দক্ষিণ এশিয়ায় ভৌগোলিক অবস্থানের বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে বৈরিতা নয়, চাই সৎ প্রতিবেশী সুলভ সুসম্পর্ক। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতে আশ্রয়, অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং সহায়তার ঐতিহাসিক সত্যকে যেমন অস্বীকার করা যাবে যাবে না তেমনি বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাব স্বাধীনতার পর থেকেই দারুণভাবে দৃষ্টিকটু। তবে এগুলোর জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের ভারতাশ্রয়ী নতজানু পররাষ্ট্র নীতিই দায়ী। একদিকে যেমন কিছু দল এবং গোষ্ঠীর চরমভাবে ভারত বিরোধী মনোভাব, অন্যদিকে আবার কিছু দল এবং গোষ্ঠীর দৃষ্টিকটুভাবে ভারত নির্ভরতা। অথচ দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক সমতাভিত্তিক হলে দুটি দেশের জন্য সম্মানজনক হতো।
বাংলাদেশ পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর প্রায় তিন দিক থেকেই ভারতবেষ্টিত। বাংলাদেশের সব নদনদী ভারত বা নেপাল থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশকে পলিমাটি সমৃদ্ধ করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এবং বাংলাদেশের ভারতাশ্রয়ী দুর্বল বিদেশি নীতির ফলশ্রুতিতে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ অধিকাংশ নদনদী এখন মৃতপ্রায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট আর বর্ষা মৌসুমে প্লাবন বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে দারুণভাবে সংকটে ফেলে। দুই বন্ধুসুলভ দেশের মধ্যে কেন স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি বণ্টন বিষয়ে ন্যায্য সমাধান হলো না? কেন দুদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলো? কেন বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না? কেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের পশ্চিম থেকে পূর্বে ট্রানজিট সুবিধা অবাধ করা হলেও বাংলাদেশ ভুটান নেপালের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য করতে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? দীর্ঘ সময় ধরে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে অস্বস্তিকর অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হচ্ছে না?
অথচ আমরা জানি, ১৯৭১ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকার ছিল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশিদের অকৃত্রিম বন্ধু। এক কোটি শরণার্থী বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার দীর্ঘ ৯ মাস এক কোটি মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং একপর্যায়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এই কারণে বাংলাদেশ কিন্তু কখনোই ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধে কার্পণ্য করে নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভারতের শাসকগোষ্ঠী নানা আচরণে প্রমাণ করেছে ওরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মানে না। বাংলাদেশ যেন ভারত আশ্রিত করদ রাজ্য। যখনি বাংলাদেশের কোনো শাসক স্বাধীনভাবে কিছু করতে চেষ্টা করেছে তাদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের কারণে বাংলাদেশে নানা সময়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সাধারণ জনসাধারণের মনে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মেলবন্ধন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এখন অনেকটাই শত্রু ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ভারতের দাদাগিরি মনোভাবের কারণেই বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ কিন্তু শুরু থেকেই উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু পিলখানা হত্যাকাণ্ডসহ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু সাড়া জাগানো দুঃখজনক ঘটনা বিষয়ে বাংলাদেশিদের মনে নানা ক্ষোভ আছে। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার সর্বস্তরে ভারতীয়দের নাক গলানোর অভিযোগ আছে। আমি সর্বস্তরে ভারত বিরোধিতার বিষয়ে একমত নই। কিন্তু স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে ভারতের আধিপত্যবাদ মেনে নিতে পারি না। সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব নিয়ে ভারত সার্বভৌম সমতা মেনে চলুক, দুদেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর ন্যায্যতাভিত্তিক সমাধান হোক সেটাই কাম্য।
বাংলাদেশ কখনো ভারতের প্রতি হুমকি হতে পারে না। দুটি দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। আশা করি দুদেশের দেশপ্রেমী জনগণ নিজেদের স্বার্থেই বর্তমান বিরাজমান শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটাবে। হাতে হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে ভুটান, সিকিম মনে করলে ভারত ভুল করবে এবং ভুলের মাশুল দিতে হবে। অপরদিকে দুদেশ নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবহারে প্রযুক্তি সামর্থ্য সম্পৃক্ত করলে কয়েক দশকের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দক্ষিণ এশিয়া গড়ে উঠবে।