৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৬:০৪:০৬ অপরাহ্ন


কান নিয়ে যায় চিলে!
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৯-২০২৪
কান নিয়ে যায় চিলে!


কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার কয়েকটি লাইন এ রকম-এই নিয়েছে ঐ নিল যা:! কান নিয়েছে চিলে/চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।

সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি/যে জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই/মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু/ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!

ছুটতে দেখে ছোট্ট ছেলে বললো, কেন মিছে/কানের খোঁজে মরছো ঘুরে সোনার চিলের পিছে?/ নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;/কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।/ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?/বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হলো শ্রম।

প্রসঙ্গটা টানলাম এজন্য যে, গত সপ্তাহে দেখলাম জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় নিউইয়র্কের তথাকথিত সুশীলসমাজের কিছু প্রতিনিধি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বদলানোর প্রতিবাদে এক সমাবেশে মিলিত হয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, কারা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন চাইছে? কোনো রাজনৈতিক দল? যেমন বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টি, কোনো বাম দল বা অন্য কেউ? উত্তর একটাই, না।

প্রসঙ্গটা টেনেছেন, সদ্য আয়নাঘর ফেরত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে হলেও তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। জামায়াতের আমির সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীতে তার সাধারণ সদস্যপদও নেই। তার এ বক্তব্য একান্তই তার নিজস্ব, জামায়াতের নয়।

একজন ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্য পতিত আওয়ামী লীগের সদস্যরা বৃথা জল ঘোলা করার চেষ্টা করতেই পারে। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটা ধরে বাঁচতে চায় তেমনি। কিন্তু সুশীলরা? বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র একজন ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে আপনারা মাঠে নেমে কার স্বার্থে জল ঘোলা করতে চাইছেন? যে ব্যক্তিবিশেষের মতামতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলসহ-সাধারণ ছাত্র-জনতার সামান্যতম কোনো সমর্থন নেই, তখন কার স্বার্থে আপনাদের এ আন্দোলন? অযথা চিলের পেছনে না দৌড়ে কানে হাত দিয়ে দেখুন, তা সঠিক জায়গায় আছে কি না!

তারপরও একটা প্রশ্ন রাখছি, কেন কারণ ছাড়াই জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের খবরে রাস্তায় নামলেন? অথচ গত জুলাই মাসে যখন ছাত্র-জনতার রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল, হাজারো প্রবাসী যখন এর প্রতিবাদে এ প্রবাসেও বিক্ষোভ করেছিলেন, সেদিন আপনাদের টিকিটিও দেখা যায়নি কেন? কোথায় ছিলেন আপনারা সেদিন?

বায়াস, বুলসিট, লাই

২০১৭ সালে রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ইউরোপজুড়ে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এক জরিপ চালানো হয়। নিক নিউম্যান এবং রিচার্ড ফ্লেচারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই জরিপ চলে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত বলে পরিচালিত আটটি দেশে। এগুলো হচ্ছে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও গ্রিস। আটটি দেশের হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে খোলা প্রশ্নের জবাব বিশ্লেষণ করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এ রিপোর্টের শিরোনামটিই ছিল-‘বায়াস, বুলশিট, লাই’।

এই জরিপের মোদ্দাকথা হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপর বেশির ভাগ মানুষের আস্থা নেই। তাদের সহজ উত্তর; গণমাধ্যমগুলো এখন হয় বায়াস, অথবা বুলশিট লিখে বা মিথ্যা লিখে। অভিধান বলছে, ‘বায়াস’ মানে হচ্ছে পক্ষপাত, একপেশে। ‘বুলশিট’ অর্থ বাজে কথা, আবোলতাবোল কথাবার্তা। আর ‘লাই’ মানে মিথ্যা, অসত্য। জরিপের ফলাফল বলছে, সংবাদমাধ্যমের ওপর যাদের আস্থা নেই, তাদের ৬৭ শতাংশ মনে করেন, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম একপেশে, নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সাংবাদিকতা করে। সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার চেয়ে ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী মহলের [শুধু ক্ষমতাসীন নয়] রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকেই রক্ষা করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পাঠক, দর্শক-শ্রোতাদের অভিযোগ, তাদের দেশে প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো পছন্দসই পক্ষের হয়ে কাজ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা মনে করেন, টেলিভিশনে যা দেখানো হয়, তা থেকে সত্যের কাছাকাছি কিছুটা ধারণা নেওয়া যায়, কিন্তু দ্রুত খবর প্রচার করতে গিয়ে তারাও প্রকৃত তথ্যকে পাশ কাটিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারাও বিশেষ অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ডেনমার্কে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশি। জরিপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার চিত্র বেশ করুণ। এদের বিশ্বাসযোগ্যতার পক্ষে মাত্র ২৪ ভাগের অবস্থান। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সত্যের চেয়ে কল্পনাকেই গুরুত্ব দেয় বেশি। অসত্য তথ্য, নিজস্ব অ্যাজেন্ডা, প্রবল নিজস্ব মতামতনির্ভরতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথ্যদূষণের জন্যও দায়ী। তবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের অতিমাত্রায় পক্ষপাত ও অ্যাজেন্ডানির্ভর সাংবাদিকতা বিপুলসংখ্যক মানুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।

