১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, বুধবার, ০৭:৩৫:৪৯ অপরাহ্ন


বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বিষবাষ্প
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-১২-২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বিষবাষ্প


স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় রাজাকারের (পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতাকারী) কাহিনি বিএনপি ১৯৯০ সাল থেকে মুছে দেওয়ার পক্ষে ছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতার অনুপস্থিতিতে সে বিষয়কে পুঁজি করে বাংলাদেশে নতুন করে মৌলিক রাজনীতির বিভাজন টেনে চলছে কুচক্রীরা। অবশ্য  জামায়াতের পক্ষ থেকে যদিও প্রথম বিএনপির জোটবদ্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। তখন তাকে বড় দল হিসেবে বিএনপি উপশম করার চেষ্টা না করে আরো গভীরে ঠেলে দেয়। এখন তো বিষয়টা ভায়োলেন্ট আকার ধারণ করেছে। বিএনপি ও  জামায়াতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও মারামারি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ভারতের ফ্রন্টলাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা ফয়সাল মাহমুদ সাম্প্রতিক কালের একটি চিত্র তুলে ধরেন। মানবাধিকার মনিটর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিএনপি ও  জামায়াতের মধ্যকার সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ২০২৪ সাল থেকে ড্রাম্যাটিক হারে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৪৭টি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এ দুদলের মধ্যে। তাতে ১৬০-এর বেশি লোক মারা গেছে এবং ৮ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। এ হিসাব দিয়েছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। তারা আরো বলেছে, বিএনপির অভ্যন্তরে ২৯১টি সংঘর্ষ হয়েছে। তাতে ৭৪ জন মারা গেছে ও ৩ হাজার ৩৫২ জন আহত হয়েছে।

তাছাড়া জুলাই বিপ্লবের নায়কদের আওয়ামী লীগ এখনো হত্যা করে চলেছে। তার সর্বশেষ বলি হচ্ছে ওসমান হাদি। যিনি কোনো গ্রুপের মধ্যে না থেকে নিজেই আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির অবসানের পর আওয়ামী বিরোধী শক্তির মধ্যে বেশ রকমের মতানৈক্য শুরু হয়। এ মতানৈক্য উপরি উপরি নয়, বরং তা গভীর ঘাতের সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেক দল বা গোষ্ঠী হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করেছে।

এর মধ্যে  জামায়াতে ইসলামী তাদেও চেয়ে ছোট অংশীদারদের সঙ্গে মতদ্বৈততা বিসর্জন দিয়ে একসঙ্গে হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা নিজেরা সক্রিয়ভাবে একক অবস্থান নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা রক্ষণশীল, ধর্মীয় ভোটার, দৃঢ় ইসলামিক রাজনীতির দলের সঙ্গে জোট করে বিশ্বাসভিত্তিক দল সৃষ্টি করছে। তারা তাদের ধ্যানধারণা মোতাবেক প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন চাইছে। অন্যদিকে বিএনপি নিজেকে মডারেট, উদারপন্থী ধর্মনিরেপেক্ষ ও অধিকাংশ ভোটারদের যেমন মন জয় করার চেষ্টা করছে। তারা ইসলামি লোকজনের উত্থান নিয়ে যারা শঙ্কিত তাদের কাছে টানার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের দেশে অবস্থান করা লোকদেরও তারা কাছে টানতে চায়। আর তারা চায় নিজের মতো করে ক্ষমতা সংহত করতে। আরো চায় মূলস্রোতধারায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরবর্তী নির্বাচন পাড়ি দিতে। তারা বিভিন্ন শ্রেণি ও জোটভুক্তদের নিয়ে সম্ভাব্য জাতীয় সরকারও গঠন করতে চায়। কিন্তু বিষয়টা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যতটা মনে করা হচ্ছে ততটা সহজ নয়। বর্তমানে দেখা যায় জাতীয় সরকারের কথা কেউ কেউ আলোচনা করলেও তা কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান করবে না। এক মত যদি উত্তরে যেতে বলে ভিন্নমত বলবে দক্ষিণে যেতে। যেমন বিএনপি একদিকে ভারতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চায়, কিন্তু জামায়াত সে বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। এতে যে কোনো ধরনের জাতীয় সরকার শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

