১৬ জানুয়ারী ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:১০:৩৮ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশ গাজা না কাশ্মির, প্রশ্ন আসিফ নজরুলের
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৭-২০২৪
বাংলাদেশ গাজা না কাশ্মির, প্রশ্ন আসিফ নজরুলের বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ


নিরাপত্তা দানের কথা বলে ডিবিতে তুলে আনা ৬ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয়ার চাপ ক্রমশ বাড়ছে। এ নিয়ে জাতিসংঘ পর্যন্ত কথা বলেছে। সর্বশেষ, এ বিষয়ে আল্টিমেটাম দিয়েছে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’ নামের একটি ব্যানারে থাকা বিশিষ্ট ক’জন নাগরিক। তারা বলছেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া গেল। গত ৩০ জুলাই মঙ্গলবার ঢাকার সেগুন বাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।

ড. ইফতেখারুজ্জামান 

বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে ডিবি কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘন্টার সময় দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া না হলে ডিবি অফিসের সামনে মানববন্ধনসহ অন্যান্য প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হবে। তিনি বলেন, আজই ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। সেই কর্মসূচি স্থগিত করে সভা থেকে এই আল্টিমেটাম দেওয়া হলো।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) 'হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই' ব্যানারে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ডিবি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে পারেন, এমন ধারণা থেকে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিবি প্রতিনিধি যারা আছেন, আপনারা আপনাদের অফিসকে আমাদের এই বক্তব্য জানাবেন।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, ড. শামসুল হুদা, সামিনা লুৎফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মির্জা তাসলিমা সুলতানাও বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, সরকার অন্যায়ভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন করছে। সরকার অনেক আগেই সীমালঙ্ঘন করেছে। বক্তারা দেশের সব অভিভাবককে এই নির্যাতনের প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা ঘুমাতে পারিনা না। গতকালই ভাটারা থানায় ধরে এক ছাত্রকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে কি না সেটা দেখে ধরে নিচ্ছে। বাসায় টিয়ারগ্যাস ঢুকছে, সেটা ঠেকাতে কেউ গেলে তাকে অপরাধী করা হচ্ছে। শিশু কিশোরদের হত্যা করা হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে আলো ফেলে ব্লক রেইড করে ছাত্রদের ধরা হচ্ছে। তরুণদের, ছাত্রদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বাংলাদেশ কি গাজা, কাশ্মীর হয়ে গেছে? পুলিশ কি ভিনদেশী? অস্ত্র কি এদেশের মানুষের টাকায় কেনা নয়? ছাত্রদের, মানুষের মৃত্যুতে কোনো অনুতাপ নেই। সারাক্ষণ স্থাপনা আর স্থাপনা নিয়ে অনুতাপ। এসব স্থাপনা কি সরকারে যারা আছেন তাদের টাকায় করা? নাকি এদেশের মানুষের টাকায় করা? সরকার কি ছাত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে?

তিনি বলেন, ছাত্রাবাসে ও গণরুমের নির্যাতন নতুন নয়। এই প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত তাদের শাস্তি হতে হবে। আবু সাইদ ইট পাটকেলের আঘাতে মারা গেছে বলে মামলা হয়েছে। রসিকতা করেন? ছাত্রলীগের হাতে অস্ত্র, কোনো গ্রেপ্তার নেই। আর প্রমাণ ছাড়া আপনি হাজার হাজার গ্রেপ্তার করেছেন। ফাজলামি করেন আমাদের সাথে? হত্যাকারীর বিচার করেন। গণরুমের টর্চার সেল বন্ধ করেন। আইন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, আর্টিকেল ৩৫ সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে নিম্ন আদালত কেনো বারবার রিমান্ড দিচ্ছে? সুপ্রীম কোর্টের কাছে আটককৃতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির নিশ্চিত করার জন্য আবেদন করেন। আদালকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন।

অধ্যাপক ড. শামসুল হুদা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হুদা বলেন, এখানে শিক্ষকসহ অন্যান্য যারা এসেছেন, কেউ প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নিয়ে আসেননি। সবাই এদেশের নাগরিক, যারা আন্দোলন করছেন তাদের অভিভাবক। ১৬ জুলাই থেকে যে তা-ব, হত্যাযজ্ঞ হয়েছে ইতিহাসে তার নজির নেই। হানাদার বাহিনী যে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে তার চেয়ে ভয়ংকর। তিনি বলেন, আমরা মধ্যবিত্তরা কমফোর্ট জোনে থাকতে চেষ্টা করি। বিগত ১৫ ধরে অনেক অন্যায় হয়েছে, আমরা সহ্য করেছি। 'এনাফ ইজ এনাফ' এ কথা বলার সময়ও অনকে আগে পার হয়েছে। অনিয়ম দুর্নীতি নিরবতা, কমফোর্ট জোন সবকিছু অতিক্রম করে গেছে। দলমত নির্বিশেষে অভিভাবকদের জেগে ওঠার সময়। যেকোনো মূল্যে সন্তানদের রক্ষা করতে হবে; দরকার হলে জীবন দিয়ে।

অধ্যাপক শিরনি হক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিরনি হক বলেন, যদি শুধু মুখ চর্চায় আবদ্ধ থাকেন, আর শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত হতে থাকে- তাহলে সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে।

অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়াল আছে। সহজে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু গেট খুলে বহিরাগতদের এনে আক্রমণ করেছে একদল। শিক্ষকরা আক্রান্ত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। সিন্ডিকেট তা শোনেনি। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রশাসন ছিল না। তিনি বলেন, সাবেক ছাত্ররা হল দখল করে থাকে। ফলে ছয়জন থাকতে পারে এমন রুমে থাকছে নিয়মিত ২০ জন ছাত্র। অনেক বছর ধরে স্বৈরাচারী আচরণ হয়েছে। আমরা ২০১৫ সাল থেকে বলে আসছি। প্রশাসনের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ফলে আজকের আন্দোলন শুধু কোটা বিরোধী আন্দোলন বলছে না ছাত্ররা, ছাত্ররা বলছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন রাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে। যখন গুলি হয়েছে তখন কিছু করতে পারেনি, এখন তুলে নেওয়া হচ্ছে। আমরা কিছু করতে পারছি না। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। হাসপাতালে গোয়েন্দারা খবর নিচ্ছে। আহতরা চিকিৎসা না নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আবু সাইদের মামলা থেকে বোঝা যায় কতটা মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এই আন্দোলনকে ক্রিমিনাল অ্যাসপেক্ট থেকে বের করতে ছাত্র, শিক্ষক, নাগরিকদের পাশে থাকতে হবে। মানসিক যন্ত্রণায় ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে। খেতে অসুবিধা হচ্ছে।"

এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। প্রতিটি হতাহতের ঘটনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র ব্যবহার ও বলপ্রয়োগের ঘটনা জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে তদন্তের দাবি জানানো হয় তাদের পক্ষ থেকে।

শেয়ার করুন