বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কৌশলবিদ জারা রহিম
নিউইয়র্ক সিটির রাজনৈতিক অঙ্গনে চমক সৃষ্টি করে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জোহরান মামদানি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে ছিলেন এক তরুণী কৌশলবিদ, যিনি নীরবে বদলে দিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণার ধরন-৩৫ বছর বয়সী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান জারা রহিম।
রাজনীতির মঞ্চে এবং ডিজিটাল কৌশলে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জারা রহিম ছিলেন মামদানির প্রচারণার সিনিয়র উপদেষ্টা। তিনি দলের ভেতর প্রথম থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন-রাজনৈতিক কৌশলবিদদের কল্পিত নিউইয়র্ক নয়, বাস্তব নিউইয়র্কের মানুষের কথা বলো। এই দৃষ্টিভঙ্গিই পুরো প্রচারণার ভিত্তি হয়ে ওঠে। ফলাফল-৯০ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গড়ে ওঠা এক গণমুখী প্রচারণা, যা অবহেলিত নাগরিকদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনে।
দক্ষিণ ফ্লোরিডায় জন্ম নেওয়া প্রথম প্রজন্মের বাংলাদেশি-আমেরিকান জারা রহিমের কর্মজীবন শুরু হয় ২০১২ সালে বারাক ওবামার পুনর্নির্বাচন প্রচারণায় ডিজিটাল কনটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে। পরে তিনি হোয়াইট হাউসের ডিজিটাল স্ট্যাটেজি দফতরে কাজ করেন এবং পরবর্তী সময়ে উবারে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণায় যোগ দেওয়ার পর তিনি কিছু সময়ের জন্য রাজনীতি থেকে সরে যান এবং ভোগ ম্যাগাজিনের কমিউনিকেশনস ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন (২০১৭-২০১৮)। সেখানে ফ্যাশন, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মিশেলে তার যোগাযোগ দক্ষতা আরো পরিপক্ব হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি স্বাধীন পরামর্শক হিসেবে এ২৪, মারাইয়া ক্যারি এবং নেটফ্লিক্সের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। মামদানির প্রচারণায় জারার কৌশল ছিল-বাস্তব সংযোগ ও সত্যিকার অংশগ্রহণ। তিনি জানতেন, সোশ্যাল মিডিয়ার সাফল্যের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের যোগাযোগের ভারসাম্য রাখতে হবে। তার পরিকল্পনায় প্রতিদিনের নির্বাচনী কার্যক্রমের ফাঁকে টিকটক ও ইনস্টাগ্রাম ভিডিও ধারণ হতো, আর সেই সঙ্গে প্রার্থীর মুখে শোনা যেত স্প্যানিশ, হিন্দি ও বাংলা ভাষায় বার্তা-যা পৌঁছেছিল শহরের মুসলিম ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে।
যখন কুমো ইসলামবিরোধী মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ান, তখন জারা রহিম দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সিএনএনকে বলেন, তিনি মুসলিম ভোটারদের আকর্ষণ করার পরিবর্তে একজন মুসলিম নেতাকে খারাপ বলে দেখানোর চেষ্টা করছেন-এটি একজন ব্যর্থ রাজনীতিকের কৌশল। প্রচারণার অন্য মূল ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন মায়া হান্ডা, তাশা ভ্যান অউকেন ও ফায়জা আলি। ভ্যান অউকেনের নেতৃত্বে দলটি প্রাইমারিতে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন বাড়িতে কড়া নেড়ে ভোটারদের সঙ্গে ২ লাখ ৪৭ হাজারেরও বেশি সরাসরি আলাপ করে।
৪ নভেম্বর মামদানির বিজয়ের পর ঘোষিত সর্ব-মহিলা ট্রানজিশন টিমে জারা রহিমও রয়েছেন, অন্যদের মধ্যে আছেন সাবেক এফটিসি চেয়ার লিনা খান, প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র মারিয়া টরেস-স্প্রিংগার, ইউনাইটেড ওয়ে প্রধান গ্রেস বনিলা ও সাবেক ডেপুটি মেয়র মেলানি হার্টজগ।
আগামী ১ জানুয়ারি ২০২৬ সালে দায়িত্ব নেবেন জোহরান মামদানি-নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম, প্রথম দক্ষিণ এশীয় এবং শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে তরুণ মেয়র হিসেবে। আর তার বিজয়ের গল্পে এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হয়ে থাকবেন জারা রহিম, যিনি বাস্তব নিউইয়র্ক-এর কণ্ঠকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন।
