যেকোনো রাজনৈতিক পালাবদলকালে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরাই আক্রমণের শিকার হন, আক্রমণের মুখে সংখ্যালঘুরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান, অনেকে আবার দেশত্যাগ করেন। এক শ্রেণীর সুযোগসন্ধানীরা এরকম ঘৃণিত ও নিন্দনীয় কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর পক্ষ থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন আগস্ট ২০২৪ প্রকাশ করতে গিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
এবারের প্রতিবেদনটি তুলে ধরতে গিয়ে এমএসএফ’র পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, এ মাসের প্রথম থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে যাতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং কিশোর কিশোরী শিক্ষার্থীরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশসহ শান্তিপূর্ণ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিল।
৫ আগস্ট সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন। বিজয় উদযাপনের জন্য সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এরই মাঝে ক্ষোভ মেটাতে গিয়ে কিছু ব্যাক্তি ঐদিন বিকেল থেকেই সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি দলের অনেক নেতার ঘরবাড়িতে, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। অনেকে গণভবন ও জাতীয় সংসদের ভেতরে ঢুকেও বিশৃঙ্খলা চালায়। যে যা পায়, সেখান থেকে তাই তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। রাজধানী ঢাকায় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়েও হামলা করা হয়।
এর পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ও তাদের উপাসনালয়ে হামলার কিছু ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, ৩৭টি জেলাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে যা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রতি চরম হুমকি স্বরূপ। দেখা গেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ১২টি আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে ১২৯ টি ঘটনায় বাড়ী-ঘর, মন্দির, লুটপাট ও ভাংচুর করা হয়। পঞ্চগড়ের আহমদনগরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের আহমদিয়া মসজিদ, জামিয়া (ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যালয়) ও জলসা গাহে (বার্ষিক সম্মেলনের মাঠ), রংপুরের তারাগঞ্জে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং ঘের ও জমি দখল হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সকল ঘটনায় আহত হয়েছেন ২০ জন।
৫ আগস্ট সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ঘের ঘটনা ঘটে। এতে থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্থানীয় জনসাধারণ এনায়েতপুর থানা ভাংচুর করে ১৪ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অনেক পুলিশ সদস্য মারা যায়। দেশের বেশির ভাগ থানা মূলত বন্ধ থাকে এবং পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে সাহস পায়নি। পরবর্তী সময়ে এক পর্যায়ে দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৩৮টি থানার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন মেট্রোপলিটনের ১১০টি থানার মধ্যে ৮৪টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৪৫৪টি থানার কার্যক্রম শুরু করা যায়। যা জন নিরাপত্তার জন্য একটি ইতিবাচক ঘটনা। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দীর্ঘদিন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পথে চলার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে চলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রত্যেকটি নাগরিকের উচিত এ অর্জনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পুরোনো সব বিভাজন, বিভক্তি, দলীয় রেষারেষি ভুলে গিয়ে আবারও আমাদের শান্তির পথে এগোতে হবে। এ জন্য সবার জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মানুষ আর কোনো সহিংসতা বা ধ্বংসযজ্ঞ চায় না। এমনিতেই এক হাজারেরও বেশি প্রাণের বিনিময়ে আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হয়েছে। আহতদের মধ্যে এখনও ৫০০ জনেরও অধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ গুরুতর আহতাবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বহু আন্দোলনকারী পঙ্গু হয়ে অসহায় জীবন অতিবাহিত করছেন।
আন্দোলনের শেষের দিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট এবং ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তিন দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ডাকা অসহযোগেও অফিস-আদালত বন্ধ থাকে, শিক্ষার্থীদের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’র ডাক এর পর করফিউ জারি করা হয়। সরকার মুখে নমনীয় হওয়ার কথা বললেও বাস্তবে বলপ্রয়োগে আন্দোলন স্তব্ধ করার পরিকল্পনা করেছিল, যার ফলে একটি অহিংস আন্দোলন এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পরিণত হয়।। একই সঙ্গে সিরাজগঞ্জে এক থানাতেই ১৩ পুলিশ সদস্য এবং নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের ৬ নেতা-কর্মীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ভয়াবহ। এই পরিবেশে দেশের অবস্থা দ্রুত স্বাভাবিক হবে, আশা করা যায় না। সবার একটাই প্রত্যাশা- সংঘাত বন্ধ হোক, দেশে শাস্তি আসুক। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ আমাদের সবাইকে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অতীতের শিক্ষা সবার বিবেচনায় রাখতে হবে।