২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৫০:২৫ পূর্বাহ্ন


তৃতীয় দেশে ফেরত পাঠানোর যুক্তিতে আশ্রয় আবেদন বাতিলের উদ্যোগ
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১২-২০২৫
তৃতীয় দেশে ফেরত পাঠানোর যুক্তিতে আশ্রয় আবেদন বাতিলের উদ্যোগ নিউইয়র্কের জ্যাভিটস ফেডারেল ভবনে অবস্থিত ইমিগ্রেশন কোর্টের বাইরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ফেডারেল আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারা।


ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হাজারো আশ্রয়প্রার্থীর চলমান মামলা বাতিলের জন্য এক নতুন ও আক্রমণাত্মক কৌশল নিয়েছে। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, এই আবেদনকারীদের নিজ নিজ দেশে নয়, বরং তৃতীয় কোনো দেশে নির্বাসন দেওয়া সম্ভব। অভ্যন্তরীণ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই প্রচারণা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরও তীব্র হয়েছে এবং নিউইয়র্ক, আটলান্টা, মায়ামি, লস অ্যাঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, টেক্সাসসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ইমিগ্রেশন কোর্টকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হচ্ছে। ইমিগ্রেশন আইনজীবী ও অনুমোদিত আইনি প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস )-এর আইনজীবীরা বিচারকদের কাছে আবেদন করছেন যেন আশ্রয় মামলাগুলো মেরিট বা মূল শুনানিতে না গিয়ে আগেই খারিজ করে দেওয়া হয়। এসব আবেদনে বলা হচ্ছে, সব অভিবাসী নিজ দেশে নির্যাতনের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চেয়েছেন, তাদের এমন তৃতীয় দেশে পাঠানো যেতে পারে, যেসব দেশের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন নির্বাসন গ্রহণের সমঝোতা করেছে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন কোর্টগুলো বিচার বিভাগীয় শাখার অংশ নয়। এগুলো বিচার বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস)-এর অধীন প্রশাসনিক আদালত, যেখানে বিচারকদের তত্ত্বাবধান করে সরকারই। এসব মামলায় সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন আইস-এর আইনজীবীরা। নতুন কৌশলের আওতায় আইস বিচারকদের অনুরোধ করছে যে, আশ্রয় দাবির শুনানি না করেই আবেদনকারীদের গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, ইকুয়েডর, এমনকি উগান্ডার মতো তৃতীয় দেশে পাঠানোর নির্দেশ দিতে। আদালত যদি এসব আবেদন মঞ্জুর করে, তাহলে আশ্রয় আবেদন কার্যত বাতিল হয়ে যায় এবং আপিল না থাকলে দ্রুত নির্বাসনের পথ খুলে যায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত আইস ইতোমধ্যে ৮ হাজারের বেশি আবেদন দাখিল করেছে, যেখানে তৃতীয় দেশের সঙ্গে করা নির্বাসন চুক্তির কথা উল্লেখ করে আশ্রয় মামলা বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ট্রাম্প প্রশাসনের আশ্রয় ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে সংকুচিত করার সর্বশেষ পদক্ষেপ।

প্রশাসনের দাবি, আশ্রয় ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে অপব্যবহার হচ্ছে এবং অনেকেই অর্থনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসনের সময় দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশকারীরা। এই যুক্তিতেই আশ্রয়ের প্রবেশপথ আরও সীমিত করার চেষ্টা চলছে।

হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট (ডিএইচএস) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইনের আওতায় থাকা সব প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেই যত দ্রুত সম্ভব অবৈধ অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দিতে কাজ করছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, আশ্রয় ব্যবস্থার জট ও অপব্যবহার মোকাবিলায় আইনসম্মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে আবেদনকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের বদলে অংশীদার কোনো দেশে সুরক্ষা চাইতে পারেন।

এই কৌশলের ভিত্তি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন আইনের একটি ধারা, যেখানে বলা হয়েছে- যদি কোনো আশ্রয়প্রার্থী এমন একটি দেশে সুরক্ষা চাইতে পারেন, যে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সেইফ থার্ড কান্ট্রি চুক্তি রয়েছে, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের অযোগ্য হতে পারেন। গত অক্টোবরের শেষ দিকে বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপিলস একটি রায় দেয়, যা এই কৌশলকে আরও শক্তিশালী করেছে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। ওই রায়ে ইমিগ্রেশন বিচারকদের নির্দেশ দেওয়া হয়-আশ্রয় আবেদনের শুনানির আগে আইস-এর তৃতীয় দেশে পাঠানোর আবেদন নিষ্পত্তি করতে। একই সঙ্গে, আবেদনকারীর ওপরই প্রমাণের দায় চাপানো হয়েছে যে, তৃতীয় দেশেও তিনি নির্যাতনের শিকার হতে পারেন।

একাধিক ইমিগ্রেশন আইনজীবী বলেছেন, এই উদ্যোগ কেবল তথাকথিত জাল আশ্রয় আবেদনকারীদের নয়, বরং ইরান, নিকারাগুয়া ও রাশিয়ার মতো দেশ থেকে আসা প্রকৃত নির্যাতিত ব্যক্তিদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সরকারের দৃষ্টিতে আশ্রয় ব্যবস্থা নিজেই একটি সমস্যা, কারণ এটি দ্রুত নির্বাসনে বাধা সৃষ্টি করে। তার ভাষায়, আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চান, তাহলে আপনাকে এমন এক দেশে আবেদন করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যেখানে আপনি কখনো যাননি। শেষ পর্যন্ত আপনাকে হাল ছেড়ে দিতে বলা হচ্ছে। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজীবী এই কৌশলের বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, বিশেষ করে ২০১৯ সালের সেই বিধানকে কেন্দ্র করে, যেটি তৃতীয় দেশে নির্বাসনের যুক্তিতে আশ্রয় বাতিলের পথ খুলে দিয়েছে।

সান ফ্রান্সিসকোর সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড রিফিউজি স্টাডিজের আইনি পরিচালক ব্লেইন বুকি বলেন, এই প্রশাসন কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের সুযোগ ধ্বংস করে দিতে চাইছে। তাদের কাছে এটি মামলাগুলো এক ঝটকায় শেষ করার সহজ উপায়। বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের ‘ডিউ প্রসেস’ বা ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়া গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং হাজারো মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

শেয়ার করুন