছিল চারপাশে ধোঁয়া উঠছে উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে, ছোট কাঠের কটেজ আর ঝরনার শব্দ মিশে এক স্বপ্নময় নীরবতা। আমরা পায়ে হেঁটে গেলাম Kinrinko Lake-এর ধারে। জলের ওপর ভেসে আছে কুয়াশা আর পেছনে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। মনে হচ্ছিল যেন এক স্বপ্নীল পরিবেশ। নিকিতজানায়, হ্রদটি সারা বছর শীতল জল ধরে রাখে। সকালে হ্রদের ওপর ঘন কুয়াশা ভেসে ওঠে, যা হ্রদকে এক স্বপ্নময় আভা এনে দেয়। চারপাশে ছোট কাঠের কটেজ, গাছপালা এবং ঝরনার শব্দ মিশে এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে। তাছাড়া হ্রদের স্বচ্ছ জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখা যায়। ধোঁয়া এবং নরম বাতাসের কারণে এটি ফটোগ্রাফারদের কাছে স্বর্গ বলে বিবেচিত হয়।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য Mount Aso, জাপানের বৃহত্তম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি

নিকিতা জানায়, এ আগ্নেয়গিরি মাঝে মাঝে রেগে ওঠে, কিন্তু থেমে গিয়ে আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দূর থেকে দেখলাম ধোঁয়া উঠছে গহ্বর থেকে, বাতাসে সালফারের গন্ধ। এখানে আগ্নেয় গিরিকে সামনে নিয়ে নিকিতা আমার অনেকগুলো ছবি তুলে দিলো। কিউশুর শেষ গন্তব্য ছিল বেপ্পু (Bepp)। এটি জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় উষ্ণ প্রস্রবণ (onsen) শহর। এখানে শত শত উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। পাহাড় ও সমুদ্রের সংযোগ এই শহরকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে করে তুলেছে অনন‍্য। আমরা একটা উন্মুক্ত অনসেনের (onsen) পাশে বসে বসে সূর্যাস্ত দেখলাম।

ট্রেনে ফেরার সময় দেখলাম জানালার বাইরে গোধূলি নামছে। রঙ বদলাচ্ছে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের ছায়া সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি করছে এক অপার্থিব দৃশ‍্য। আমি মন ভরে দেখছিলাম এই অপরূপ প্রকৃতিকে।

পুরোনো জাপানের নাকাসেন্দো

ভোরের টোকিও তখনো ঘুমন্ত। শিনজুকুর আকাশে হালকা নীলের আভা ছড়াতে শুরু করেছে। হাতে গরম কফি, ব্যাগের ফিতে টেনে আঁট করে দাঁড়িয়ে আছি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে গাইড নিকিতা। আজ আমাদের গন্তব্য-Nakasend Route, এডো যুগের সেই কিংবদন্তি পাহাড়ি পথ, যেখানে সামুরাই, ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা-সবাই যাতায়াত করতো টোকিও থেকে কিয়োটো। শিনজুকু স্টেশন থেকে আমরা JR Limited Express ট্রেনে নাগানো অঞ্চলের দিকে রওনা হলাম। ট্রেনটা যেন জানালার বাইরে একের পর এক দৃশ্য খুলে দিচ্ছিল-টোকিওর আকাশচুম্বী ভবন, তারপর উপশহরের ঘরবাড়ি, সবুজ পাহাড়, আর ধীরে ধীরে ফার্মল্যান্ড। নিকিতা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, এডো যুগেও ঠিক এই দিক দিয়েই লোকজন যেত। শুধু ট্রেনটা ছিল না। তার কথায় এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ার হাওয়া বইল।

দেড় ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছলাম Magome-juku। পাথরের সরু রাস্তা, কাঠের পুরোনো বাড়ি, বাতাসে ভেসে আসা সোবা নুডলসের গন্ধ-সব মিলিয়ে আমাদের একটা নস্টালজিয়ায় ভর করেছিল। নিকিতা বললো, এখানে গাড়ির শব্দ নেই, রাস্তার বাতিতেও আধুনিক আলো নেই। সবই পুরোনো দিনের মতো। এক দোকানে থামলাম। দোকানদার পুরোনো এডো-স্টাইল পোশাকে, হাতে কাঠের চায়ের ট্রে। তিনি আমাদের দিলেন গরম মাচা আর চেস্টনাট কেক। এরপর শুরু হলো আসল অভিজ্ঞতা Nakasend-এর হাঁটার পথ। জঙ্গল ঘেরা পথ, দুপাশে মেপল আর সিডার গাছ, নীরবতার মধ্যে শুধু পাতার শব্দ। উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে যেতে যেতে নিকিতা গল্প শোনালো, এ পথ ধরেই একসময় সামুরাইরা কিয়োটো যেত। যারা ব্যবসা করত, তাদের জন্যও এটা ছিল সবচেয়ে নিরাপদ রুট।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক ঝরনার কাছে থামলাম।

ঝরনার ফোঁটাগুলো রোদে চিকচিক করছে।

নিকিতা ব্যাগ থেকে দুটো স‍্যান্ডউইচ বের করে একটি আমার হাতে দিলো। বললো, এডো যুগের পথিকরা এখানেই বিশ্রাম নিতো। ঝরনার শব্দ আর পাহাড়ি বাতাসে সাধারণ স‍্যান্ডউইচটিও যেন অসাধারণ লাগল। এক ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছলাম Tsumago।

এটা জাপানের অন্যতম সংরক্ষিত ঐতিহাসিক গ্রাম। এখানে ইলেকট্রিক তার দেখা যায় না, সাইনবোর্ডগুলোও কাঠের। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, এডো যুগে এসে পড়েছি। এক পুরোনো ডাকঘর দেখিয়ে নিকিতা বললো, এডো যুগে এখানে ট্রাভেলাররা চিঠি পাঠাত, একই রাস্তায় সামুরাইরাও হাঁটত। গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে নরম আলো আর কাঠের ঘরের গন্ধে মন ভরে গেল। এক দোকানে ঢুকে কিনলাম হস্তশিল্পের কাঠের স্মারক। নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কেমন লাগলো তোমার টাইম-ট্রাভেল? আমি মৃদু হেসে বললাম, আজ মনে হলো আমি শুধু হাঁটছিলাম না, সময়কে ছুঁয়ে দেখলাম।

বিকাল গড়িয়ে আমরা ফিরে এলাম স্টেশনে

ট্রেন ছুটে চললো টোকিওর পথে। জানালার বাইরে পাহাড়ি গ্রামের আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। টোকিওর ব্যস্ত আলো যখন কাছে আসতে লাগলো, তখনো মনে হচ্ছিল নিস্তব্ধ কাঠের ঘরগুলো যেন আমায় ডেকে বলছে, আবার এসো..।

শেয়ার করুন