প্রসঙ্গটা টানলাম নিউইয়র্কের সাংবাদিকতা নিয়ে। ক’দিন আগেই দেখলাম ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকা প্রকাশনার কয়েক মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল। বলা যায়, আঁতুর ঘরেই মৃত্যু! পরের মাসেই অনুষ্ঠিত হলো আরো একটি পত্রিকার জমজমাট প্রকাশনা অনুষ্ঠান। মহামান্য মেয়র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এই পত্রিকাটির প্রকাশনা গ্রুপও এ প্রবাসের একটি বড় বিজনেস গ্রুপ। এর আগেও আরো একটি বিজনেস গ্রুপের উদ্যোগে নিউইয়র্কে বাংলা পত্রিকা প্রকাশনা হচ্ছে। প্রবাসী বিত্তবান ব্যবসায়ীদের কাছে সংবাদপত্র প্রকাশনা এখন সিম্বল অব প্রেস্টিজ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটা সংবাদপত্রের জন্য যে ন্যূনতম মানদণ্ড থাকে তার কতটুকু এসবে রক্ষা হচ্ছে? এসব সংবাদপত্রের আউটপুট কি? তাদের পরিবেশনাগুলো বায়ার্স, বুলশিট, লাই, না অন্যকিছু!

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। পেশা হিসেবে সংবেদনশীলতা সাংবাদিকতাকে অন্য সব পেশা থেকে আলাদা করেছে। সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির দর্পণস্বরূপ। সাংবাদিকতা যেমনি মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে, তেমনি এর একটি ভুল সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আনতে পারে চরম দুর্ভোগ। যে কারো হাতে ছুরি কাঁচি তুলে দিয়ে যেমন সার্জন বানিয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি যে কারো হাতে পরিচয়পত্র, কলম, ক্যামেরা বোম তুলে দিয়েও সাংবাদিক বানানো যায় না। সাংবাদিকতা শাস্ত্রের পন্ডিতরা মনে করেন, একজন পেশাদার সাংবাদিককে অবশ্যই সংবাদ সংগ্রহ, লিখন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে যেমন দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়, তেমনি মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের সুষ্ঠু প্রয়োগও অপরিহার্য। আর এগুলোর ঘাটতি থাকলে সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের কমিউনিটিতে নিত্যনতুন যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এসব স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা হচ্ছে কি?

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইন পত্রিকা এখন অনেক জনপ্রিয় হয়েছে, সারা বিশ্বে। আমাদের প্রবাসেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দু’একটা ছাড়া মানসম্পন্ন অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা যে একেবারেই হাতেগোনা তা যে কোনো অনুসন্ধানী পাঠকই বুঝতে পারবেন।

নিউইয়র্কে সংবাদপত্র এখন শুধু সিম্বল অব স্ট্যাটাস নয়, পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বটে! অনেকটা বারোহাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচির মতোই। নিউইয়র্কে এখন স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে বের করেন দুই পৃষ্ঠার অনলাইন পত্রিকা। বাকিটুকু বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন হালাল করার জন্য দুই পৃষ্ঠার নিউজ বের হয় কি না সে প্রশ্নটা থেকেই যায়।

# নিউইয়র্ক, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শেয়ার করুন