অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত আজকের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই। আজকের এই বিশেষ দিনে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ, যুদ্ধাহত এবং অন্যান্য সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
একই সঙ্গে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সকল শহীদ, আহত এবং অংশগ্রহণকারী সর্বস্তরের মানুষের প্রতি; যাদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ আমাদের দেশ পুনর্গঠনের একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।’
আজ শুক্রবার (২১ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার‑উজ‑জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় আসন্ন নির্বাচন নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর করতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী তাদের পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ে দেশের জন্য ত্যাগ ও তৎপরতার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে আসন্ন নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনী সর্বদাই জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।

২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, চলমান দেশ পুনর্গঠন ও সংস্কারকাজেও সশস্ত্র বাহিনী বরাবরের মতোই মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অব্যাহতভাবে দেশের মানুষের আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজকের এই বিশেষ দিনে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদ, যুদ্ধাহত ও অন্যান্য সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। একই সঙ্গে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সব শহীদ, আহত এবং অংশগ্রহণকারী সর্বস্তরের মানুষের প্রতি, যাদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ আমাদের জন্য দেশ পুনর্গঠনের একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম ১৯৭১ সালের রণক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিল বলে ২১ নভেম্বরকে মুক্তিযুদ্ধের একটি মাইলফলক হিসেবে গৌরবের সঙ্গে পালন করা হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সংগ্রামের সূচনা ঘটে ২৫ মার্চের রাত থেকেই। আমরা যদি বিজয় অর্জন না করতাম, তাহলে এই বীর সেনাদের মৃত্যুদণ্ড ছিল অনিবার্য। অসহনীয় হয়ে যেত তাঁদের পরিবারের সব সদস্যের জীবন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিকামী সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানীরা জীবনের পরোয়া না করে, পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁরাই এ দেশের আপামর জনসাধারণকে সাহস জুগিয়েছেন।
মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জল-স্থল ও আকাশপথে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে এনেছেন। যুদ্ধ বেগবান ও সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তখন বাংলাদেশ ফোর্সেস গঠন করা হয়েছিল। যার অধীনে ১১টি সেক্টরে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘এরই চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখি ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে এই যৌথ অভিযানই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় এনে দিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘একটি শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমরা সব বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মানজনক সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তথাপি, যেকোনো আগ্রাসী বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সদা প্রস্তুত এবং সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। এ লক্ষ্যে আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাহিনীগুলোতে যুগোপযোগী প্রযুক্তি সংযোজনের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিগত ৩৭ বছরে জাতিসংঘে আমাদের শান্তিরক্ষীরা সফলতার সঙ্গে ৪৩টি দেশে ৬৩টি মিশন সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ১০টি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত আছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে অন্যতম বৃহৎ নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবেও বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য নাম। এ জন্য আমি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যাতে বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং এবং বিপজ্জনক অঞ্চলসমূহে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’