বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান
‘এসি রুমের ভেতরে থাকলে হবে না। আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে’- বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এমন বার্তা নিয়ে নানান আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে। তার এমন বক্তব্যে স্পস্ট হয়ে উঠেছে ক্ষমতা না যেতে যেতেই দলের এক শ্রেণীর নেতাদের উচ্চাভিলাসী আশা আকাঙ্খায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিষয়টি। এর পাশাপাশি ঘরে ঘরে বসে টাকা ছিটিয়ে যে এবারের মানুষের মন জয় করা যাবে না তা-ও তার বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে।
কি বললেন তারেক রহমান
গত ১৪ ডিসেম্বর রোববার রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জনপ্রত্যাশা শীর্ষক এক আলোচনা সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তারেক রহমান। এসময় তিনি বিএনপি সরকার গঠন করলে কী কী করবে তার পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এসব বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এসি রুমের ভেতরে থাকলে হবে না। আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে। পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতির উপকার হবে। এই কাজগুলো করার জন্য জনসমর্থন প্রয়োজন এবং আগামী সরকারকে সেভাবে শক্তিশালী ম্যান্ডেটের ওপরে দাঁড়াতে হবে। যদি জনসমর্থন দুর্বল হয়, তাহলে হয়তো অনেক কাজ করা সম্ভব হবে না।
কেনো একথা বললেন তারেক রহমান?
জানা গেছে, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে বিস্তর অভিযোগ আছে যে দলটির একশ্রেণীর নেতাকর্মীরা ধরেই নিয়েছে যে তারা ক্ষমতায় খুব দ্রুতই ক্ষমতায় আসীন হচ্ছেন। তারা মনে করছেন, বিএনপিই আগামীতে দেশ চালাবে। বিএনপি’কে ঠেকানো আর কারো পক্ষে সম্ভবই নয়। এমন ভাব ভঙ্গিময়ায় চলছে বিএনপি’র একশ্রেণীর নেতারা। অন্যদিকে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে একশ্রেণীর কর্মী এমনকি সমর্থকদেরও হম্বিতম্বিতে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এর বিপরীতে অনেকে এখনই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনে সম্ভ্যাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বিএনপি। এক মাস পর ৪ ডিসেম্বর আরও ৩৬টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা দেয় দলটি। সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থী বদলের দাবি জানিয়ে অসন্তুষ্টরা প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন। তেমনি যারা মনোনয়ন পেয়ে গেছেন তারা যেনো সব পেয়ে গেছেন এই ভঙ্গিমায় এলাকায় দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরা ধরেই নিয়েছে দল তাদের মনোনয়ন দেওয়ার অর্থই হচ্ছে বিজয়ী। কিংবা ধরেই নিয়েছে তারা এখনই ওই আসনের হর্তাকর্তা বনে গেছেন।
তারেক কি হাদি-জারা স্টাইলে ভোট চাইতে বললেন?
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ভোট চাওয়া ও তার পক্ষে স্বর্ত:ষ্ফুতভাবে জনগণের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ নাড়া দিয়েছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে ধনী-দরিদ্র সবাই যেভাবে শরিফ ওসমান হাদিকে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছেন তাতে পুরো এলাকাই নয়, সারাদেশে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছে। এ-টা যে কেবল শরিফ ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা গেছে তাও নয়। বরং জুলাই বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত এমন নেতাদের যারা প্রার্থী হিসাবে গণসংযোগ করছেন তাদের বেলাতেও তা-ই ঘটতে দেখা গেছে। দেখা যাচ্ছে, শরিফ ওসমান হাদিসহ এমন প্রার্থীরা অকাতরে জনগণের কাতারে মিশে যাচ্ছেন, ভোট চাচ্ছেন সহজসরল ভঙ্গিমায়..যা আগে কখনোওই দেখা যায়নি।
ব্যতিক্রমী ঘোষণা তাসনিম জারারও
