বাংলাদেশের মূলধারার বিরোধীদল বিএনপি সমমনা কিছু দল আর ফ্রন্টগুলোর সাথে জোট বেঁধে ১০ ডিসেম্বর ২০২২ সরকারি দলকে পদত্যাগের সময় সীমা বেঁধে দিয়ে বারবার বক্তব্য দিলেও শেষ পর্যন্ত সে অবস্থান থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি বলছে, অন্যসব বিভাগীয় সম্মেলনের মতোই এটাও একটা সম্মেলন হবে। তবে তাদের দাবি আগের মতো এখনো বহাল যে, সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এই দাবির সঙ্গে আরো কয়েকটি দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভাগীয় শহরগুলোসহ কয়েকটি শহরে সমাবেশ করছে বিএনপি আর তাদের ঘরানার দলগুলো।
এমনিতে দেশে তীব্র বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকট বিরাজ করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্যের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। অনেকটা এসব উপসর্গের কারণেও সরকার নানাধরনের বাধার সৃষ্টি করলেও সমাবেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকসমাগম দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা বলেছিল, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে বিএনপির কারাবন্দি নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। হয়তো এ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা এসেছে দুর্নীতি, খুনের মামলা মাথায় নিয়ে ভিনদেশে অবস্থানরত (যা বাংলাদেশের আইনের ভাষায় পলাতক) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের কাছ থেকে।
সবাই জানে বাংলাদেশের বর্তমান সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। সরকার দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় সরকারি দল। বিরোধী আন্দোলনকে রাজপথে মোকাবিলা করার জন্য সরকারি দল আর ফ্রন্টগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার বলছে গণতান্তিক আন্দোলনে বাধা নেই কিন্তু সহিংস আন্দোলন হলে সরকার কঠোর হাতে দমনের কথা দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করছে। এমন বলছে সরকারের মন্ত্রীরা যে বেপথু আন্দোলন হেফাজতের আন্দোলনের মতো দমন করা হবে। সরকারদলীয় নেত্রী সোজা ভাষায় বলেছেন বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে ওদের কারাদ-প্রাপ্ত নেত্রীকে (বেগম খালেদা জিয়া) পুনরায় কারাগারে ফেরত পাঠানো হবে।
দু’পক্ষ নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিতে আর অবস্থানে অটল থাকলে রাজপথে সংঘর্ষ অনিবার্য। ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। এই মাসে জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে একাত্তরের বীর শহিদদের, নিহত বুদ্ধিজীবীদের। সঙ্গত কারণেই এই মাসে দেশে অরাজকতা ও সংঘাত বিরাজ করুক সেটি কারো কাম্য নয়।
নিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী দুই রাজনৈতিক ফ্রন্ট আর দলগুলোর যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে শঙ্কিত-আতঙ্কিত। দেশে সংকট থাকলেও সরকার পতনের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলা যাবে না। দেশ পরিচালনায় গত ১৪ বছরে সরকারের অনেক সাফল্য ব্যর্থতা আছে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সংকট থেকে উত্তরণ করতে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক সংঘাত কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। ইদানীং কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান আর দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অনাকাক্সিক্ষতভাবে নাক গলাচ্ছে। কূটনৈতিক মিশনসমূহকে রাজনৈতিক দলগুলো এই বিষয়গুলোতে টেনে আনছে। দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। দেশের দ্বিধাবিভক্ত বুদ্ধিজীবী মহল জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করার অবস্থানে আছে বলে মনে হয় না।
করোনার অভিঘাত আর রাশিয়া- ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব অনিবার্য অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান নিজেও বলছেন অর্থনৈতিক মন্দা থেকে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বাণিজ্যিক ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে দারুণভাবে। রাজনৈতিক অরাজকতা সংকটে ঘনীভূত করলে বাংলাদেশকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক সংকট আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান অসম্ভব বলে মনে হয় না।
যতো হুমকি ধামকি দেয়া হোক না কেন ডেডলাইন ১০ ডিসেম্বর সরকার পতনের মতো শক্তি নেই বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর। কোনো ওহি বলেও সরকার পতন হবে না। দেশে অরাজনৈতিক শক্তি এসে পরিস্থিতির সুযোগ নিবে বলে মনে হয় না। তাই সময় থাকতেই উভয়পক্ষকে সমঝোতার পথ বেছে নেয়াই হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাক্সিক্ষত পদক্ষেপ। দেশপ্রেমিক শক্তির উচিত এখন সোচ্চার হবার। ডিসেম্বর মাসকে শ্রদ্ধা করে হলেও সংঘাত এড়িয়ে চলার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সেই সঙ্গে সরকার তার ভুলত্রুটিগুলো শুধরে দুর্নীতিবাজদের কেবল মুক্ত হয়ে সুস্থ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করুক।