চিত্রে ভূমিকম্পের ঝুঁকি
২১ নভেম্বর ২০২৫ সমর্থিত সূত্রের মতে, ৫ দশমিক ৭ রিখটার মানের ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ কেঁপে ওঠে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা শহরের বেশ কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এযাবৎ পাওয়া খবর অনুযায়ী ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। কয়েকশত মানুষ আহত হয়েছে। অনেকের মতে ভূমিকম্পটি স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) ছিল ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায়। এমনিতেই বাংলাদেশ দুটি ভারত এবং মায়মানমার টেকটনিক প্লেট দুটির কেন্দ্রস্থলে থাকায় টেকটনিক মুভমেন্টের কারণে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, ভূমিকম্পসহ দুর্যোগব্যবস্থাপনা নাজুক থাকায় যেকোনো মুহূর্তে আরো একটু বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতে পারে। দেশে অধিকাংশ এলাকায় নির্মাণ নীতিমালা না মেনেই অনেক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় পানির স্তর নিচে নেমে ফাঁকা হয়ে গাছে। উপরে ছড়িয়ে আছে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন, নিচে বহু ছিদ্রযুক্ত গ্যাস পাইপলাইন। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভূমিধস, ভবনে ধসের পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডে প্রচুর প্রাণহানি ঘটবে। আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজার ভবন ধসের সময় দেখেছি বাংলাদেশের ব্যাবস্থাপনা কতটা অপ্রতুল।
এখন আসুন ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রসঙ্গে
এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে খুবই কাছে, ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলা। এখানে আমাদের জিওলজিক্যাল সেটআপ বা টেকটনিক গঠন (ভূতাত্ত্বিক গঠন বা বিন্যাস), সেখানে দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি, গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। এই সংযোগস্থলটা সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর এলাকা হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের আন্দামানে চলে গেছে। সংযোগস্থলের পূর্বেরটি হচ্ছে বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমেরটি ইন্ডিয়ান প্লেট।
এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলকে গবেষকরা বলছেন, সাবডাকশন জোন। এর মানে, একটি প্লেটের নিচে যখন আরেকটি প্লেট তলিয়ে যায়। আমাদের এই সাবডাকশন জোন সিলেট থেকে কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটটা তলিয়ে যাচ্ছে। নরসিংদীতে প্লেটের যে সংযোগস্থল, সেখানেই ভূমিকম্প হয়েছে।
প্লেটের সংযোগস্থলের শক্তি দীর্ঘ ৮০০ থেকে ১ হাজার বছর ধরে সঞ্চয় করা। আজ হোক কাল হোক, এই শক্তি বের হবেই; ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার শক্তি এখানে জমা হয়ে আছে। যার মধ্যে বৃহৎ প্লেট বাউন্ডারির একটি ক্ষুদ্র শক্তি আনলক হলো মানে খুলে গেল। এই যে খুলে গেল, আরেকটা বিপদ আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। সামনে এই শক্তিগুলো বের হওয়াটা সহজ হবে।
বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড খুব আধুনিক বা উন্নত মানের বলা যাবে না। তদুপরি বিল্ডিং কোড না মেনে বিশেষত ঢাকা মহানগরীতে অনেক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। মাটির নিচেও কোথায় কোন নাগরিক পরিষেবা লাইন আছে তার সুনির্দিষ্ট রেকর্ডস নেই। ঢাকা মহানগর জুড়ে নির্মিত ফ্লাই ওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস সড়ক এমন কি মেট্রোরেল লাইন বড় ভূমিকম্প হলে ধ্বংস হতে পারে। ঢাকার বর্তমান সমস্যা ৫০-১০০ বছরেও সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া যাবে না। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করে এগুলো অবিলম্বে ভেঙে ফেলা উচিত। অন্যান্য ভবনগুলোর রেট্রোফিটটিং করে কিভাবে আরো ভূমিকম্প সহনীয় করা যায় ব্যবস্থা গৃহীত হতে পারে।
দেরিতে হলেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকা সহ বড় শহরগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপিং করা প্রাসঙ্গিক। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরের অলিগলিতে নির্মিত গ্যাস পাইপলাইনগুলো শতছিন্ন হয়ে মিথেন অ্যামিশন করছে। অনেকগুলো গ্যাস বাহিত অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। অবিলম্বে বড় শহরগুলোর পুরানো গ্যাস পাইপলাইনগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত করে নদীগুলোর সংস্কারের পর সারফেস ওয়াটার, রিসাইকেল ওয়াটার ব্যবহারে জোর দেওয়া জরুরি। কাজগুলো কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। এগুলোকে কোনোভাবেই আমলাদের নিয়ন্ত্রণে দিলে কাজ হবে না.
দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাগুলোকে সমন্বিত করে একটি আধুনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। বিষয়টিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। আশা করি, জাতীয় পর্যায়ে বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হবে।