অন্যদিকে ঢাকা-৯ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রার্থী তাসনিম জারা নির্বাচনি প্রচারণার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এমন ঘোষণাও রাজনৈতিক অঙ্গনে জনগণ অন্যভাবে দেখছেন। তাসনিম জারা তা-র ঘোষণায় পোস্টার ব্যবহার না করার কথা জানান। ১২ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি এ সিদ্ধান্তের পেছনের তিনটি কারণ তুলে ধরেন। তাসনিম জারা জানান, সৎ ও সহজ জীবনধারা তার দীর্ঘদিনের অনুসরণ। কিন্তু রাজনীতিতে এই সততা অটুট রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও সংস্কৃতিতে অনৈতিক প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’ তিনি জানান, নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা তার গবেষণায়ও উঠে এসেছে। আইনগত ব্যয়সীমা মেনে প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেও এলাকায় দেখা যাচ্ছে অন্যান্য প্রার্থীর পোস্টারে রাস্তা ও দেয়াল ভরে গেছে। তার ভাষায়, এসব পোস্টার যেন ঘোষণা দেয় ‘এলাকাটি আমার।’
বিএননিসহ অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে
কারো কারো মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাহসী শিক্ষিত মার্জিত ও জুলাই বিপ্লবীতে অংশ নেওয়া এমন প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা পুরো জাতি এখন অন্যভাবেই বিচার বিশ্লেষণ শুরু করছেন। এবিষয়গুলি বিএনপি-জামায়াতকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ এ-ই দু’টিসহ প্রায় সবদলের প্রত্যেকেই নির্বাচনী এলাকায় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এমনকি প্রতিদিনই বিশাল বিশাল শো ডাউনে ব্যস্ত রেখেছেন, গোপনে প্রকাশ্যে টাকা ঢালছেন। এসব দলের নেতাকর্মীদের গায়ে দামি কাপড়ের টি-শার্ট জ্যাকেটে সয়লাব। প্রতিটি সমাবেশে অংশ নেওয়া এসব দলের নেতাকর্মীদের গায়ে চড়া টি-শার্টের রং বদলায়। কেউ কেউ ধর্মীয় আদর্শের দোহাই দিলেও নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা গেছে এরা বিশাল অর্থের ভান্ডার নিয়ে এলাকায় এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেক এলাকায় এসব দলের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যানার ফেস্টুন আর দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টারে সয়লাব। সাধারণ জনগণ এসব মোটেই ভালোভাবে দেখছে না, তবে মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না। কারো দেওয়ালেই পোস্টার সাটাতে ওই বাড়ির মালিকের ন্যূনতম অনুমতিও নেওয়া হচ্ছে না। গায়ের জোরে অনেকের বাড়ির দেওয়াল এখন পোস্টার সাটিয়ে দেওয়া হলেও না নির্বাচন কমিশন না আইন শৃংখলায় নিয়োজিত কেউই টু-শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এব্যাপারে কোনো কর্তৃপক্ষেরই সাড়া শব্দ নেই।
বিএনপিসহ সবদলের অফিসেই এসি
এদিকে সরজমিনে দেখা গেছে বিএনপি জামায়াতসহ সব দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার সব কেন্দ্রীয় অস্থায়ী কার্যালয়ই এয়ারকন্ডিশনে সয়লাব। প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালানো হোমড়া চোমড়ারা এসি রুমে বসেই ফুট ফরমাস চালিয়ে যাচ্ছেন। সকাল সন্ধ্যায় এসব রুমে বসেই পোলাও বিরিয়ানি গিলছেন তারা। কিন্তু সেদিক থেকে ২৪ জুলাইয়ে অন্দোলনে অংশ নেওয়ার ছাত্রদের মধ্যে যারা এবারের নির্বাচনী প্রার্থী হচ্ছেন তারা নিচ্ছেন ব্যতিক্রমী আয়োজন। সাদা সিদে পথে হেঁটেই তারা জনগণের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। সঙ্গে নেই তাদের সাথে কোনো ক্যাডার বাহিনী। তাদের পকেটে নেই টাকার বান্ডিল। নেই কেন্দ্রীয় ভোট কার্যালয় যেখানে বসে পোলাও কোর্মা গিলবে। প্রচার প্রচারণা চালাতে গিয়ে দেখা গেছে এরা হাটে-মাঠে-ঘাটে সাধারণ জনগণের সাথে বসে গল্প গুজব করে ভোট চাচ্ছেন। কিংবা চা বিস্কুট খেয়ে ভোটারদের মন জয় করতে ব্যস্ত। নেই ব্যাংক ব্যালেন্স.. নেই হোন্ডা বহর বা দামি গাড়ির মহড়া..। প্রশ্ন হচ্ছে জুলাই বিপ্লবের পর আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রচারণার মাঠে এমন ‘বৈপ্লবিক পর্ব’ দেখেই কি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের টনক নড়ে গেছে? এজনই কি তিনি উচ্চাভিলাসী নেতাদের ডাক দিয়েছেন ‘এসি রুমের ভেতরে থাকলে হবে না। আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে’- এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে।