২৮ নভেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:২০:১৯ পূর্বাহ্ন


প্রখ্যাত ইমাম আলহাজ তালীব আবদুর রাশিদের মৃত্যু
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১১-২০২৫
প্রখ্যাত ইমাম আলহাজ তালীব আবদুর রাশিদের মৃত্যু ইমাম আলহাজ তালীব আবদুর রাশিদ


নিউইয়র্কের আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম সমাজ এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নেতৃত্ব, মাজলিস আশশূরা অব নিউইয়র্ক সিটির প্রেসিডেন্ট হারলেমের প্রখ্যাত ইমাম আলহাজ তালীব আবদুর রাশিদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ধর্মীয় নেতৃত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে থাকা ইমাম আলহাজ তালীব আবদুর রাশিদ ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবন শুধু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তন এবং বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের এক প্রতীক ছিল। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে হারলেম ভিত্তিক মসক অফ ইসলামিক ব্রাদারহুড-এর ইমাম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এর আগে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই মসজিদ ম্যালকম এক্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুসলিম মসক ইনকের ধারাবাহিক উত্তরসূরি বলা হয়, আর সেই উত্তরাধিকারের অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ছিলেন ইমাম তালীব।

ম্যালকম এক্সের আদর্শ তার জীবনের মূল প্রেরণা ছিল। দি অটোবায়োগ্রাফি অফ ম্যালকম এক্স পড়েই তার ইসলামের প্রতি আকর্ষণ শুরু। পরে ‘দ্য এলিমেন্টারি টিচিংস অব ইসলাম বই তাকে ধর্মীয় জ্ঞান গভীর করতে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৭১ সালে প্রথম জুমার নামাজে অংশ নেওয়ার পর তিনি পুরোপুরিভাবে ইসলামের পথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। তালীব আবদুর-রাশিদ শুধু একজন ইমাম নন, আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম সমাজের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম কৌশলী সংগঠক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন মাজলিস আশ-শূরা অব নিউইয়র্ক সিটির প্রেসিডেন্ট এমিরেটাস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মুসলিম অ্যালায়েন্স ইন নর্থ আমেরিকা (মানা) এর ডেপুটি আমির ছিলেন। ২০১৯ সালে কেয়ার এবং জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে আফটার ম্যালকম ডিজিটাল আর্কাইভে উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়ে তিনি আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও তার অবদান অনন্য। তিনি নিউইয়র্কের মসজিদ, গির্জা ও সিনাগগে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। ১৯৯৩ সালে শিকাগোর পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস এবং ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে একই বৈশ্বিক ধর্মীয় সম্মেলনে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ৯/১১-এর পরে তিনি ছিলেন অন্যতম স্পিরিচুয়াল ফার্স্ট রেসপন্ডার-যার বক্তব্য পরবর্তীতে রেস্টোরিং ফেথ অডিও বুকে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০২ সালে তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন রিলিজিয়াস প্লুরালিজমে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হন।

তিনি প্রায়ই বলতেন, পশ্চিমে ইসলামের ইতিহাস মূলত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সাদা আধিপত্যবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস। সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও নির্ভীক। তিনি ফ্রাঁজ ফাননের রেট্রেচড অব দ্য আর্থ পড়ার পরামর্শ দিতেন এবং বলতেন, আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘ বৈষম্য থেকেই বহু রাজনৈতিক অশান্তির উৎপত্তি। রমজান প্রসঙ্গে তার একটি বিখ্যাত বক্তব্য হলো-আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা দাসত্বের সময়ও রমজান পালন করতো। রমজান আমাদের আত্মিক শক্তির উৎস আর এটি মন্দের বিরুদ্ধে আধ্যাত্মিক সংগ্রাম। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে।

১৯৭০-এর দশকে তিনি নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কমিউনিটি লিয়াজোঁ হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং পরে পুলিশের গুলিতে নিহত তিন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক-শুয়াইব আব্দুল লতিফ, আমাদু দিয়ালো ও ওসমানে জঙ্গো-বিষয়ক তিনটি আলোচিত মামলায় ন্যায়বিচারের দাবিতে নেতৃত্ব দেন। তিনি স্টপ অ্যান্ড ফ্রিস্ক নীতি এবং মুসলিম নজরদারি প্রোগ্রামের দৃঢ় বিরোধিতা করতেন। ২০১৩ সালে তার দীর্ঘদিনের সামাজিক ও আন্তঃধর্মীয় কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ব্রিজ বিল্ডিং অ্যাওয়ার্ড, মাইকাহ জাস্টিস অ্যাওয়ার্ড এবং সিটিজেন অব দ্য সিটি অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক সম্মাননা পান।

তার মৃত্যুতে কেয়ার নিউইয়র্ক ও কেয়ারের জাতীয় নেতৃত্ব গভীর শোক প্রকাশ করেছে। কেয়ার নিউইয়র্কের নির্বাহী পরিচালক আফাফ নাশের বলেন, ইমাম তালীব ছিলেন আমাদের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। কেয়ারের জাতীয় নির্বাহী পরিচালক নিহাদ আওয়াদ বলেন, নিউইয়র্কের মুসলিম সমাজে তিনি ছিলেন আলোর দিশারি। সাউথ ব্রঙ্কসে বেড়ে ওঠা ইমাম তালীব শৈশবেই বিভিন্ন ধর্মীয় ধারণা নিয়ে অনুসন্ধানী ছিলেন। সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ম্যালকম এক্সের নাটক দি ট্রায়ালের একটি স্ক্রিপ্ট তার মনে গভীর আলোড়ন তোলে। এরপর মসক অব ইসলামিক ব্রাদারহুড়ের যুবকদের আমন্ত্রণে জুমার নামাজে যোগ দিয়ে তিনি ইসলামের পথে স্থায়ী যাত্রা শুরু করেন।

ইমাম আবদুর রাশিদের মৃত্যু শুধু একটি মসজিদের ইমাম হারানোর ঘটনা নয়, এটি আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলমানদের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার সংগ্রামের একজন সাহসী কণ্ঠের বিদায়। তিনি ছিলেন ধর্মীয় নেতা, নাগরিক অধিকারের সৈনিক, আন্তঃধর্মীয় ঐক্যের সেতুবন্ধনকারী এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অদম্য কণ্ঠস্বর। তার মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হলেও তার শিক্ষা, সংগ্রাম ও অনুপ্রেরণা ভবিষ্যত প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে যাবে-নিউইয়র্কের মুসলমান থেকে শুরু করে আমেরিকার বৃহত্তর সমাজ পর্যন্ত।

শেয়ার করুন