দক্ষিণ ফ্লোরিডায় বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান, জারা রহিম হলেন ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসা বাংলাদেশি অভিবাসী দম্পতির সন্তান। মামদানির প্রচারণায় যোগদানের আগে, তিনি ইউনূস সেন্টারে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে কাজ করেছিলেন, পরে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ২০১২ সালের পুনর্নির্বাচনের প্রচারণায় ফ্লোরিডার ডিজিটাল কন্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেছিলেন। হিলারি ক্লিনটনের ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি প্রচারণায় কাজ করার পাশাপাশি তিনি হোয়াইট হাউস অফিস অফ ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিতে কাজ করেছিলেন এবং উবার, ভোগ এবং দ্য উইংয়ে সিনিয়র কমিউনিকেশন স্ট্যাটেজিস্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রিজিউমে গ্রহণ শুরু
নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি তার প্রশাসনে যোগ দিতে আগ্রহীদের জন্য একটি উন্মুক্ত আবেদন পোর্টাল চালু করেছেন। সিটি হলে কাজ করার জন্য ডেপুটি মেয়র, কমিশনারসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগের জন্য তিনি সব ধরনের পদে রিজিউম আহ্বান করেছেন। মামদানির ট্রানজিশন টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই রিজিউমে পোর্টাল ঐতিহাসিক নির্বাচনী জয়ের দুদিন পর ৬ নভেম্বর থেকে উদ্বোধন করা হয়েছে। ট্রানজিশন নির্বাহী পরিচালক এলানা লিওপোল্ড এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা সর্বোচ্চ দক্ষ জনবল নিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই নিউইয়র্কের পাঁচটি বরোর প্রতিটি প্রান্ত থেকে আমরা আবেদন আহ্বান করছি, যেন সবাই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এমন একটি শহর গড়তে পারেন, যেখানে থাকা সবার জন্য হবে সাশ্রয়ী।
মামদানির টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। আবেদন করতে পারবেন অভিজ্ঞ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক, কমিউনিটি সংগঠকসহ বিভিন্ন পেশার নিউইয়র্কবাসী। মাত্র ৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট মামদানি প্রথমবারের মতো সিটি প্রশাসনের দায়িত্ব নিচ্ছেন, ফলে তার নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঘিরে বাড়তি নজর রয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি শুধু নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কমিশনার জেসিকা টিশকে পদে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রিজিউমে পোর্টালটি মামদানির স্বচ্ছতা ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে চালু করা হয়েছে। এতে নতুন প্রজন্মের নাগরিক, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ কর্মজীবী নিউইয়র্কারদের জন্য সমান সুযোগ থাকবে।
টিমের সদস্যরা জানান, মামদানির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য নতুন প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরাসরি কাজ করবেন। পাশাপাশি, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগত চ্যালেঞ্জ ও সিটি হলের ব্যুরোক্রেটিক জটিলতার মধ্যেও কার্যকর প্রশাসন পরিচালনা নিশ্চিত করা হবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, মামদানির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এলে বিসগার্ড-চার্চও একসময় ২০২০ সালে তার অ্যাসেম্বলি অফিসে চাকরির জন্য সরাসরি আবেদন করেছিলেন। এবারও মামদানির নতুন মুখ ও প্রতিভা আবিষ্কারের প্রবণতারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।