বাংলাদেশের এ যাত্রা স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বৈসদৃশ ও নতুন। স্বাধীনতার পর অস্ত্র লুণ্ঠন ছাড়াও ভারত বাংলাদেশের মেরুদণ্ড লেপটে দিলো। কিন্তু এখন বাংলাদেশের অনেক বন্ধু থাকলেও ভারত সরাসরি শত্রুতায় লিপ্ত। পুশইন করার বিষয়টা ছাড়াও ভারত এখন বাংলাদেশ সরকারের ঘাতকদের দিচ্ছে সহায়তা ও ফ্যাসিবাদের জননীকে দিচ্ছে আশ্রয়। কাজেই বাংলাদেশের পথ চলার ছক বদলে গেছে।

এরপর বিএনপি ও  জামায়াতের মধ্যে ধরেছে ফাটল। এই ফাটলের পরবর্তী যাত্রার পৃথক ফল অনেক ব্যাপক। প্রথমত নির্বাচনী রাজনীতির চলছে এক বিষম পথচলা। বিগত শতাব্দীর শেষ দশক ছিল এমন এক সময় যখন মনে করা হতো বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের বিকল্প। কিন্তু সেই মেরু এখন বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন ভিন্ন গোলার্ধের ভাঙ্গার গানের পথ ধরে চলছে। দুদলই এখন নতুন নতুন দলের সঙ্গে জোট গড়তে বিগত জোটের নতুন মূল্যায়ন শুরু করেছে। উভয় দলই নতুন মূল্যায়ন শুরু করেছে। উভয় দলেই ভারতীয় নতুন বীজ বপন করা হয়েছে। বিএনপিতে দৃশ্যমান হলেও  জামায়াতে তা অদৃশ্য।

দ্বিতীয়ত: জামায়াত বিএনপির ভাগবাঁটোয়ারার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)Ñযারা জামায়াত বিএনপির থেকে বেরিয়ে আসা ছাত্রনেতাদের সৃষ্ট। তারা যুব মানসিকতাকে ধারণ করতে চায়। সংস্কার এগিয়ে নিতে চায়। এবং জুলাই বিপ্লবের আদর্শকে নতুন রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চায়। এর মধ্যে স্বতন্ত্র পথ ধরে চলেছিল ওসমান হাদি। এ এনসিপির উত্থান প্রাক্তন দুদলের যুক্তিকে ভোঁতা করে দেয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় ধারার সৃষ্টি করে।

তৃতীয়ত: এ ভাগাভাগি রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনকে এক প্রচ্ছন্ন শক্তি দিয়েছে।

অনেক পর্যবেক্ষকদের মতে বিএনপি- জামায়াতের অনৈক্যের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগে তার সমর্থকদের সমর্থন পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে যেখানে ইসলামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষপন্থী ও যুবশক্তির মধ্যে ঐক্যের বানচাল হয়েছে। আসলে বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ অনেকের মতে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা পুনরায় ফিরে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

চূড়ান্তভাবে বলা যায়, এ ভাগাভাগি বাংলাদেশের মূলধারায় বিরোধী শিবিরে আদর্শগত পরিবর্তন এনেছে। একসময় যেখানে সেন্টার রাইট ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও রক্ষণশীল ইসলামী পার্টির মধ্যে আঁতাত ছিল, তা এখন আদর্শগত বিভাজন ও আইডেনটিটি রাজনীতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। একদিকে জামায়াত যেখানে বিশ্বাসভিত্তিক রক্ষণশীল শক্তি হিসেবে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে রাজনীতির ভয়কেন্দ্র ডানদিকে ঝুঁকবে। অন্যদিকে বিএনপি যেখানে জামায়াত থেকে দূরে গিয়ে উদারপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ সাজতে চায় তা এ দলকে অতীত থাকে বিচ্ছিন্ন করবে।

তবে উভয় দলের মধ্যে সমঝোতা বা স্থিতিশীলতা অনেক দূরে। জামায়াতের উত্থান কি সত্যিকার নির্বাচনী শক্তিতে রূপান্তরিত হবে? আর বিএনপি'র জন্য সমস্যা হচ্ছে যারা আগের জোটকে ভালো জানতো, তারা কি এই দলটিকে সুবিধাবাদী হিসেবে ভাববে? তবে হাসিনা বিহীন রাজনীতিতে এ দলটি বহুদা উপদলে বিভক্ত। তারা হাসিনার ফেলে যাওয়া দেশটারও ভাগ নিতে চায়।

বিএনপি চায় নির্বাচন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিএনপি  জামায়াতের মধ্যেকার বিভাজন নেহায়েত মতপার্থক্য নয়। বরং এটা হচ্ছে রাজনৈতিক জোটের মৌলিক পুনর্গঠন যা বাংলাদেশের রাজনৈতিকে নতুনরূপ দেবে।

শেয়ার করুন